হারানো প্রভাব ফিরে পাচ্ছেন মোহাম্মদ বিন সালমান

বণিক বার্তা ডেস্ক

সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ছবি: এপি

সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সম্প্রতি ইউরোপ সফর করেছেন। শুরুতে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে অবতরণ করেন তিনি। সৌদি যুবরাজকে লালগালিচা সংবর্ধনাসহ অভূতপূর্ব এক আতিথেয়তা দেয়া হয় সেখানে। গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী কাইরিয়াকোস মিতসোতাকিস নিজে তাকে অভ্যর্থনা জানান। পাশাপাশি দেশটির সঙ্গে সৌদি আরবের পরিবহন যোগাযোগ, সামরিক অন্যান্য খাতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা-সংক্রান্ত চুক্তিও হয় তার উপস্থিতিতে।  সফর চলাকালে ক্রমবর্ধমান জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় সৌদি আরবের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে সহযোগিতা চেয়েছে গ্রিস।

গ্রিস সফর শেষে ফ্রান্সে যান সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ নিজে তাকে সেখানে অভ্যর্থনা জানান। এলিসি প্রাসাদে নৈশভোজ, লালগালিচা সংবর্ধনাসহ ফ্রান্সের কাছ থেকেও সম্ভাব্য সর্বোচ্চ আতিথেয়তা পেয়েছেন সৌদি যুবরাজ। ফরাসি প্রেসিডেন্টও জ্বালানি ইস্যুতে সহযোগিতার জন্য সৌদি যুবরাজের কাছ থেকে সহযোগিতা চেয়েছেন।

মোহাম্মদ বিন সালমানের ইউরোপ সফর শুরুর আগে সৌদি আরব সফরে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সেখানে সৌদি আরব রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ওপেক প্লাস জোট যাতে জ্বালানি তেলের উত্তোলন ব্যাপক মাত্রায় বাড়িয়ে তোলে সে বিষয়ে সৌদি যুবরাজকে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। সৌদি যুবরাজের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় বেশ আন্তরিকতা উষ্ণতাও প্রদর্শন করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

যদিও ২০২০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগ মুহূর্তে বেশ শক্তভাবেই সৌদি আরব মোহাম্মদ বিন সালমানের সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন জো বাইডেন। সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড ইস্যুতে রিয়াদ সৌদি যুবরাজকে একঘরে করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। চার বছর আগে তুরস্কে সৌদি দূতাবাসের অভ্যন্তরে সংঘটিত ওই হত্যাকাণ্ড বিশ্বজুড়ে বেশ আলোড়ন তুলেছিল। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর প্রতিবেদনে হত্যাকাণ্ডের জন্য মোহাম্মদ বিন সালমানকেই মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে দায়ী করা হয়েছে। খাসোগি ইস্যুতে সৌদি যুবরাজের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। ফ্রান্স, গ্রিসসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) সব দেশই শক্ত ভাষায় মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে। অতীতের দীর্ঘদিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক চরম তিক্ত হয়ে উঠেছিল। দীর্ঘদিনের মিত্রদের বিরোধিতা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অনেকটাই প্রভাবহীন করে তুলেছিল মোহাম্মদ বিন সালমানকে। এর বিপরীতে রাশিয়া চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে তোলে সৌদি আরব।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পশ্চিমা মহলকে এখন সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে প্রয়াসী হয়ে উঠতে বাধ্য করেছে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি। একই সঙ্গে মোহাম্মদ বিন সালমানও এখন তার হারানো প্রভাব ফিরে পাচ্ছেন। ইউরোপের দেশগুলো জ্বালানির জন্য সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল রাশিয়ার ওপর। কিন্তু ইউক্রেনে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মস্কোর সঙ্গে দেশগুলোর তিক্ততা এখন চরমে। রাশিয়াও ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ কমিয়ে এনেছে। ইইউভুক্ত দেশগুলো এখন ভয়াবহ জ্বালানি সংকটে ভুগছে। অন্যদিকে নিজ দেশের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমিয়ে আনতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্রও। এজন্য ওপেক প্লাস জোটের সহযোগিতা প্রয়োজন তার। জোটটির মূল দুই নিয়ন্ত্রক দেশ সৌদি আরব রাশিয়া। এরই মধ্যে ইউক্রেনে হামলার ঘটনায় রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতা স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে ফিরে গিয়েছে। অবস্থায় সহযোগিতা চাওয়ার জন্য শুধু সৌদি আরবকেই উপযুক্ত হিসেবে ভেবেছেন জো বাইডেন।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচিত হওয়ার পর এবারই প্রথম সৌদি আরব সফরে গিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সেখানে মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে সাক্ষাত্কালে আন্তরিক অভিব্যক্তিও দেখিয়েছেন তিনি। তবে সৌদির হাবভাবে এতদিনের তিক্ততা সহজে দূর হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। রুশ মিডিয়ার বরাত দিয়ে জার্মান একটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, মোহাম্মদ বিন সালমান তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসা মার্কিন প্রেসিডেন্টকে যখন অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে যান, সে সময় বাইডেনের যাত্রাপথের দুই পাশে ইরাকে মার্কিন সেনাবাহিনীর কুখ্যাত কারাগার আবু গারিবের নির্যাতন দৃশ্যের ফটোগ্রাফ টাঙানো ছিল। আলোচনার সময় বাইডেন খাসোগি হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ তুললে মোহাম্মদ বিন সালমান তাকে আবু গারিব কারাগারে মার্কিন সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন নির্যাতনের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।

আলোচনায় ওপেক প্লাস জোট যাতে বাজারে ব্যাপক মাত্রায় সরবরাহ বাড়িয়ে তোলে সে বিষয়ে সৌদি যুবরাজের সহযোগিতা চান বাইডেন। তবে তার অনুরোধে কান দেননি এমবিএস নামেও অভিহিত মোহাম্মদ বিন সালমান। ওপেক প্লাসের সর্বশেষ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে সেপ্টেম্বরের মধ্যে জোটভুক্ত সদস্য দেশগুলো একযোগে উত্তোলন বাড়াবে মাত্র এক লাখ ব্যারেল। ওপেক বা ওপেক প্লাসের ইতিহাসে পর্যন্ত এত কম পরিমাণে উত্তোলন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত এর আগে কখনই নেয়া হয়নি।

ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্তকে বাইডেন প্রশাসনের জন্য অনেকটা সম্মানহানিকর হিসেবে দেখছে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো। তাদের ভাষ্যমতে, বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে এমবিএসের তিক্ততা কখনই দূর হওয়ার নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সর্বশেষ সফর চলাকালেও সৌদি আরবের হাবভাবে এমনটাই ফুটে উঠেছে।

সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আব্দুলআজিজ দেশ পরিচালনায় সবচেয়ে বেশি নির্ভর করেন ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানের ওপর। বলা হয়, প্রকৃতপক্ষে এমবিএসই সৌদি আরবের প্রকৃত শাসক। সর্বশেষ ফ্রান্স সফর চলাকালে নিজের হাবভাবে তা বুঝিয়েও দিয়েছেন তিনি। প্রায় ৭০০ সফরসঙ্গী সঙ্গে করে ফ্রান্সে গিয়েছেন। সাতটি বিশেষ ফ্লাইটে তারা সেখানে গিয়ে পৌঁছেন। সফরসঙ্গীদের বহনের জন্য প্রায় ৩৫০ লিমুজিনের বন্দোবস্ত করা হয়। এমবিএসের নিরাপত্তার জন্য তার সঙ্গে বিশেষ দেহরক্ষী নিয়ে যাওয়া হয় ১৮৫ জন। সফর চলাকালে প্যারিসে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বাড়িটিতে বসবাস করেছেন এমবিএস। বাড়িটির মালিকও তিনি নিজেই। ২০১৫ সালে সাড়ে ২৭ কোটি ইউরো (প্রায় ৩০ কোটি ডলার) মূল্যে বাড়িটি কিনেছিলেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন