কমনওয়েলথ গেমস

খেলা ছাড়তে চাওয়া সেই ম্যাককিওনেরই পদকের রেকর্ড

ক্রীড়া ডেস্ক

লন্ডন অলিম্পিকে সুযোগ না পেয়ে হতাশা থেকে খেলাই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। বার্মিংহাম কমনওয়েলথের আগেও অবসরের ভাবনা আসে তার মনে। সেই এমা ম্যাককিওন কমনওয়েলথ গেমসে গড়লেন ইতিহাস ছবি: এপি

অস্ট্রেলিয়ান সাঁতারু এমা ম্যাককিওন প্রতিনিয়তই নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। পাঁচবারের অলিম্পিক স্বর্ণজয়ী তারকা চলতি বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসে একের পর এক নতুন ইতিহাস গড়েছেন। বহুজাতিক আসরে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণপদক সবচেয়ে বেশি পদকের রেকর্ডটা এখন শুধুই তার দখলে।

গত মঙ্গলবার রাতে ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে ব্রোঞ্জ জিতে ইতিহাস ছুঁয়ে ফেলেন সুপার ফিশ খ্যাত ম্যাককিওন। দক্ষিণ আফ্রিকার শাদ লে ক্লোস, শুটিং তারকা মাইকেল গাল্ট ফিল অ্যাডামের সমান ১৮টি পদক জয় করেন তিনি। ওই রাতে ১০০ মিটার মিশ্র রিলেতে স্বর্ণ জয় করে তিনি ছাড়িয়ে যান সবাইকে। পরদিন মেয়েদের ১০০ মিটার মিডলে রিলেতেও স্বর্ণ জয় করেন। এটা চলতি আসরে তার ষষ্ঠ গেমসের ইতিহাসে ১৪তম স্বর্ণপদক। সব মিলিয়ে কমনওয়েলথ গেমসে তার পদকসংখ্যা এখন সর্বোচ্চ ২০। সুসি নিল ১০টি স্বর্ণসহ ১৫টি পদক জিতে অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে তার পরেই অবস্থান করছেন। এছাড়া গেমসে ১০টি করে স্বর্ণ জয়ের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন ইয়ান থর্প লাইজেল জোনস।

বার্মিংহাম গেমসে ম্যাককিওন জিতলেন আটটি পদক। ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ৫০ মিটার বাটারফ্লাই, ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলে, ১০০ মিটার মিডলে রিলে, ১০০ মিটার মিশ্র ফ্রিস্টাইল রিলে, ১০০ মিটার মিশ্র মিডলে রিলেতে স্বর্ণ এবং ১০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে রৌপ্য ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে ব্রোঞ্জ জয় করেন ম্যাককিওন। সাফল্য নিয়ে তিনি বলেন, আমি গর্বিত। আমরা যেজন্য অনুশীলন করি, পদক তারই পুরস্কার। কিন্তু সবচেয়ে বড় পুরস্কার হচ্ছে সারা বছরের পরিশ্রমের ফল এই এক সপ্তাহে পাচ্ছি আমি।

কমনওয়েলথ গেমসে ইতিহাস গড়া ম্যাককিওন অলিম্পিকেও উজ্জ্বল। ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিক ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিকে পাঁচটি স্বর্ণ, দুটি রৌপ্য চারটি ব্রোঞ্জ পদক জিতেছেন ২৮ বছর বয়সী সাঁতারু। ম্যাককিওনই অস্ট্রেলিয়ার সফলতম অ্যাথলিট। টোকিওতে চারটি স্বর্ণ তিনটি ব্রোঞ্জ জিতেছেন, যা মাত্র দ্বিতীয় নারী হিসেবে এক অলিম্পিয়াডে সাতটি পদক জয়ের রেকর্ড। মাত্র দুজন পুরুষ অ্যাথলিটের এক আসরে আটটি করে পদক জয়ের কীর্তি আছে।

এছাড়া বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে চারটি স্বর্ণসহ মোট ১৭টি পদক এবং প্যান প্যাসিফিক চ্যাম্পিয়নশিপে চারটি স্বর্ণসহ সাতটি পদক জিতেছেন ম্যাককিওন।

অস্ট্রেলিয়ান তারকাদের মধ্যে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ২৬টি স্বর্ণসহ ৭০টি পদক জিতে শীর্ষস্থানে এমা ম্যাককিওন। ২৯টি স্বর্ণপদকসহ ৫৬টি পদক নিয়ে সাঁতারু সুসি নিল দ্বিতীয়, ২২টি স্বর্ণসহ ৫০টি পদক নিয়ে লাইজেল জোনস তৃতীয় ৪৬টি স্বর্ণসহ ৫৬টি পদক নিয়ে চারে ইয়ান থর্প।

যদিও বিশ্ব তারকাদের মধ্যে শীর্ষে মাইকেল ফেলপস। আমেরিকান সাঁতার গ্রেট ৬৯টি স্বর্ণসহ জয় করেছেন ৯৪টি পদক।

সাঁতারে মোট ১২টি রেকর্ড ভেঙেছেন ম্যাককিওন। এর মধ্যে ফিনায় ৩টি, কমনওয়লথ গেমসে ৬টি অলিম্পিকে তিনটি রেকর্ড ভেঙেছেন তিনি।

এমার রক্তেই সাঁতার। বাবা রন সাবেক অলিম্পিয়ান কমনওয়েলথ গেমসে চারবারের চ্যাম্পিয়ন। তার মা সুসি ম্যাককিওন আর চাচা রব উডহাউজও অস্ট্রেলিয়ার হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। কয়েক দশক ধরে ম্যাককিওন পরিবার ইলাওয়ারায় সুইমিং স্কুল পরিচালনা করে আসছে। এমা ম্যাককিওন যখন হাঁটাও শেখেননি, তখনই তাকে সুইমিং পুলে নামানো হয়!

২০১৭ সালে উঠতি তারকা হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে লড়েন ১৭ বছর বয়সী ম্যাককিওন, যা ছিল লন্ডন অলিম্পিকেরও ট্রায়াল। ম্যাককিওন সেবার ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলেতে কোয়ালিফাই করার আশা করছিলেন। কিন্তু বাছাইয়ে সপ্তম হয়ে স্বপ্নভঙ্গ হয় তার, সেবার লন্ডনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা হয়নি। তখন খেলাই ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছিলেন। সেই ম্যাককিওন এখন অলিম্পিক কমনওয়েলথ গেমসে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অমরত্ব অর্জনের পথে।

স্মৃতিচারণ করে ম্যাককিওন বলেন, লন্ডন অলিম্পিকের টিকিট না পেয়ে আমি সত্যিই খুব মর্মাহত হই এবং ট্রায়ালের পর কিছুদিন খেলা বন্ধও রাখি। আমি অলিম্পিকে যেতে চেয়েছি, তবে এজন্য আরো চার বছর অপেক্ষা করতে চাইনি। কাজেই তখন অন্য রকম ভাবনা মনে আসে।

ম্যাককিওন খেলাটা প্রায় ছেড়েই দিচ্ছিলেন। যদিও তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন খেলা আর তার জাতির জন্য একটি উপহার হয়েই আসে। মাত্র ১২ মাস পরই পদক আসা শুরু করে। ১০০ মিটার রিলেতে রৌপ্য জয় করেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে। ওই ইভেন্টে তাদের হারিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। যদিও পদকের রঙ বদলাতে সময় লাগল না। ২০১৪ সালের গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমসে আধিপত্য করলেন ম্যাককিওন, জিতলেন চারটি স্বর্ণ দুটি ব্রোঞ্জপদক।

রিওতে একটি স্বর্ণ, দুটি রৌপ্য একটি ব্রোঞ্জপদক জয় করেন ম্যাককিওন। ২০১৮ সালে নিজ দেশের গোল্ডকোস্ট কমনওয়েলথ গেমসে দারুণ সফলতা পান তিনি: জয় করেন চারটি স্বর্ণ দুটি ব্রোঞ্জ।

ফ্রিস্টাইলের রানী বলা হলেও ম্যাককিওন আসলে সব্যসাচী এক সাঁতারু। বাটারফ্লাইয়ে তিনি বিশ্বমানের, রিলেতেও বিশ্বস্ত নাম। সাঁতারে তাই অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক সাফল্যের অন্যতম কাণ্ডারি হয়ে উঠেছেন তিনি।

এর পরও শান্ত স্বভাবের হওয়ার কারণে ডন ফ্রেজার, শেন গোল্ড, ইয়ান থর্প, সুসি নিল, লাইজেল জোনস, গ্র্যান্ট হ্যাকেট কিংবা কিয়েরান পারকিনসের মতো আলোচনায় ছিলেন না তিনি। যদিও টোকিও অলিম্পিকের পর পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। টোকিওতে সাতটি পদক জিতে এক অলিম্পিক আসরে তিনি সফলতম অস্ট্রেলিয়ানের গৌরব অর্জন করেন। এবার বার্মিংহামে তিনি গেমসের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ জয়ের পর সবচেয়ে বেশি পদক জয়ের রেকর্ডটাও নিজের করে নিলেন। নিশ্চিতভাবেই এখন আর তার গ্রেটনেস নিয়ে কারো কোনো সংশয় থাকবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন