দক্ষিণ এশিয়ার অবকাঠামো খাতে চীনের বিনিয়োগ ঝুঁকিতে

বণিক বার্তা ডেস্ক

শ্রীলংকা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট ভূরাজনৈতিক অর্থনৈতিকভাবে চীনকেও চাপে ফেলেছে। দুটি দেশেই বিপুল পরিমাণ ঋণ বিনিয়োগ রয়েছে চীনের। উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় বিভিন্ন প্রকল্পে এসব বিনিয়োগ করেছে বেইজিং। দেশ দুটির বর্তমান পরিস্থিতি এখন এসব বিনিয়োগকে অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। খর্ব হয়েছে চীনের ভূরাজনৈতিক প্রভাব। এর বিপরীতে দেশ দুটির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আইএমএফের ঋণ, যার সুবাদে দুই দেশেই চীনবিরোধী পশ্চিমা ব্লক এখন প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে।

শ্রীলংকা পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা এখন চীনের সামনে বাংলাদেশ নিয়ে ভাবার নতুন অবকাশ তৈরি করেছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। দক্ষিণ এশিয়ায় ঋণ হিসেবে চীনের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ পাকিস্তানে। এর পরই রয়েছে বাংলাদেশ। এদিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে শ্রীলংকা। আবার এসব বিনিয়োগের ঝুঁকিও এখন পাকিস্তান শ্রীলংকার পর বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি।

বিআরআইকে বিশ্বব্যাপী চীনের বাণিজ্যিক ভূরাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের এক উচ্চাভিলাষী উদ্যোগ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। উদ্যোগের আওতায় বিভিন্ন দেশের অবকাঠামো খাতে ঋণ সহায়তার মাধ্যমে বিনিয়োগ করে চলেছে চীন। সাম্প্রতিক এক প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২৭ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী বিআরআইয়ের আওতায় চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়াবে লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলারে। সব মিলিয়ে হাজার ৬০০টিরও বেশি প্রকল্পে বিআরআইয়ের আওতায় দেশটির মোট ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলারে। এখন পর্যন্ত বিআরআই উদ্যোগের অধীনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেয়া ঋণ সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো কিছু প্রকাশ করেনি চীন। তবে ওয়াশিংটনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আরডব্লিউআর অ্যাডভাইজরি গ্রুপ ২০১৩ সালের পর থেকে পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিআরআইয়ের অধীনে প্রায় ৪৬ হাজার ১০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ঋণ দেয়ার তথ্য পেয়েছে। বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের সুবাদে বিশ্বের ইতিহাসের বৃহত্তম উন্নয়ন উদ্যোগ হয়ে উঠেছে বিআরআই। কিছুদিন আগেই ওইসিডির মানদণ্ডের ভিত্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চীনা ঋণের ঝুঁকি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আরডব্লিউআর অ্যাডভাইজরি। এতে জানানো হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা ঋণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি পাকিস্তান শ্রীলংকায়। এদিক থেকে দেশ দুটির পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।

তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি শ্রীলংকা বা পাকিস্তানের পর্যায়ে যাবে না বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। তাদের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো এখানে রেমিট্যান্সসহ অর্থনীতির কিছু ঢাল রয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত বিপর্যয় ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হতে পারে। এছাড়া এখানকার পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়াটাও চীনা স্বার্থের পরিপন্থী। আইএমএফের ঋণের প্রয়োজনীয়তা এরই মধ্যে পাকিস্তান শ্রীলংকাকে পশ্চিমাদের মুখাপেক্ষী করে তুলেছে। এমনকি দেশটির সেনাপ্রধানও এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কাছে সহায়তা চাইছেন। দেশ দুটি পশ্চিমাদের যতটা মুখাপেক্ষী হচ্ছে, সেখানে চীনের প্রভাবও ততটাই কমছে। অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই চীন চাইবে না বাংলাদেশও কোনোভাবে পশ্চিমাদের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ুক। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর বাংলাদেশে আকস্মিক সফরের পেছনে এমন কোনো বিষয় কাজ করছে বলে অনুমান পর্যবেক্ষকদের।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০-২১-এর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৪-৭৫ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশকে প্রায় ৪৬৩ কোটি ২৪ লাখ ডলারের ঋণ ছাড় করেছে চীন। বর্তমানে দেশে চীনা অর্থায়নে সব মিলিয়ে বেশকিছু বড় প্রকল্প চলমান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সড়ক রেল যোগাযোগ এবং বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতেই চীনা বিনিয়োগ রয়েছে সবচেয়ে বেশি।

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে চীনা অর্থায়নে তৈরি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্প। হাজার ৪০০ মিটার দীর্ঘ টানেলটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা বহুমুখী সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন। প্রকল্পটিতে চীনা এক্সিম ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রায় ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। পটুয়াখালীর পায়রায় হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। রাজধানী ঢাকায় ডিপিডিসির বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ শক্তিশালীকরণ প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে ১১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। এছাড়া ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে চীনের অর্থায়ন রয়েছে ১০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা।

শুরু থেকেই চীনের বিআরআই উদ্যোগের বিরোধিতা করে এসেছে বেইজিংয়ের চিরবৈরী ভারত পশ্চিমা দেশগুলো। এসব দেশের বিশ্লেষকরাও উদ্যোগটি নিয়ে বরাবরই সন্দেহ পোষণ করে এসেছেন। তাদের অভিযোগ, বিআরআই বাস্তবায়ন করতে গিয়ে চীন বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে ঋণের ফাঁদে ফেলছে। এসব ঋণের সুদ বেশি। শর্তগুলোও অনেক কঠিন। আবার ঋণ পুনর্গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সুবিধাকে (যেমন প্যারিস ক্লাব অব বাইলেটারাল ক্রেডিটর্স) কাজে লাগানোরও কোনো সুযোগ থাকে না। এসব ঋণের আওতায় গৃহীত প্রকল্পগুলো গ্রহীতা দেশের স্থানীয় জনসাধারণের চেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ এলিটদেরই লাভবান করছে বেশি। একপর্যায়ে উচ্চসুদের বিপুল পরিমাণ ঋণ দেশগুলোকে চীনের কাছে জিম্মি করে ফেলছে।

তাদের দাবির সপক্ষে উদাহরণ হিসেবে বারবার শ্রীলংকাকে সামনে নিয়ে আসছেন তারা। দেশটিতে চীনা ঋণের প্রভাব নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বিতর্ক চলছে দীর্ঘদিন ধরে। বিতর্কটির পালে হাওয়া লাগে ২০১৭ সালে। ওই সময় চীনের ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেশটির কাছে হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেয় শ্রীলংকা। বিষয়টি আলোচিত হতে থাকে বিআরআইয়ের দুর্বল দিক হিসেবে। এরপর দিনে দিনে শ্রীলংকার পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গিয়েছে। রিজার্ভের অভাবে দেশটি এখন প্রয়োজনীয় খাদ্য, ওষুধ জ্বালানিও আমদানি করতে পারছে না। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে অক্ষম জানিয়ে দেশটি এরই মধ্যে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে দিয়েছে। পরিস্থিতির জন্যও চীনা ঋণের ফাঁদকেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করছে পশ্চিমা ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো।

যদিও চীন অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করছে। দেশটির বক্তব্য হলো চীন শ্রীলংকার সবচেয়ে বড় ঋণদাতা নয়। কলম্বোর মোট বৈদেশিক ঋণে চীনের অবদান মোটে ১০ শতাংশ। প্রায় সমপরিমাণ ঋণ দিয়েছে জাপানও। শ্রীলংকার মোট বৈদেশিক ঋণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অবদান ১৩ শতাংশ। দেশটি সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে আর্থিক বাজার থেকে। শ্রীলংকার মোট বৈদেশিক ঋণের ৪৭ শতাংশই উৎস থেকে এসেছে।

পাকিস্তানেও বিআরআইয়ের অংশ হিসেবে চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরে (সিপিইসি) বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে বেইজিং। বিশেষ করে দেশটির বিদ্যুৎ খাতে সিপিইসির আওতায় গৃহীত চীনা ঋণে অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রই দেশটির গোটা অর্থনীতিকে মারাত্মক চাপে ফেলে দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

তবে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা বারবার বলেছেন, এখানকার পরিস্থিতি কোনোভাবেই শ্রীলংকা বা পাকিস্তানের মতো হবে না। তাদের ভাষ্যমতে, দেশ দুটিকে এখনকার পর্যায়ে নিয়ে এসেছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ। শ্রীলংকা পাকিস্তানে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণহীন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। বাংলাদেশের জিডিপির অনুপাতে মোট বৈদেশিক ঋণের হার দেশ দুটির তুলনায় অনেক কম। এছাড়া প্রবাসীরাও দেশের অর্থনীতিতে প্রচুর পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, যা বাংলাদেশকে শ্রীলংকা বা পাকিস্তানের মতো বড় সংকট থেকে সুরক্ষা দেবে। বাংলাদেশে এখন যেসব সংকট দেখা যাচ্ছে, তা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চলমান সংকটের ধারাবাহিকতায়ই হচ্ছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে এসব সংকট কেটে যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন