পেলোসির তাইওয়ান সফরে এশিয়ার চিপ বাজারে অস্থিরতা

সাবিদিন ইব্রাহিম

তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট, টিএসএমসির সহপ্রতিষ্ঠাতাসহ সেমিকন্ডাক্টর খাতের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি ছবি: ফেসবুক

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি একদিনের সফরে সম্প্রতি তাইওয়ান আগমন করেছেন। ২৫ বছরের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের কোনো মার্কিন রাজনীতিবিদের তাইপে সফরকে কেন্দ্র করে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এতে স্মার্টফোন, পিসিসহ শিল্পোৎপাদন খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ চেইন সচল থাকার বিষয়টি নিয়ে অনিশ্চয়তা আরো বেড়েছে। বৈশ্বিক চিপ উৎপাদনের ৭৫ শতাংশ হিস্যা এখন পূর্ব এশিয়ার। সবচেয়ে অগ্রসর চিপের ৯০ শতাংশ তৈরি হচ্ছে তাইওয়ানে। করোনা পরিস্থিতিতে সরবরাহ চেইন সংকট এবং তাইওয়ান নিয়ে চীনের পলিসি দীর্ঘদিন ধরেই উদ্বেগের বিষয় ছিল। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ যখন বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বাড়াচ্ছে এবং সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত করছে তখন পেলোসির তাইওয়ান সফর আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে।

পেলোসির সফরকে ঘিরে ওয়াশিংটন বেইজিংয়ের উত্তেজনার পারদ ঊর্ধ্বমুখী। গতকাল মার্কিন হাউজ স্পিকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বেইজিং। ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা নিয়ে সবচেয়ে মাথাব্যথা শীর্ষ চিপ নির্মাতা কোম্পানি টিএসএমসির। বিশ্বের অগ্রসর চিপের সিংহভাগই সরবরাহ করে তাইওয়ানভিত্তিক সেমিকন্ডাক্টর জায়ান্টটি। অ্যাপল, কোয়ালকম, মিডিয়াটেক, এনভিডিয়া, ইন্টেল, এএমডির মতো কোম্পানির ডিজাইনকৃত চিপ তৈরি করে টিএসএমসি।

গত জুনে ফোন অ্যারেনার এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছিল, টিএসএমসির ওপর অতি নির্ভরশীলতা বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে। এখন এমন উদ্বেগের কথা ব্যক্ত করেছেন স্বয়ং টিএসএমসি সিইও মার্ক লিয়ু। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম ফোকাস তাইওয়ানকে দেয়া সাক্ষাত্কারে লিয়ু বলেন, চীন যদি তাইওয়ান আক্রমণ করে তাহলে টিএসএমসির ফ্যাবগুলো অকার্যকর হয়ে পড়বে। এতে পুরো অঞ্চলে বড় আকারের অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে পড়বে।

টিএসএমসি যে প্রক্রিয়ায় চিপ উৎপাদন করে তা সচল রাখতে গ্রাহক সরবরাহকারীদের মধ্যে সহযোগিতা অব্যাহত রাখা জরুরি। কিন্তু যুদ্ধ বাধলে তাইওয়ানের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ কঠিন হয়ে পড়বে বহির্বিশ্বের। এতে বিভিন্ন উপকরণ স্বল্পতায় টিএসএমসির পক্ষে সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করা সম্ভব হবে না। যুদ্ধ অবশ্য কারো জন্য ভালো হবে না সেদিকে ইঙ্গিত দিয়ে লিয়ু বলেন, টিএসএমসির মোট আয়ের ১০ শতাংশ আসে চীন থেকে। টিএসএমসিকে যদি বেইজিংয়ের প্রয়োজন লাগে তাহলে তা ভালো ব্যাপার।

টিএসএমসি সিইও আরো বলেন, চীন-তাইওয়ানের যুদ্ধে আসলে কেউই জয়ী হবে না। শুধু সেমিকন্ডাক্টরই নয় অঞ্চলের শৃঙ্খলা রাজনৈতিক কাঠামো সম্পূর্ণ পাল্টে দেবে। যেকোনো ধরনের সামরিক অভিযান অঞ্চলে মারাত্মক অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।

সম্প্রতি টেক টাইমসের অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ন্যানোমিটার চিপ উন্নয়নের কাজ পিছিয়ে দিচ্ছে টিএসএমসি। মার্কিন চিপ জায়ান্ট ইন্টেল সম্প্রতি ক্রয়াদেশ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়ায় এমন পদক্ষেপ তাদের। চলতি বছরের শেষার্ধেই ন্যানোমিটারের চিপ গণ-উৎপাদনে যাচ্ছিল টিএসএমসি। বলা হচ্ছে, কিছু ভেরিফিকেশন ডিজাইন-সংক্রান্ত ঝামেলায় কোম্পানিটি তাদের সম্প্রসারণ পরিকল্পনা ২০২৩ সালের প্রথমার্ধ নাগাদ পেছাতে বাধ্য হয়েছে। টিএসএমসির ন্যানোমিটারর চিপের প্রথম গ্রাহক ছিল ইন্টেল। কিন্তু মার্কিন কোম্পানিটি ক্রয়াদেশ বাতিল করায় এখন উৎপাদন পেছানো ছাড়া কোনো উপায় নেই চিপ জায়ান্টটির। ম্যাক রিউমার্সের অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইন্টেল পিছু হটায় টিএসএমসির ন্যানোমিটার চিপের প্রথম গ্রাহক হতে পারে অ্যাপল।

সেমিকন্ডাক্টর স্বল্পতার কারণে গত কয়েক মাসে ধুঁকছে শিল্পোৎপাদন খাত। সম্প্রতি স্মার্টফোন ব্যক্তিগত কম্পিউটার খাতে চিপস্বল্পতা প্রশমিত হলেও গাড়ি নির্মাতাদের জন্য এখনো উদ্বেগের কারণ হিসেবে রয়ে গিয়েছে। পিসি চিপের চাহিদা কমার কারণে দ্বিতীয় প্রান্তিকে আয় কমেছে মার্কিন চিপ নির্মাতা ইন্টেলের। বলা যায়, ২০১৭ সালের পর নিট লোকসান গুনেছে কোম্পানিটি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন সেমিকন্ডাক্টর শিল্প সরবরাহ চেইন সংকটের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এর উৎপাদন যেমন চূড়ায় পৌঁছেছে, তেমনি বিভিন্ন সংকটের কারণে চাহিদামাফিক উৎপাদন করা কঠিন ঠেকেছে।

পিসি স্মার্টফোনের মতো ভোক্তা ইলেকট্রনিকস খাতের ওপর একসময় বড় আকারে নির্ভরশীল ছিল সেমিকন্ডাক্টর শিল্প। এখনো খাত অনেক গুরুত্বপূর্ণ থাকলেও গাড়ি সার্ভারের মতো খাত থেকে চিপের চাহিদা বাড়ছে।

সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের অভিমুখ নিয়ে ছয় বিশ্লেষকের গবেষণার বরাতে সম্প্রতি নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্মার্টফোন পিসি খাতে অতিরিক্ত চিপ সরবরাহ রয়েছে। কিন্তু গৃহস্থালি পণ্য গাড়িতে চাহিদামাফিক চিপের জোগান দেয়া যাচ্ছে না। চলতি বছরের শেষ নাগাদও গাড়ি শিল্পে চিপস্বল্পতা বহাল থাকবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণে আগস্টে আগের পূর্বাভাসের চেয়ে ২০ শতাংশ কম গাড়ি উৎপাদনের প্রাক্কলন টয়োটা মোটরের।

দিইলেকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনীতির মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফ্যাব সামগ্রী ক্রয় বাড়িয়ে দিয়েছে চীনা চিপ নির্মাতা কোম্পানিগুলো। চীনের বেশির ভাগ সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি ২৮ ন্যানোমিটার নোডের লিগ্যাসি প্রসেস ব্যবহার করে থাকে। চীনের এক স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের বরাতে জানা গিয়েছে, ২০২২ সালের প্রথমার্ধে হাজার ৮৮৫ কোটি ডলারের ফ্যাব সামগ্রী আমদানি করেছে চীন। এর মধ্যে জাপান থেকে আমদানি করেছে ৪৮৮ কোটি ডলারের পণ্য। তার পরই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৬৫ কোটি ডলারের ফ্যাব সামগ্রী আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন