গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থা ডিজিটালাইজেশন করা হচ্ছে

তিতাস গ্যাসের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাই?

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি দেশের ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বড়। দেশে বিতরণ করা গ্যাসের ৬০ শতাংশই তিতাসের মাধ্যমে হয়ে থাকে। বাকি ৪০ শতাংশ বিতরণ করে পাঁচ কোম্পানি। তিতাসের আওতাধীন এলাকা বেশ বিস্তৃত। আমাদের সর্বমোট বিতরণ লাইন রয়েছে ১৩ হাজারের মতো। তিতাস গ্যাসের আওতাধীন এলাকাগুলো হচ্ছে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, শেরপুর নেত্রকোনা। আমরা কাজের সুবিধার্থে তিতাসকে পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ করেছি। যেহেতু ঢাকায় আমাদের অনেক বেশি আবাসিক গ্রাহক রয়েছে তাই ঢাকাকে দুটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। আমাদের মোট আবাসিক গ্রাহকের সংখ্যা ২৮ লাখেরও বেশি। বাণিজ্যিক গ্রাহক রয়েছে ২০ হাজার। সব মিলিয়ে তিতাসের মোট গ্রাহক সংখ্যা ২৮ লাখ ৭৪ হাজার। তিতাস কিন্তু গ্যাস কেনা বা উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। আমরা মূলত বিতরণ কোম্পানি। পেট্রোবাংলা আমাদের যা গ্যাস দেয় আমরা সেটা গ্রাহকের কাছে বিতরণ করি। এর বিপরীতে আমরা একটা কমিশন পাই। কমিশন আগে ২৫ পয়সা ছিল, যা কমিয়ে বর্তমানে ১৩ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি আমাদের আয়ের একমাত্র উৎস। এটি কেন কমানো হয়েছে জানি না। তবে এটা খুবই দুঃখজনক।

দেশে চাহিদার তুলনায় গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। এক্ষেত্রে চাহিদা সরবরাহের মধ্যে কীভাবে সমন্বয় করা হচ্ছে?

চাহিদা সবসময়ই বেশি ছিল। আমরা ২০০ থেকে ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কম পাচ্ছি। এজন্য কিছু এলাকায় গ্যাসের চাপ একটু কমিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ আমাকে পেট্রোবাংলা থেকে যতটুকু গ্যাস দেয়া হয় ততটুকুই গ্রাহকদের দিতে হবে। এর বেশি দেয়ার সুযোগ নেই।

আবাসিকে গ্যাস বেশি খরচ হচ্ছে নাকি শিল্প খাতে?

আবাসিকের গ্রাহক সংখ্যা বেশি হলেও মোট বিতরণ করা গ্যাসের থেকে ১০ শতাংশ ব্যবহার করছে। অন্যদিকে শিল্প খাতের গ্রাহক সংখ্যা কম হলেও তাদের ব্যবহারের পরিমাণ বেশি।

তিতাসের অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিষয়টি বহুল আলোচিত। এর বিরুদ্ধে আপনারা কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?

তিতাসের অনেক অবৈধ গ্রাহক আছে। সরকারের পক্ষ থেকে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ দেয়া বন্ধ থাকলেও মানুষ অবৈধভাবে সংযোগ নিয়ে ব্যবহার করছে। মানুষের ধারণা, গ্যাস ব্যবহারে কোনো পাপ হয় না, এটি ফ্রি। প্রায়ই আমরা সরাসরি অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে অভিযান চালাই। অনেককে গ্রেফতারও করা হয়। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। একটা দেশে সরকারের সম্পত্তি এভাবে চুরি করে নিয়ে যাবে, এটা হয় না। আগে আমরা রাতের বেলা অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আসতাম, দিনের বেলায় আবার সেটি সংযুক্ত করা হতো। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ তিতাসের কর্মীদের দায়ী করে থাকে। কিন্তু গ্যাস সংযোগের কার্যক্রম কিন্তু তিতাসের নিজেদের জনবলের মাধ্যমে করা হয় না। ঠিকাদারদের মাধ্যমে সংযোগ দেয়া হয়। তবে পর্দার অন্তরালে তিতাসের কেউ জড়িত থাকলেও থাকতে পারে। তাদের ধরা অসম্ভব কিছু না। মানুষ শুধু দোষ দেয় কিন্তু কারা জড়িত সেটা বলে না। আমি সবসময় বলি এসব কাজে যদি তিতাসের লোক জড়িত থাকে তাহলে ধরেন, বেঁধে রাখেন, থানায় দেন কিংবা আমাকে খবর দেন। দেখেন বিচার হয় কিনা। এরই মধ্যে আমি চারজনকে চাকরিচ্যুত করেছি। কয়েকজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলছে। যখনই শুনি তিতাসের কোনো কর্মচারী কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত, আমি দ্রুত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। তদন্ত কমিটি গঠন করি। ঢাকার বাইরে কিছু এলাকায় শিল্পের জন্য নেয়া সংযোগ থেকে গ্রামের পর পর গ্রামজুড়ে অবৈধ সংযোগ নেয়া হয়েছে। সেগুলোও আমরা উচ্ছেদ করছি। কামরাঙ্গীরচরে বৈধ গ্যাস সংযোগ ছিল ১২ হাজার। এর বিপরীতে অবৈধ সংযোগের পরিমাণ ছিল লক্ষাধিক। আমরা পুরো এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এক মাসের মতো বন্ধ ছিল। তারপর বকেয়া পরিশোধ অবৈধ গ্যাস সংযোগ উচ্ছেদের পর আবার সরবরাহ চালু করা হয়েছে। রূপগঞ্জের কিছু কিছু এলাকায়ও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে। সরকার মূল্যবান ডলার দিয়ে গ্যাস কিনে আনে। ডলারের গ্যাস হয়ে গেছে ৪০ ডলার। গ্যাস চুরি করে নিয়ে যাবে, এটা হয় না। আমরা মানুষকে বোঝাচ্ছি। বৈধ গ্রাহকদেরই অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখতে হবে।

তিতাসের বকেয়া বিল আদায়ে কী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে?

তিতাসের অনেক বিল বকেয়া ছিল। আমরা সেটি কমিয়ে এনেছি। যাদের বিল বকেয়া রয়েছে তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। এমনকি সেটি শিল্প খাতের হলেও। বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাসের পরিসংখ্যান অনুসারে, আমরা পাইপলাইন উচ্ছেদ করেছি ২২০ কিলোমিটার। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জেই সবচেয়ে বেশি অবৈধ সংযোগ ছিল। অন্যদিকে ময়মনসিংহে খুবই কম মাত্র হাজার ৪০০টি অবৈধ সংযোগ পেয়েছি। তাও পাইপলাইন দিয়ে নয় বরং ঘরের মধ্যে লাইন টানা হয়েছিল। অনেক বকেয়াও আদায় করা হয়েছে। তিতাসের প্রায় ১৫০০ থেকে ১৬০০ কোটি টাকা বকেয়া আছে। কিছু ক্ষেত্রে মামলা চলছে। সেই মামলাগুলোও যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয় সেজন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।

বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নে তিতাস গ্যাসের কোনো পরিকল্পনা আছে কি?

ঢাকা নারায়ণগঞ্জ শহরের গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থা ডিজিটালাইজেশনের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে। লাইনগুলো অনেক দিনের পুরনো। এগুলো প্রায়ই লিক করে, আগুন লাগে। তাই পুরো লাইন রিপ্লেস করে নতুন লাইন স্থাপন করা হবে। কিছু জায়গায় কম ডায়ামিটারের পাইপ আছে, সেজন্য ভালোভাবে গ্যাস পায় না, সেখানে আমরা বেশি ডায়ামিটারের পাইপ স্থাপন করব। সঙ্গে জিআইএস সিস্টেম থাকবে। এতে আমরা বুঝতে পারব কোন জায়গায় কী সমস্যা রয়েছে। এজন্য আমরা অনেক প্রকল্প হাতে নিয়েছি। দেশে শিল্পায়ন বাড়ার কারণে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আগে অনেক জায়গায় পাইপলাইন ছিল না। আমরা জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত একটা পাইপলাইন করব। এলেঙ্গা থেকে মানিকগঞ্জ মানিকগঞ্জ থেকে ধামরাই পর্যন্ত আরেকটি পাইপলাইন করা হবে। প্রকল্পগুলো আমরা হাতে নিয়েছি।

এক্ষেত্রে কি নতুন লাইন স্থাপন করা হবে, নাকি আগের লাইনগুলোর সংস্কার করা হবে?

কিছু রয়েছে আগের লাইন। রাস্তার পরিসর বাড়ার কারণে লাইনগুলো মাঝে পড়ে গেছে। সেগুলো আমরা বেশি ডায়ামিটার দিয়ে দুই পাশে স্থাপন করব। ঢাকার বেশির ভাগ এলাকায় ডিজিটালাইজেশনের কাজ চলছে। এরই মধ্যে কিছু এলাকায় লিক ডিটেকশনের কাজও শুরু করেছি।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বর্তমানে দেশের জ্বালানি খাতেও সংকট তৈরি হয়েছে। অবস্থায় গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে কি?

সংকট হয়তো এক-দুই মাসের বেশি থাকবে না। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে চলে গেলে তখন গ্যাসের চাহিদাও কিছুটা কমবে। সেই বাড়তি গ্যাস তখন অন্য জায়গায় সরবরাহ করতে পারব।

তিতাসের ট্রান্সমিশন ডিস্ট্রিবিউশনে কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে কি?

গ্যাস বৃদ্ধি বা কমানোর দায়িত্ব আমাদের না। আমাদের কাজ হলো ঠিকমতো ডিস্ট্রিবিউট করা। এজন্য পাইপলাইনের বিষয়গুলো বললাম আপনাকে। যেখানে যেখানে রিপ্লেস কিংবা সংস্কার করা দরকার তা আমরা করব। পাশাপাশি ডিজিটালাইজেশন করার পরিকল্পনা রয়েছে।

 

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আহমেদ হাসান

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন