পরিকল্পনা

ড্যাপে উপেক্ষিত শিল্প স্থাপনা ও টেকসই উন্নয়ন

মো. মাহামুদুর রহমান

বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০১৬-৩৫ ঢাকা শহরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল। যেকোনো শহরের উন্নয়নকাজ নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পিত উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আজ আমি আলোচনা করব, ঢাকার শিল্পোন্নয়নে ড্যাপের প্রভাব টেকসই উন্নয়নের মাপকাঠিকে শিল্প ক্ষেত্রে এর গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে।

এক নজরে আমরা ড্যাপের প্রধান প্রস্তাবগুলো যদি দেখি প্রথমেই ড্যাপে প্রস্তাব করা হয়েছে, নগর জীবন রেখা শিরোনামে যেখানে ৫৭৪ কিলোমিটার জনপথকে নগর জীবন দেখা আঙ্গিকে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এরপর তারা স্কুলভিত্তিক উন্নয়নের কথা বলেছেন, যেখানে ৬২৭টি বিদ্যালয় এবং ২৮৭টি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রস্তাব আছে, যার প্রস্তাবিত ব্যয় ২৯ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া ছয়টি অঞ্চলে পাঁচটি আঞ্চলিক পার্ক ৪৯টি জলকেন্দ্রিক পার্ক আটটি ইকো পার্কের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার প্রতিটির পরিমাণ ১০ একর থেকে ৬৮০ একর। গণমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যেখানে হাঁটার পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য হাজার ১৯৮ কিলোমিটার নগর জীবন রেখা বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে। জলপথে ৫৭৪ কিলোমিটার যান্ত্রিক যানবাহন চলাচলের পথ হিসেবে হাজার ২৩৩ কিলোমিটারের প্রস্তাব করা হয়েছে। ড্যাপে সমন্বিত ভূগর্ভস্থ ইউটিলিটি ডাক্টের প্রস্তাব করা হয়েছে। কৃষিজমি/বন্যা অববাহিকা অঞ্চল ব্যবস্থাপনার প্রস্তাব ড্যাপে করা হয়েছে। [রেফ: বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০১৬-৩৫), খণ্ড-, পৃষ্ঠা-]

বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনাটি ২০ বছর মেয়াদের (২০১৬-৩৫) জন্য প্রস্তাবিত হয়েছে, তবে একে প্রতি পাঁচ বছরে হালনাগাদ পরিমার্জনের সুপারিশ রয়েছে। কিন্তু ড্যাপের মৌলিক পরিকল্পনায় শিল্প বা অর্থনৈতিক উন্নয়নে তেমন কোনো জোরাল প্রস্তাব চোখে পড়েনি।

এখানে বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের মধ্যে ৩৯তম এবং ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) ২৯তম যা দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়। বাংলাদেশ গত এক দশক ধরে গড়ে দশমিক ৩০ শতাংশ ধরে রেখে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং বর্তমানে বিশ্বের সপ্তম দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতি। বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষি থেকে উৎপাদনমুখী শিল্পে পরিবর্তনশীল অর্থনীতি। বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ হচ্ছে রেমিট্যান্স তৈরি পোশাক শিল্প।

ঢাকা শহরের আয়তন একসময় অল্প ছিল যার চারপাশের এলাকাগুলো গড়ে উঠেছিল শিল্প এলাকা হিসেবে। তেজগাঁওকে একসময় শিল্প এলাকা বলা হতো, বর্তমানে শিল্প এলাকা অবস্থানের দিক থেকে রাজধানীর কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। শুধু তেজগাঁও নয়, ঢাকা শহরে আরো শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে, যা ঢাকা শহরসহ সারা দেশের চাকরির বাজার এবং বিশ্ববাজারে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে। তবে ড্যাপে প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার পরিমাণ শিল্পপ্রধান মিশ্র অঞ্চলে মাত্র দশমিক ৯০ শতাংশ এবং ভারী শিল্প এলাকায় মাত্র দশমিক ৬৩ শতাংশ। আশুলিয়া, বাইপাইল, কোনাবাড়ী, মধুপুর, টঙ্গীসহ আরো কয়েকটি এলাকা ড্যাপে প্রস্তাবিত শিল্পাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

পুরো ড্যাপ ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, শিল্প অর্থনৈতিক দিকে ড্যাপের প্রস্তাব খুবই কম। ঢাকা শহরের বিদ্যমান শিল্প-কারখানাগুলো যেখানে বর্তমানে লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান, সেগুলোকে নিয়েও ড্যাপের প্রস্তাবনা নেই বললেই চলে অথচ বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ পরিবেশবান্ধব শিল্প-কারখানাগুলো আমাদের বাংলাদেশেই গড়ে উঠছে।

পরিকল্পনা জোরাল না থাকলেও ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ড্যাপের কিছু বিধিনিষেধ দেয়া আছে শিল্প-কারখানা বা বৃহৎ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে যা কতটুকু যুক্তিসংগত তা বোঝা বড় ভার। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার গঠন (.) অংশে ড্যাপের দুটি স্বতন্ত্র অংশের কথা উল্লেখ আছে। সেগুলো হলো . উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা . কর্মপরিকল্পনা।

অংশে ব্যক্তিগত কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো উন্নয়ন উদ্যোগের ব্যবস্থাপনা কীভাবে হবে, সে প্রক্রিয়াগত পদ্ধতি বলা আছে। এটি মূলত একটি বিধির মতো কাজ করবে। এর মাধ্যমে কেউ কোন জমিতে বাড়ি, কারখানা কিংবা অন্য কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে চাইলে তার ধরন নির্ধারণ এবং তার ভূমি ব্যবহার অনুমোদন অংশের নীতিমালা মেনেই নিতে হবে। 

ড্যাপের ভূমি ব্যবহার এলাকা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (.), অধ্যায় ..-অবস্থানে (...) বলা হয়েছে, অবকাঠামো চলতি স্বতঃস্ফূর্ত উন্নয়নভিত্তিক এলাকাগুলোর মধ্যে শিল্পাঞ্চল এর প্রভাব বলয় এলাকা এবং প্রকল্প/উদ্যোগভিত্তিক এলাকাগুলোর মধ্যে সরকারি/বেসরকারি ইপিজেড/অর্থনৈতিক অঞ্চল/শিল্প এলাকা সংলগ্ন এলাকাগুলো শিল্প ক্ষেত্রের নগর এলাকা হিসেবে চিহ্নিতকরণের নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। এছাড়া ঢাকা শহরের এলাকা সময়ে সময়ে রাজউক কর্তৃক বর্ধিত করার সঙ্গে সঙ্গে বর্ধিত এলাকার বড় একটি অংশ যেখানে মূলত বিভিন্ন শিল্প-কারখানা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থানকে ঘিরে গড়ে উঠেছে, সেসব এলাকার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এদের আরেকটি স্বতন্ত্র ভূমি ব্যবহার জোন মিশ্র ব্যবহার এলাকা (শিল্পপ্রধান) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু শিল্পপ্রতিষ্ঠান যখন একটি বা একাধিক ভবন হিসেবে ব্যক্তিমালিকানায় গড়ে উঠে বর্তমানে বিদ্যমান আছে সে সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা ড্যাপে দেয়া হয়নি।

এছাড়া ড্যাপে শিল্পাঞ্চল নির্ধারণে মূলত বর্তমান ব্যবহার সম্প্রসারণ প্রবণতাকে বিবেচনা করে বিদ্যমান প্রস্তাবিত ইপিজেড, বিসিক এলাকা/ইকোনমিক জোন এবং সরকারি-বেসরকারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটগুলো ভারী শিল্পাঞ্চলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কিন্তু এতে করে এরই মধ্যে বিদ্যমান ব্যক্তিমালিকানায় একক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট কথা বলা নেই। ঢাকা শহরে প্রচুর ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে, যা ড্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি এবং ড্যাপের ল্যান্ড ইউজ প্যাটার্ন ম্যাপে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিদ্যমান শিল্পপ্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখানো প্রয়োজন। শিল্পপ্রধান মিশ্র অঞ্চলের বিবরণে শুধু ক্ষুদ্র কুটির শিল্প পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শর্তসাপেক্ষে অনুমতি দেয়ার কথা বলা হয়েছে ড্যাপে, যেখানে জমি এবং কারখানা ভবন ছাড়া অন্যান্য স্থায়ী সম্পদের মূল্য সর্বোচ্চ দশমিক ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারবে। এখানে বলে রাখা ভালো, অনেক আধুনিক মেশিন বর্তমানে রয়েছে, বাজারে যার এককালীন ব্যয় একটু বেশি কিন্তু চলমান ব্যয় অনেক কম এবং এসব মেশিন পরিবেশবান্ধব। তাছাড়া বিভিন্ন দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষার জন্য যেসব অ্যাকটিভ প্যাসিভ প্রটেকশনের দরকার হয় সে সব ব্যবস্থাপনার ব্যয়টিকেও বাদ দেয়ার দরকার দশমিক ৫০ কোটি টাকার শর্ত থেকে। (যেমনঅগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জাম) তাছাড়া একে দশমিক ৫০ কোটিতে আটকে না দিয়ে ন্যূনতম কোটি টাকা করা হলে কিছু মডার্ন স্থাপনা আমরা ঢাকা শহরে দেখতে পাব যেখানে পরিবেশগত, সামাজিক অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রেই সুবিধা হবে, যা টেকসই উন্নয়নের মূল ভিত।

ড্যাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে শিল্প ভবনগুলোকে সর্বনিম্ন ৫০ মিটার দূরত্বে থাকতে হবে বলে শর্তারোপ করা হয়েছে। অথচ একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান যখন কোনো মিশ্র এলাকায় হয়, তা আকারে ছোট হয় এবং দূষণের পরিমাণ কম হয়, তাহলে শর্ত ঢাকা শহরের মতো একটি ঘনবসতি এলাকার জন্য কতটুকু যুক্তিসংগত তা পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।

ভারী শিল্প এলাকার সংজ্ঞা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের ১৯৯৭ সালের বিধিমালা (সর্বশেষ সংশোধন ২০১৭) অনুযায়ী কমলা বি লাল শ্রেণীভুক্ত শিল্পকে বোঝানো হয়েছে যেখানে পুকুর, খাল, লেক নদী এলাকায় থাকতে পারে। ড্যাপে কিছু ক্ষেত্রে নদীতীরবর্তী এলাকা, যেখানে এরই মধ্যে কিছু এলাকা শিল্পাঞ্চল হিসেবে আছে, সে এলাকা তার সংলগ্ন এলাকা ভারী শিল্পাঞ্চল হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে করে ভবিষ্যতে নদীর বাস্তুসংস্থানের ক্ষতির ব্যাপক সম্ভাবনা আছে এবং নদী দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হবে এটি। বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন এর বিরোধিতা করেছে। কারণ, তাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তারা এর কুফলগুলো অনুধাবন করতে পেরেছে, যা ড্যাপ প্রণয়নকারীরা এখনো পারেননি। পেশাজীবীদের ধরনের আপত্তির ফলে রাজউক কর্তৃক নিশ্চিত করা হয়েছে ড্যাপে নদীর সীমানা থেকে ৫০ মিটার বাফার করে ফরসোর বা তীরবর্তী এলাকা আলাদা করা হবে, যেখানে কোনো নির্মাণ করা যাবে না এবং ভারী শিল্প এলাকা নদীর পাড়ে করা যাবে না। কিন্তু ওই ৫০ মিটার জায়গায় কী করা হবে, তার কোনো নির্দিষ্ট ব্যবহারের কথা বলা হয়নি। পেশাজীবীদের সঙ্গে রাজউকের ড্যাপ প্রতিনিধি দল দফায় দফায় ড্যাপ রিভিউ মিটিংগুলোয় নিশ্চিত করেছে তারা কিছু কিছু জায়গায় শিল্প স্থাপনা করতে দেবে কিন্তু তা বাফার এলাকাসহ। বিদ্যমান যেসব শিল্প এলাকা নদীতীরবর্তী এলাকায় রয়েছে সেগুলোকে অবৈধ বলে দিয়ে প্রস্তাবনা দেয়া যাবে না, তবে এক্ষেত্রে সেসব বিদ্যমান শিল্প-কারখানাগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।

একটি দেশের অর্থনীতিতে শিল্প-কারখানার ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও শিল্প-কারখানার উন্নয়ন সাধন এবং এর সঠিক অবস্থান নির্বাচন করে পরিবেশগত, সামাজিক প্রেক্ষাপট অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক স্থানীয় আইন-কানুন মেনে একটি শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হয়। ঢাকা শহরের জন্য ড্যাপ যেমন জরুরি, ঠিক তেমনি ঢাকার অর্থনৈতিক চাকাকে সচল রাখতে জরুরি শিল্প স্থাপনা, যেটিকে খুবই নগণ্যভাবে চিন্তা করা হয়েছে ড্যাপে। ঢাকা শহরকে যদি অর্থনৈতিকভাবে আরো স্বাবলম্বী করার কথা চিন্তা করা হয়, তাহলে ঢাকার জন্য দরকার এর প্যারিফেরিতে শিল্প এলাকা নির্ধারণ এবং ঢাকার আশপাশের অঞ্চলগুলো সঙ্গে নিয়ে ইকোনমিক জোনের জন্য সমন্বিত মহাপরিকল্পনার। তা না হলে প্রস্তাবিত ড্যাপ অনুযায়ী শিল্প ক্ষেত্রে ঢাকায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন কম হবে এবং ঢাকার আশপাশে যেসব কৃষিজমি আছে তা সব শিল্প-কারখানায় ভরে উঠবে, যা ভবিষ্যতে আমাদের দেশের টেকসই উন্নয়নের সুযোগকে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর সমস্যা থেকে পরিত্রাণে প্রয়োজন রাজউকের পাশাপাশি আইএবি, আইইবি, পরিবেশবিধ, পরিকল্পনাবিধ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপক, বিজিএমইএ, এফবিসিসিআই, কৃষিবিধসহ বিভিন্ন পেশাজীবী উন্নয়ন সহায়ক সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বিত প্রচেষ্টায় একটি টেকসই সর্বজনীন গৃহীত সমন্বিত মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা।

 

মো. মাহামুদুর রহমান: স্থপতি

পরিবেশবিদ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন