তিনি কেবল কবি নন, একজন সফল গল্পকার। বাংলা উপন্যাসও এগিয়েছে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। তিনি সিনেমা যুগের মানুষ নন। পশ্চিমবঙ্গে বাংলা সিনেমার বিকাশ হয় মূলত চল্লিশের দশকের পরে। ততদিন সময় পেলে হয়তো সিনেমায়ও তার প্রতিভা প্রকাশ করতে পারতেন। কিন্তু বাংলা সিনেমা ও নাটকে কোনো না কোনোভাবে রবীন্দ্রনাথ আছেন। তার গল্প থেকে সিনেমা হয়েছে, নাটক হয়েছে। এমনকি তার লেখা গান ব্যবহূত হয়ে চলেছে সিনেমায়। ভাষা, ভাব ও প্রাসঙ্গিকতার কারণে রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালির প্রেম, বিরহ, সংকটের যেকোনো ‘সিচুয়েশনে’
খাপ খেয়ে যায়। মঞ্চ থেকে শুরু হয়ে আজকের ডিজিটাল সিনেমা বা ওয়েব ফিল্মের সময়েও বাঙালি তাই বারবার ফিরে যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে।
রবীন্দ্রনাথের গল্পের অন্যতম সফল চিত্রায়ণ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। বিশ্বকবির একাধিক গল্প নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। ‘নষ্টনীড়’ গল্প থেকে ১৯৬৪ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘চারুলতা’। অমলের চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভূপতির চরিত্রে শৈলেন মুখার্জি ও চারুলতার চরিত্রে মাধবী মুখার্জি। নষ্টনীড়ে অমল ও চারুর যে রসায়ন তা সত্যজিৎ রায় রুপালি পর্দায় যেন রক্ত-মাংসে উপস্থাপন করলেন। নষ্টনীড় গল্পটি সম্পর্কে অনেকেরই মত এটি কোনো না কোনোভাবে কাদম্বরী রবীন্দ্রনাথ সম্পর্ক থেকে উৎসারিত, কিন্তু সে যা-ই হোক, কেবল নষ্টনীড় গল্পের চলচ্চিত্রায়ণ হিসেবে দেখলেও একে রবীন্দ্রনাথের গল্পের অন্যতম সফল চিত্রায়ণ বলতে হয়। রবি ঠাকুরের গল্পে পাত্রপাত্রী, তাদের রুচি, প্রেম ও সম্পর্কের জটিলতার পাশাপাশি তাদের সামাজিক অবস্থান ও গৃহসজ্জার নান্দনিকতাও সত্যজিৎ রক্ষা করেছেন।
জোড়াসাঁকোর দেবেন ঠাকুরের পুত্র রবীন্দ্রনাথকে ওপরতলার মানুষ বলে মনে করেন অনেকেই। কিন্তু আদতে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং দেখেছেন সব ধরনের মানুষের জীবনযাত্রা। গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি আছে তার বহু গল্পে। এর মধ্যে ‘পোস্টমাস্টার’,
‘সমাপ্তি’,
‘মণিহার’
অন্যতম। তিনটি গল্প থেকেই সিনেমা তৈরি করেছেন সত্যজিৎ রায়। একালে শর্টফিল্ম ও অ্যান্থলজি বেশ জনপ্রিয়। সত্যজিৎ রায় সেকালেই এ তিন গল্প থেকে তিনটি শর্ট ফিল্মের অ্যান্থলজি তৈরি করেছিলেন বলা যায়। নাম দিয়েছিলেন ‘তিন কন্যা’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পে নারী চরিত্ররা বারবার এসেছেন প্রধান হয়ে। ‘ঘরে-বাইরে’তে সন্দ্বীপ বা নিখিলেশকে ছাপিয়ে যায় বিমলা। এ উপন্যাসে নারীর প্রেম, তার দোটানার বিষয় আছে, কিন্তু সমান্তরালে রবীন্দ্রনাথ এখানে নিয়ে এসেছেন সমাজ ও রাজনৈতিক সচেতনতা। সে জায়গাটিকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছেন সত্যজিৎ রায়। ভিক্টর ব্যানার্জি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত অভিনীত সিনেমাটিতে সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথের ‘ভিশন’কে পুরোপুরি ধরতে পেরেছিলেন এবং তা উপস্থাপন করেছেন তার সময়ের বাস্তবতায়। শান্তিনিকেতনে কিছুকাল পড়াশোনা করার কারণে সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথকে বুঝেছিলেন গভীরভাবে। তাই সমাপ্তি, পোস্টমাস্টার ও মণিহার গল্পের সরলতা যেমন তিনি সরলভাবে প্রকাশ করেছেন, তেমনি চারুলতা ও ঘরে-বাইরে সিনেমায় এসেছে জটিলতার বয়ান। কিন্তু সবকিছুর ওপরে রবীন্দ্রনাথের সুরটি স্পষ্ট।
রবীন্দ্রনাথের গল্পের একটি ইতিবাচক দিক হলো তা কালোত্তীর্ণ। কেননা ঘরে-বাইরে থেকে বর্তমান সময়ের নিরিখে অপর্ণা সেন নির্মাণ করেছেন ‘ঘরে বাইরে আজ’। যীশু সেনগুপ্ত, অনির্বাণ ভট্টাচার্য ও তুহিনা দাস অভিনীত সিনেমাটিতে বর্তমান ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়টি এনেছেন অপর্ণা সেন।
পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি বাংলাদেশেও বিশ্বকবির গল্প থেকে সিনেমা হয়েছে। বাংলাদেশের সিনেমা জগতে সত্তরের দশকে সাইফুল আজম কাসেম ‘সোহাগ’
নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নৌকাডুবি’
অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল সিনেমাটি। ১৯৮৪ সালে কাজী হায়াৎ নির্মাণ করেন ‘রাজবাড়ী’। এ সিনেমায় ‘ক্ষুধিত পাষাণ’
গল্পের ছায়া পাওয়া যায়। ২০০৫ সালে চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন ‘শাস্তি’। রিয়াজ ও ইলিয়াস কাঞ্চন অভিনীত এ সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পর একই বছরে নির্মিত হয় ‘শুভা’। সাকিব খান ও পূর্নিমা অভিনয় করেছিলেন এ সিনেমায়। দুটি সিনেমাই দর্শকের প্রশংসা লাভ করে। রবীন্দ্রনাথের গল্পের ধারাটি প্রকাশ করতে পেরেছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম। কাজী হায়াতের পরিচালনায় ‘কাবুলিওয়ালা’ও প্রশংসিত হয়।
রবীন্দ্রনাথের গল্প থেকে সিনেমা নির্মাণ করতে হলে রবীন্দ্রনাথের সুরটি ধরা জরুরি। এজন্য প্রয়োজন বিশ্বকবিকে জানা। কাজটি করেছিলেন সত্যজিৎ রায় এবং তার পরে ঋতুপর্ণ ঘোষ। উভয়েই রবীন্দ্রনাথের ওপরে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। সত্যজিৎ ও ঋতুপর্ণ উভয়ের সিনেমায়ই সিনেম্যাটিক সৌন্দর্য ও অ্যাসথেটিকসের ব্যবহার লক্ষণীয়। এদিকে ঋতুপর্ণ এগিয়ে। অবশ্য ‘চোখের বালি’
ও ‘নৌকাডুবি’
নিয়ে কিছুটা সমালোচনাও দেখা গেছে। ঋতুপর্ণ তার স্বভাবসুলভ কিছু অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন, যা রবীন্দ্রনাথে অনুপস্থিত। কিন্তু তাতে বিনোদিনী, মহেন্দ্র, বিহারী (চোখের বালি) ও নৌকাডুবির মূল সুর ও উপস্থাপনায় রবীন্দ্রনাথ হারিয়ে যাননি। তাকে বরং স্পষ্টই খুঁজে পাওয়া যায়। ‘চিত্রাঙ্গদা’
ঋতুপর্ণ ঘোষের নিজস্ব দর্শনের সিনেমা, কিন্তু সেখানেও সিনেমার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য প্রসঙ্গ তিনি রেফারেন্স হিসেবে রেখেছেন।
এর বাইরে আরো বহু সিনেমা তৈরি হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গল্প থেকে। তার নাটক, গীতি ও নৃত্যনাট্য এখনো মঞ্চায়ন হয়। প্রতি বছর রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী ও প্রয়াণ দিবসে টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত হয় তার গল্প থেকে নির্মিত টিভি নাটক।
সিনেমার যুগে রবীন্দ্রনাথ আরো সময় পেলে তিনি নিজেও সিনেমা নির্মাণে অবদান রাখতেন। সিনেমায় তার আগ্রহ ছিল। ১৯৩২ সালে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ‘নটীর পূজা’ নামে একটি সবাক চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। ওই বছর সিনেমাটি মুক্তি পায়। মাত্র চারদিনে সিনেমাটির শুটিং করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সত্তর বছর রয়সে রবীন্দ্রনাথের সিনেমা নির্মাণ প্রমাণ করে সুযোগ পেলে তিনি সিনেমায়ও অবদান রাখতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথ সে সুযোগ না পেলেও তার গল্প ও উপন্যাস থেকে সিনেমা নির্মিত হচ্ছে এবং এর মধ্য দিয়েই সিনেমা ও টিভি নাটকেও ঘুরেফিরে আসেন রবীন্দ্রনাথ। তাকে খুঁজে পাওয়া যায় সব মাধ্যমে।