একক আমদানিকারক হিসেবে সরকার মুনাফাভিত্তিক ব্যবসা করতে পারে না

. তামিম জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের ডিন, পেট্রোলিয়াম প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী। বাংলাদেশ ভারতে স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়াশোনা শেষে পিএইচডি অর্জন করেন কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তার আগ্রহের ক্ষেত্র তেল-গ্যাস উত্তোলন, তেল জ্বালানি অর্থনীতি, পরিবেশ, জ্বালানি নীতি পরিকল্পনা। সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা, ভর্তুকি, বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার, মজুদ সক্ষমতা, রাষ্ট্রীয় নীতি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয় বণিক বার্তার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা 

বিশ্ববাজারে জ্বালানিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে দেশেও দাম বাড়ানো হলো। এটা কতটা যুক্তিসংগত?

দেশে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিশ্ববাজারে উচ্চমূল্যের যে যুক্তি দেখানো হচ্ছে তা আসলে যুক্তিসংগতই নয়। কারণ বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য এখন আর নেই, দাম পড়তির দিকে। মাসখানেক আগেই আমি জ্বালানি তেলের দাম কমার কথা বলেছিলাম। তেলের দাম যখন ব্যারেলপ্রতি ১১০ ডলার ছিল, তখন বলেছিলাম, সামনে তেলের দাম কমবে। সেজন্য আমাদের অপেক্ষা করা উচিত, হঠাৎ করে মূল্য সমন্বয় করা উচিত নয়। কেননা, বাংলাদেশে একবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিলে এরপর তা কমানো খুবই কঠিন। নানা কারণেই তা কঠিন। কারণ একবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ালে সবকিছুরই মূল্য বৃদ্ধি ঘটে যাত্রী ভাড়া, পরিবহন ভাড়া তো বাড়েই, সঙ্গে অন্যান্য নিত্যপণ্য দ্রব্যের দামও বাড়ে। আবার বাংলাদেশে কোনো কারণে একবার দ্রব্যের দাম বাড়লে পরবর্তী সময়ে তা আর কমে নাএখানে ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা করবেই। সাধারণ মানুষ এর কোনো সুবিধা পায় না। এসব কারণে আমি সবসময়ই বাংলাদেশে জ্বালানিপণ্যের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলি।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে সরকার কী করবে?

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অনেক কমে যেতে পারে। আগেও এমনটি ঘটেছে। তখন তো সরকার দাম কমাবে না! তারা অতিরিক্ত মুনাফা করবে। সরকার যদি অতিরিক্ত মুনাফা করে তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) স্বচ্ছতার সঙ্গে কোনো কথাই বলে না। গত পাঁচ বছরে বিপিসি প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। দুঃসময়ে যদি মুনাফার টাকা কোনো কাজে না লাগে তাহলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ বিপিসি সরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকার একক আমদানিকারক হিসেবে জ্বালানির মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি পণ্য নিয়ে সেবা খাতে মুনাফাভিত্তিক ব্যবসা করে যেতে পারে না। বাংলাদেশে বিপিসি জ্বালানিপণ্যের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। তারা ব্যবসা করলে রেগুলেটরের আওতায় জ্বালানির দাম নির্ধারণ করতে হবে হয় একটা সহফর্মুলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মূল্যের সঙ্গে দেশীয় মূল্যের সমন্বয় করতে হবে; যদি সরকার ভর্তুকি উঠিয়ে দিতে চায়। তা না হলে একটা গড় মূল্য স্থিতি অবস্থায় রেখে কম মূল্যের সময় মুনাফাটা বেশি মূল্যের সময় ভর্তুকি দিয়ে দাম ঠিক রাখতে হবে।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য যুক্তি হিসেবে ডিজেল পাচারের আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে। এটি কতটা গ্রহণযোগ্য যুক্তি?

আগে যখন ডিজেলের দাম কম ছিল তখন আমরা একদিনও শুনিনি যে ডিজেল পাচার হয়েছে। গত নভেম্বরের আগে পর্যন্ত প্রায় পাঁচ-ছয় বছর ধরে দেশে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৬৫ টাকা ছিল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তখন আমাদের তুলনায় ডিজেলের দাম বেশি ছিল। পরিপ্রেক্ষিতে আমি কীভাবে বলি যে পাচার হচ্ছে। তাছাড়া জ্বালানি তেল পাচারসংক্রান্ত কোনো পরিসংখ্যানও আমরা জানি না। আবার পাচার ঠেকাতে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তাও বলা হয়নি। শুধু বিপিসির লোকসান কমানোর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তারা তো লোকসানে নেই। তথ্যানুসারে বিপিসির ৩১ হাজার কোটি টাকার ডিপোজিট রয়েছে। তিনটি সরবরাহ কোম্পানি আছেপদ্মা, মেঘনা যমুনা। তাদের ফিক্সড ডিপোজিট হিসাবে ১৩ হাজার কোটি টাকা আছে। তাই জ্বালানি তেল পাচার বা লোকসানের যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়।

জ্বালানি তেলে ভর্তুকি কি থাকা উচিত?

আমি ব্যক্তিগতভাবে ভর্তুকিবিরোধী। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক যে কাঠামো তা ভর্তুকির ওপর ভিত্তি করেই তৈরি। কম মূল্যের গ্যাস শ্রম দুটোর ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের শিল্প খাত এত উন্নতি করেছে। পোশাক কারখানার জন্য যা অন্যতম চালিকাশক্তি। আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় শ্রম জ্বালানির মূল্য এত কম থাকার কারণে অনেক অদক্ষতা সত্ত্বেও এবং অনেক প্রণোদনার সাহায্যে পোশাক শিল্প আজ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভর্তুকির ওপর ভর দিয়ে পোশাক শিল্প দাঁড়িয়ে আছে। সরকার এখন ভাবতেই পারে যে আমাদের অর্থনীতি আর ভর্তুকিভিত্তিক হবে না। কিন্তু তা করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। ভর্তুকি ওঠাতে হবে ধীরে ধীরে। অর্থনীতির সঙ্গে খাপ-খাইয়ে। অথচ হঠাৎ একটা আলোড়ন সৃষ্টি করা হলো।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কী প্রভাব পড়বে?

একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারবে সামনে এর প্রতিঘাত কী হবে। মানুষের জীবনযাত্রায় এর কতখানি প্রভাব পড়বে। মানুষ এখন আতঙ্কের মধ্যে স্তম্ভিত হয়ে আছে। অনেকেই ভাবছে যে তারা ঢাকায় থাকতে পারবে কিনা, চাকরি টিকে থাকবে কিনা, কিংবা যে বেতন পাচ্ছে তা দিয়ে চলতে পারবে কিনা। মূল্যস্ফীতি যে হারে হচ্ছে সে তুলনায় মানুষের আয় কিংবা বেতন বৃদ্ধি হচ্ছে না। ফলে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। জ্বালানি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অতীতে মানুষকে দুর্দশা থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দীর্ঘদিন ভর্তুকি দেয়া হয়েছে।

জ্বালানির দাম বাড়ানোর অন্য কোনো কারণ আছে কি?

গত এক বছর প্রায় ৫০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির কথা বলা হচ্ছে। সরকারি হিসেবে মূল্যস্ফীতি এখন দশমিক ৫৬ শতাংশ। খাদ্যমূল্যের দাম অনেক বেড়েছে। যার একটা কারণ ডলারের দামের অ্যাডজাস্টমেন্ট। ডলারের অবমূল্যায়ন হয়েছে ২০ শতাংশ। সরকার যদি এটা বলত যে ডলারের অবমূল্যায়ন হয়েছে, বাংলাদেশী টাকায় আমদানি খরচ বেড়ে গেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে হবেতা গ্রহণযোগ্য একটা যুক্তি হতো। কিন্তু সরকার তা বলেনি।

বিপিসিকে তেল কিনতে যে ডলার জোগাড় করতে হবে, তা বাংলাদেশী টাকায় বাজার থেকে কিনে করতে হবে। বিপিসি সবসময় বাজার থেকে ডলার কিনে আন্তর্জাতিক মূল্য পরিশোধ করে। তারা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ব্যাংক রেটে ডলার কিনতে পারত। সম্প্রতি তেল আনার ব্যাপারে তাদের যে সমস্যা হয় তা টাকার ঘাটতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। সমস্যা হচ্ছে তারা ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে পারেনি। ব্যাংকগুলো বলেছে, আমরা ৯৪ কিংবা ৯৫ টাকা রেটে তোমাকে ডলার দিতে পারব না। কারণ, আমাদের কাছে ডলার নেই; বাজার থেকে কিনে দিতে হবে। বিপিসি তখন বলেছে না, আমরা ১১০ কিংবা ১১৫ টাকা রেটে ডলার কিনতে পারব না। বিষয়টি নিয়ে বিপিসি অর্থ মন্ত্রণালয়, জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সব জায়গায় চিঠি লিখে ডলারের ব্যবস্থা করে দিতে বলেছে। আমি ধারণা করছি, ডলারের চাপ থেকে মুক্তি পেতেই সরকার তেলের দাম বাড়িয়েছে। তারপরও জ্বালানি তেলের মূল্য সর্বোচ্চ ২০ শতাংশের বেশি বাড়ানোর কোনো যুক্তি আমি দেখি না। ২০ শতাংশের মধ্যে এটি রাখলে তা সহনীয় পর্যায়ে থাকত এবং ডলারে বিনিময় হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো।

এমন এক সময়ে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো যখন কিনা আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমছে...

আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম গতকাল পর্যন্ত ব্যারেলপ্রতি ৯০ ডলার ছিল, যা গত ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগের দামের কাছাকাছি। ফেব্রুয়ারিতে গড়ে দাম ছিল ৮৬ ডলার। জ্বালানি তেলের দাম আরো কমবে বলেই আমার ধারণা। আন্তর্জাতিক এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) গ্যাসোলিনের দাম আরো কমার পুর্বাভাস দিয়েছে। কারণ বিশ্বজুড়ে বিদ্যুচ্চালিত যানবাহন বেড়েছে। তাছাড়া তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে গ্রীষ্মের ছুটিতেও মানুষ কম বেড়াতে যাচ্ছে। আমেরিকায় গ্যাসোলিনের দাম প্রতি গ্যালন ডলার থেকে নেমে প্রায় আড়াই ডলার হয়েছে। পেট্রলের দাম অর্ধেক নেমে গেছে। স্বাভাবিকভাবে অন্যান্য জিনিসেরও দাম কমে গেছে। জুনে প্রতি ব্যারেল ডিজেলের দাম যেখানে ১৭০ ডলার ছিল, তা এখন ১৩৫ ডলার। যা আরো কমে আসবে। এর কারণ এক ধরনের ডিমান্ড ডিস্ট্রাকশন বা চাহিদার বিচ্যুতি।

তেলের মূল্যে চক্রাকার প্রকৃতি বিদ্যমান। যখন তেলের দাম অনেক বাড়ে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই এর ব্যবহার কমিয়ে দেয়। আবার নতুন নতুন অনেক সরবরাহকারী যোগ হয়, কারণ তারা মুনাফা করতে চায়। এভাবে সরবরাহের পরিমাণ বেড়ে যায়। কিন্তু চাহিদা কম থাকায় দাম কমতে শুরু করে। আবার একটা সময় পর তেলের দাম বেড়ে যায়। বারবার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ইতিহাসের দিকে তাকালেই যা আমরা দেখতে পাব।

তেলের বাজার পরিচালিত হয় অনুমানভিত্তিক। এখানে সবসময় যে চাহিদা-জোগান সমস্যা থেকে মূল্য বৃদ্ধি পায়, তা নয়। আমরা যদি এসব বিষয় বিবেচনায় নিই তাহলে মুহূর্তে বাংলাদেশে তেলের দাম বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতাই দেখি না। বৃদ্ধির নেপথ্যে আসল উদ্দেশ্য কী তা আমি জানি না। সরকার হয়তো মনে করছে তেলের মাধ্যমে গ্যাস বিদ্যুতের ভর্তুকির অর্থটা তুলবে, যা একটা কারণ হতে পারে। তবে সেটি হবে বড় ভুল। তবে আমরা তাদের আসল উদ্দেশ্যটা জানি না। আর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য সরকার যে কারণটা দেখাচ্ছে তাও বিশ্বাসযোগ্য নয়।

জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য সরকার জনগণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। আবার যখন দাম কমে যাচ্ছে, তখন  দাম না কমিয়ে মুনাফা অর্জন করছে এবং সেটা ব্যবহার করছে নিজের কাজে। সরকার যদি মুনাফা নিয়ে যায়, আর লোকসান জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়, তাহলে সেটি  ন্যায্য হলো না। পুরোপুরি শোষণমূলক ব্যবসা হয়ে যাচ্ছে। হাজার কোটি টাকা লোকসান করেছে বলে সরকার তার দায় জনগণের ওপর চাপাচ্ছে। আর ৪০ হাজার কোটি টাকা যখন লাভ করেছে, তখন সরকার সেটা নিয়ে গেছে, জনগণকে দেয়নি ধরনের প্রবণতা সঠিক নয়। ডলার বিনিময় হার, মুনাফা, ভর্তুকির সমন্বয় প্রভৃতি বিষয়ে স্বচ্ছ নীতিমালা থাকা দরকার।

অনেকেই বলছেন, জ্বালানি তেলে কর-ভ্যাট কমিয়ে দিলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না। আপনি কী মনে করেন?

জ্বালানি তেলে এখন আর শতাংশ হারে কর-ভ্যাট নেই। তেলের দাম যতই ওঠানামা করুক না কেন একটা স্থির কর-ভ্যাট আছে। আমি যতদূর জানি কর-ভ্যাট শতাংশ হিসেবে নেয়া হয় না। এখন কর-ভ্যাট কমিয়ে দিলে সরকারের রাজস্ব কমে যাবে। সেটা তখনই করা যায়, যখন ভর্তুকি বাদ দিয়ে জ্বালানির মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নির্ধারণ করা হয়, যা ভারত করছে। দেশটি আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে স্থানীয় বাজারে বাড়ায়; কমলে স্থানীয় বাজারেও কমায়। গত মার্চে বোধহয় তারা ১১বার দাম সমন্বয় করেছে। সেখানে আবগারি শুল্ক কত, অগ্রিম আয়কর কত, ভ্যাট কত সবকিছু  মূল্যহারে বিস্তারিত দেয়া আছে। সেখান থেকে ভারত সরকার প্রতি লিটারে টাকা আবগারি শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে। তারপর আবার টাকা কমিয়ে দিয়েছে, যাতে মানুষের ওপর চাপটা কম পড়ে। কিন্তু ভারত আর তেলে ভর্তুকি দিচ্ছে না, উচ্চ মুনাফাও করছে না। সরকার আয়টা কমিয়ে ফেলেছে। অথচ আমাদের দেশে যখন উচ্চমূল্য হয়, তখন আয়টা স্থির থাকে। বছরে বিপিসির গড়ে হাজার কোটি টাকা আয় হয়। এটি যদি বিপিসির কাছে থাকে, তাহলে এখন ভর্তুকি বাবদ যে হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে, তার প্রয়োজন হতো না। বিপিসির কোনো লোকসানও হতো না। এভাবে ভর্তুকি না দেয়া এবং সরকারের রাজস্ব কমে যাওয়া কিন্তু একই বিষয়।

প্রশ্ন হলো, আমরা যদি সবসময় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার সময় সামঞ্জস্য করি আর নিম্নমুখীতে না করি, বাকি যুক্তি যাই দেয়া হোক না কেন তাহলে তার কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। এখানে মূল যুক্তি হলো আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেছে। এটা হলো আসল কথা। ভারতে পাচার কিংবা অন্যান্য যুক্তি শুধুই ধূম্রজাল। আসল কথাই যদি এটা হয়, তাহলে পুরো লিঙ্কটা দেখতে হবে। আসলে প্রতি লিটারে কত খরচ হচ্ছে, পরিবহন খরচ কত হচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছার পর এর দাম কত হচ্ছে, তারপর ফিলিং স্টেশনে আসা পর্যন্ত দাম কত যোগ হচ্ছে, সেটা আমরা দেখতে চাই। সেটা দেখিয়ে দাম বাড়ানো হোক বা কমানো হোক তাতে আপত্তি নেই। তাতে মানুষের মধ্যে একটা বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হবে। এটি বিইআরসির মাধ্যমে গণশুনানিতে নির্ধারিত হলে ভোক্তাদেরও অংশগ্রহণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।

বলা হয়েছিল, অকটেন-পেট্রল আমদানি করতে হয় না। তাহলে দাম বাড়ানো হলো কেন?

অকটেন-পেট্রল আসলেই আমদানি করতে হয় না। ইস্টার্ন রিফাইনারিতে কিছু পেট্রল রূপান্তর করা হয় অকটেনে। আর অ্যাডিটিভ দিয়ে কিছু অকটেন তৈরি করা হয়। এছাড়া গ্যাস কনডেনসেট থেকেও পেট্রল আসে। কিছু অকটেন বাংলাদেশ আমদানি করে। কিন্তু অকটেনের মূল্যবৃদ্ধিটা মূলত ক্রস-সাবসিডির জন্য। ধনীদের কাছ থেকে বেশি রাজস্ব আহরণ করে ডিজেল, কেরোসিন বা অন্যান্য জায়গায় ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে।

এমনটা হলে ডিজেলের দাম এতটা বাড়ানো হলো কেন? অকটেনের দাম তো আরো বাড়ানো যেত?

অকটেনের সঙ্গে ডিজেলের কোনো সম্পর্কই নেই। অকটেন অর্থনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। বাংলাদেশে মাত্র পাঁচ লাখ টন পেট্রল-অকটেন ব্যবহার হয়। বিশ্ববাজারে অকটেনের চেয়ে ডিজেলের দাম বেশি। আমরা ৫০ লাখ টন ডিজেল ব্যবহার করি। সুতরাং ডিজেলের দাম বৃদ্ধি আমাদের দেশে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলবে। আমার কথা হলো, বাড়ানো-কমানো পুরো বিষয়টি যদি প্রকৃত মূল্যে করতে হয়, তাহলে অবশ্যই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। কী পরিমাণ ট্যাক্স দিচ্ছি না দিচ্ছি, সব দেখতে হবে। দাম নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে যে বলা হয়, বিপিসি বিপুল লোকসান করছে, আমি সেটা বিশ্বাস করি না। কারণ যখন মুনাফা করেছে তখন তো বলেনি মাসে মাসে ৫০ কোটি টাকা মুনাফা করেছি। তারা সম্পূর্ণ জবাবদিহিহীন। তাদের কোনো অ্যাকাউন্টিং নেই। এটা সরকারও রাখতে চায় না। বিপিসিও রাখতে চায় না। তারা অডিট করতেই চায় না। আইএমএফ ২০১৩ সালে বাংলাদেশকে বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল। তখন একটা শর্ত ছিল, পেশাদার অডিট টিম দিয়ে বিপিসির অডিট করাতে হবে। তবুও সরকার সেই শর্ত মানেনি। কারণ এখানে অনেক অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা রয়েছে। কাজেই বিপিসি যে সংখ্যাই বলুক না কেন তা বিশ্বাস করা কঠিন।

এলএনজির মতো জ্বালানি তেলও কি সরকার স্পট মার্কেট থেকে কেনে?

তেলের ক্ষেত্রে সরকার সবসময় স্পট মার্কেটের তেলই দেখে। ক্রুড অয়েলের ক্ষেত্রে আগে-পরে পাঁচদিনের গড় করে দামটা ঠিক করা হয়। সরকারের ক্রুড অয়েল কেনার পরিমাণ মাত্র ১৩ লাখ টন। আর ডিজেল এবং ফার্নেস অয়েল কেনা হয় যথাক্রমে ৫০ লাখ টন ৪০ লাখ টন। এটা আনুমানিক হিসাব। কোনো কোনো বছর ৪৬ লাখ টন ডিজেল কেনা হয়। কোনো কোনো বছর ৪৫ লাখ টনও হয়। ফার্নেস অয়েলও ৪০-৪৫ লাখ টনের মধ্যে থাকে। ৪০ লাখ টন ফার্নেস তেলের মধ্যে মাত্র ১০ লাখ টন বিপিসি আনে। বাকি ৩০ লাখ টন আনে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন প্রায় ৯০ লাখ টন ফার্নেস অয়েল আমদানি করে। এগুলো সব জিটুজি পারচেজ। জিটুজি পারচেজ মানে সরকার মালদ্বীপ থেকেও তেল কেনে। সেখানে কিন্তু কোনো রিফাইনারি নেই। যেহেতু বিপিসির নিয়মে বলা আছে জিটুজি পারচেজ হতে হবে, সেজন্য মালদ্বীপের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়। এটিকে বলা হয় রি-রাউটিং। মালদ্বীপ তেলটা অন্য কারো কাছ থেকে কিনে বাংলাদেশের বিপিসিকে সরবরাহ করে। মাঝখানে মালদ্বীপ কমিশন পায়।  বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস থেকে জ্বালানি তেল কেনে। সৌদি আরব, ওমান, কাতার থেকেও জ্বালানি তেল কেনে। আগে কয়েকটি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে কেনা হতো পরে পেট্রোনাস থেকেও কেনা শুরু করা হয়। কিন্তু তারা মূলত ক্রুড অয়েলেরই ব্যবসা করে। রকম আট-নয়টি দেশ আছে যাদের জাতীয় কোম্পানির সঙ্গে বিপিসির চুক্তি আছে। ওই দিনের স্পট এবং এক মাসের গড় দামের ফর্মুলার ভিত্তিতে দাম নির্ধারণ করা হয়।

সরকার যদি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে ফরোয়ার্ড মার্কেট থেকে জ্বালানি তেল কিনত, তাহলে কী দামের অস্থিতিশীলতা কিছুটা হলেও রোধ করা যেত?

হেজিং করলে দাম কিছুটা কমানো যেত। বাংলাদেশ এত বছর ধরে ক্রুড অয়েল কেনে, কিন্তু কখনো ক্রুড হেজিংয়ে যায়নি। কারণ দেশে বিশেষায়িত দক্ষতা নেই। ব্যাংকিং খাতেও নেই, বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতেও নেই। আন্তর্জাতিক বাজার সম্পর্কে ধারণা করতে পারে, ধরনের লোকের অভাবের বড় প্রমাণ পাওয়া গেছে এলএনজি ট্রেডিংয়ে। এলএনজি কেনার ক্ষেত্রে কাতার এবং ওমান দুটি দেশই বলেছে, তোমরা আরো বেশি ক্যাপাসিটিতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি কর। সরকার দেখল, স্পটে দাম চার ডলার। ফলে আমরা কেন আট ডলারের চুক্তি করতে যাব? কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের যেহেতু ঘাটতি আছে, ভিত্তি চাহিদায়ই পূরণ হয় না, সেহেতু সরকার কেন স্পট মার্কেটের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হবে? ভিত্তি চাহিদা পূরণ সবসময় দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে করা হয়। সব দেশেই এমনটা করা হয়। বাইরের সব কোম্পানি স্পট থেকে সবসময় কেনে না। তারা পিক ডিমান্ডের পাওয়ার কেনে, ইন্টারমিডিয়েট ডিমান্ডের পাওয়ার কেনে। এলএনজির ক্ষেত্রে হলো বৈশ্বিক চর্চা। আর বাকিটা বেজ ডিমান্ড। এটা লাগবেই। সেক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে যাওয়া উচিত। কিন্তু সরকার যে করেনি, সেটা হলো বোঝাপড়ার ঘাটতি। চুক্তি করার ব্যাপারে যদি আমাদের দক্ষতা নাও থাকে, তাহলে বহু এনার্জি কোম্পানি আছে তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করা যেত বা তাদের সহায়তা নেয়া যেত কীভাবে প্রাইস প্রটেকশন করে চুক্তি করা যায়। সরকার তা করিনি। আমরা দরকষাকষি এবং চুক্তি দুটি ক্ষেত্রেই দুর্বল। 

জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রেও কি হেজিং কিংবা দীর্ঘমেয়াদি একটা ভিত্তি নির্ধারণ করা যেত না। তাহলে আজকের অয়েল শকের শিকার হতে হতো না?

প্রথমত, এখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই। দ্বিতীয়ত, এখানে একটা ম্যাকানিজম রয়েছে যা আমাদের বুঝতে হবে। যেদিন তেলের দাম ১২০ ডলার হয়ে গেল, সেটা ডেলিভারি হবে আরো দুই মাস পর। এটা ফিউচার প্রাইস। আজকে তেলের দাম ৯০ ডলার দেখছি।  সেটি আজকে কিনতে গেলে ৯০ ডলার নাও হতে পারে। আজকে যেটা দেখা যাচ্ছে, সেটা ডেলিভারি হবে সেপ্টেম্বরে বা অক্টোবরে। অতি উচ্চমূল্যের জ্বালানি তেল যে আমরা একবার  কিনেছিতাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটা কখন বাংলাদেশে এসেছে তা আমরা জানি না। আজকে যদি তেলটা কিনে ফেলি সেটা ডেলিভারি হতে প্রায় ১৫ দিন বা মাস লেগে যাবে। আজকের যে প্রাইস দেখানো হচ্ছে, তা পারচেজের তারিখ থেকে বলা উচিত। এখানে অনেক জটিলতা রয়ে গেছে।

ভারত চীন রাশিয়ার সস্তা তেল কিনেছে। আমাদেরও কিনতে বলেছিল। আমরা কিনিনি। এটা কি কেনা উচিত ছিল না?

আসলে আমাদের ক্রুড অয়েল রিফাইনারি ক্যাপাসিটি অনেক কম। তাছাড়া রাশিয়ার তেল আমাদের রিফাইনারিতে প্রক্রিয়াজাত করে সর্বোত্তম সুবিধা পাওয়া যাবে না। অনেক অ্যাডজাস্টমেন্টও করতে হবে। বাংলাদেশের জ্বালানি রিজার্ভের সক্ষমতাও কম।

জ্বালানি তেল রিজার্ভের সক্ষমতা কী বাড়নো যেত না?

নিশ্চয়ই বাড়ানো যেত। এরই মধ্যে কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকার প্রায়ই চুক্তি করে ফেলেছিল, ইস্টার্ন রিফাইনারির সমান আরেকটা রিফাইনারি তৈরি করার। এছাড়া ব্যক্তি খাতের অনেকেও রিফাইনারি স্থাপনে আগ্রহী। কিন্তু কোনোটাই এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। কেন হয়নি, তা আমি জানি না। বিশেষ করে ডিজেলের জন্য তো আমাদের অবশ্যই মজুদ সক্ষমতা লাগবে। তবে অতিরিক্ত পেট্রল রফতানি করতে হবে।  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন