জ্বালানি সংকট

১২ ঘণ্টা উৎপাদন বন্ধ থাকে টাইলস কারখানায়

তোফাজ্জল হোসেন

করোনা মহামারীতে অর্থনৈতিক অভিঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চলমান বৈশ্বিক মন্দা ভাব কাটিয়ে অর্থনীতিকে সচল রাখতে ব্যয় সংকোচন নীতিতে হাঁটছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় জ্বালানি ব্যবহার কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। রোস্টার করে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে চলছে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের চেষ্টা। নিয়ম করে বন্ধ রাখা হচ্ছে গ্যাসের সরবরাহ। আর এতে ভয়াবহ সংকটের মধ্যে পড়েছে পুরোপুরি গ্যাসনির্ভর টাইলস, টেবিলওয়্যার স্যানিটারিওয়্যার পণ্যের কারখানাগুলো।

দেশের সিরামিক খাতকে আমদানি করা সিরামিক পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতেও রয়েছে প্রতিযোগিতা। এখন গ্যাস সংকটের কারণে উল্টো উৎপাদন বিঘ্ন খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি কমছে পণ্যের মান। এতে দেশীয় সিরামিক কারখানাগুলোকে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রূপগঞ্জ নরসিংদীতে দুটি সিরামিক কারখানা রয়েছে বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) প্রেসিডেন্ট মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লার। নানা সংকটের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি শতভাগ গ্যাসনির্ভর। অন্য কোনো জ্বালানি দিয়ে এটি চালানো সম্ভব না। অথচ গত দু-তিন মাস গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছি ১২ ঘণ্টা করে। বাকি সময় গ্যাস না থাকায় কারখানার উৎপাদনকাজ পুরোপুরি বন্ধ রাখতে হচ্ছে। আর একবার চুল্লি বন্ধ করলে সেটি চালু করতে দু-তিনদিন সময় লাগে। এখন প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা গ্যাস না পেলে কারখানা চালানো সম্ভব নয়। আবার গ্যাসের চাপ অনুমোদিত হার থেকে কমে গেলে সব পণ্য নষ্ট হয়ে যায়। গত বছর গ্যাসের চাপ কম থাকায় পণ্যের মানও খারাপ হয়েছে। তখন আন্তর্জাতিক দেশের বাজারেও আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাই। অনেক নামিদামি বিদেশী কোম্পানি অর্ডার বাতিল করে।

বিসিএমইএর তথ্যমতে, দেশের সিরামিক খাতে দেশী-বিদেশী মোট বিনিয়োগ প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হার প্রায় ৪০০ কোটি টাকা, স্থানীয় বাজারে বিক্রির পরিমাণ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর দেশীয় বাজারে প্রায় ৮০ শতাংশই দেশে উৎপাদিত সিরামিক পণ্য। খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হাজার কোটি টাকারও বেশি এবং গ্যাস বিল বাবদ উৎপাদকরা পরিশোধ করেন হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি। গত ১০ বছরে ২০০ শতাংশ বিস্তৃতি লাভ করা খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের, যার মধ্যে নারীকর্মী ২০ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে সিরামিক পণ্য রফতানি করা হয়।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে গ্যাসের চাপ কম থাকায় খাতের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সিরামিক শিল্প উৎপাদনে গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই প্রয়োজন হয়, কিন্তু সেখানে কখনো কখনো পিএসআই বা তার নিচে নেমে যেত। অথচ গ্যাসনির্ভর প্রসেস ইন্ডাস্ট্রিতে পণ্য প্রস্তুত করতে কিলন বা চুল্লিতে ফায়ারিং করার কারণে ২৪ ঘণ্টাই নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস সরবরাহ থাকতে হয়। নির্দিষ্ট মাত্রায় গ্যাসের চাপ না থাকলে কোনোভাবেই চুল্লির অভ্যন্তরে উৎপাদন কার্যক্রম চালু রাখা সম্ভব নয়। এখন ১২ ঘণ্টা পুরোপুরি গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় কারখানা মালিকরা পড়েছেন মহাসংকটে।

সিরামিক শিল্প মালিকরা বলছেন, গত ১০ বছরে গ্যাসের দাম বেড়েছে বহুগুণ। ফলে খাতে ব্যয় বেড়েছে। এতে করে দেশীয় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দাম কমিয়ে বাজার ধরার জন্য উৎপাদন ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেন ব্যবসায়ীরা। তাতে কাজ হারানোর ঝুঁকিতে পড়েন অনেক শ্রমিক। কিন্তু বর্তমানে যে গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে, তাতে শিল্পটিকেই টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তাই সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে অচিরেই এটি একটি রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হবে। বেকার হয়ে পড়বেন খাতের অন্তত পাঁচ লাখ লোক।

দেশে সিরামিক পণ্যের উৎপাদক মার্কো পলো গ্রুপের পরিচালক আজিজুল হাকিম সুমন বলেন, আমরা দুটি কারখানায় প্রায় ২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। গ্যাস সংকটের কারণে জেনারেটর দিয়ে ক্লিন চালু রাখছি, যাতে পরবর্তী ১২ ঘণ্টা যখন গ্যাস থাকবে তখন কারখানা চালু করা যায়। এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে অনেক। সেই সঙ্গে পণ্যের মানও অনেক কমে যাচ্ছে। অনেক পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কয়েকদিন পর উৎপাদন একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে।

দেশে বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক প্রায় সাড়ে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে হাজার থেকে হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা হতো। বর্তমানে গ্যাসের দেশীয় উৎপাদন দৈনিক হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি। এর বাইরে মধ্যপ্রাচ্য, কাতার, ওমান থেকে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট আমদানি করে গ্রিডে যুক্ত করা হয়। এছাড়া ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট স্পট মার্কেট থেকে দাম বুঝে আমদানি করা হতো। কিন্তু বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধির কারণে স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কেনা বন্ধ রয়েছে জুলাই থেকে। ফলে সরবরাহ কমানো হয় শতাংশের মতো। সরকার অবশ্য বলছে, উৎপাদনমুখী কারখানাকে অগ্রাধিকার দিয়ে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক . বদরূল ইমাম বলেন, বর্তমানে যে সংকট চলছে সেটি আমরা নিজেরা তৈরি করেছি। জ্বালানি সংকটের কারণে সমস্যা দিন দিন আরো বাড়বে। কারণ আমরা আগে সমস্যা নিয়ে চিন্তা করিনি। আমাদের অনেক গ্যাস ফিল্ড রয়েছে। সেগুলো খনন করা হয়নি, অনুসন্ধানও করা হয়নি। গত ২০ বছরে দেশে মাত্র ২৫টি কূপ খনন করা হয়েছে। অর্থাৎ বছরে মাত্র একটি কূপ খনন করা হয়েছে। তাই এখন সংকট কাটাতে হলে গ্যাস কূপ খনন করতে হবে। এর বিকল্প নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন