
সব প্রাণীর শরীর অসংখ্য ক্ষুদ্র কোষ দিয়ে তৈরি। এসব কোষ নির্দিষ্ট সময় পরপর মারা যায় এবং নতুন কোষ জন্ম নিয়ে পুরনো বা মৃত কোষগুলোর জায়গা দখল করে। নতুন কোষ জন্ম নেয়ার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিতভাবে এবং নিয়মমতো বিভাজিত হয়। কিন্তু দেহের কোষগুলো যখন কোনো কারণে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে তখনই ত্বকের নিচে মাংসের দলা অথবা চাকা দেখা যায়, যাকে টিউমার বলে। টিউমার দুই প্রকার, বিনাইন টিউমার ও ম্যালিগন্যান্ট টিউমার। এ দুই প্রকারের টিউমারের মধ্যে ম্যালিগন্যান্ট টিউমারকে ক্যান্সার বলে। এখন পর্যন্ত মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে এ রকম একশরও বেশি ধরনের ক্যান্সার রয়েছে।
বিশ্বজুড়ে মানব মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ক্যান্সার। বাংলাদেশে ফুসফুস, খাদ্যনালি, ঠোঁট-মুখগহ্বর, স্তন, সার্ভিক্স জরায়ু, পাকস্থলী, হাইপোফ্যারিংক্স বা নিম্ন গলার অংশ, অরোফ্যারিংক্স বা গলার মাঝের অংশ, গলব্লাডার, স্বরযন্ত্র, নন-হজকিন লিম্ফোমা, লিভার, ডিম্বাশয়, লিউকেমিয়া, কোলন, মলদ্বার, প্রস্টেট, মূত্রাশয়, থাইরয়েড, কিডনি, অগ্ন্যাশয়, মস্তিষ্কসহ অন্তত ৩৫টি ধরনের ক্যান্সার বিদ্যমান। সব ধরনের ক্যান্সারের মধ্যে ফুসফুস ক্যান্সারে মারা যায় সবচেয়ে বেশি।
গ্লোবোক্যানের ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর দেড় লাখেরও বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে পুরুষ রোগী ৮৮ হাজার ও নারী রোগীর সংখ্যা প্রায় ৬৯ হাজার। তাদের মধ্যে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার জনই মারা যাচ্ছে। সবশেষ পাঁচ বছরে দেশে মোট ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা রয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তথ্যমতে, এ সংখ্যা তার চেয়েও বেশি। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, প্রতি বছর দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে দুই-আড়াই লাখ মানুষ। যাদের মধ্যে চিকিৎসা নিতে পারছে মাত্র ৫০ হাজারের মতো। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছে ফুসফুস ক্যান্সারে। এর অন্যতম কারণ হলো রোগটির ভয়াবহতা, দেরি করে রোগ নির্ণয় হওয়া এবং সময়মতো বা সঠিকভাবে চিকিৎসা না নেয়া।
গ্লোবোক্যান জানিয়েছে, মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশে ফুসফুস ক্যান্সারের অবস্থান দ্বিতীয়। এ রোগে মারা যাচ্ছে বছরে ১২ হাজার ৩ জন, যা মোট ক্যান্সারে মৃত্যুর ১১ শতাংশ। তাদের মতে, খাদ্যনালি ক্যান্সারে মারা যাচ্ছে বছরে ২০ হাজার ৩১৯ জন। এরপর মুখগহ্বর, স্তন, পাকস্থলী ক্যান্সারে মারা যাচ্ছে বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৮ লাখ লোক মারা যায়। ক্যান্সারে মৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশই তামাক ও অ্যালকোহল সেবন, শাকসবজি ও ফল কম খাওয়া, শারীরিক পরিশ্রমের অভাবের কারণে হয়ে থাকে। আর ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্তদের ৯০ ভাগই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ তামাক সেবনকারী।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে মূলত পুরুষের ক্ষেত্রে ফুসফুস ও নারীর ক্ষেত্রে স্তন বা জরায়ুর ক্যান্সারের রোগী বেশি। ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ হলো তামাক ও তামাকজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার। এ ক্যান্সার হওয়ার ক্ষেত্রে এটি ৯০ ভাগ দায়ী। তামাক সেবনকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় একটি অংশ ধূমপান করে থাকে। এসব ধূমপায়ী ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকিতে তো থাকেই সঙ্গে অন্যরাও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে অধূমপায়ীদের মধ্যে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্তের হার ১৭ ভাগ।
রোগটির ভয়াবহতা এত বেশি যে এর বেশির ভাগ রোগীই মারা যাচ্ছে। দেরি করে রোগ নির্ণয়, সঠিক, সময়মতো চিকিৎসা না নেয়া এবং চিকিৎসার সংকটের কারণে এ ক্যান্সারে বেশি মৃত্যু হচ্ছে বলে মনে করেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যান্সার রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের দেশের ফুসফুস ক্যান্সার রোগীরা আক্রান্ত হওয়ার অনেক পরে আসে রোগ নির্ণয় করতে। রোগ নির্ণয়ের পর দেখা যায়, তাদের সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য তাদের রেডিওথেরাপি অথবা কেমোথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা দিতে হয়। কিন্তু বিপরীতে রোগীরা এ সেবাও পাচ্ছে না। কারণ দেশে রেডিওথেরাপির যন্ত্রও খুবই অপ্রতুল।
তবে দেশের আটটি বিভাগীয় পর্যায়ে বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতাল চালু হয়ে গেলে এ সংকট অনেকটা দূর হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন এ চিকিৎসক।
দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতাল জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির যন্ত্র রয়েছে মাত্র নয়টি। তার মধ্যে আবার আটটিই বিকল হয়ে পড়ে আছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পরও এ সেবা নিতে পারছে না রোগীরা। অন্যদিকে ঢাকা মেডিকেলে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির মাত্র তিনটি যন্ত্রের সবক’টিই নষ্ট। একই অবস্থা অন্যান্য সরকারি হাসপাতালগুলোয়। এতে রোগীদের সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হতে হয়।
আবার কেউ বেসরকারিতে যাচ্ছে সেবা নিতে। কিন্তু বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে এ সেবা থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা পদ্ধতি হওয়ায় এটির ব্যয়ও অনেক। এতে বেশির ভাগ রোগীই চিকিৎসার খরচ মেটাতে অক্ষম হয়ে পড়ে। ফলে অকালে প্রাণ হারায় তারা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ফুসফুস ক্যান্সার প্রতিরোধে সব তামাকজাতীয় দ্রব্য নিষিদ্ধের পাশাপাশি অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিহার ও পরিবেশে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া রোগটিকে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করতে পারলে এবং কার্যকর চিকিৎসা করা গেলে ফুসফুস ক্যান্সারের অনেক রোগীকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে।