ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কঠোর হওয়ার বার্তা গভর্নরের

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের ব্যাংক খাতে কার্যকর সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কঠোর হওয়ার বার্তা দিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি বলেছেন, কে কোন ব্যাংকের মালিক এটি দেখার বিষয় নয়। আইন রীতিনীতি অনুযায়ী ব্যাংকগুলো চলছে কিনা সেটিই আমরা দেখব। ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরে কার্যকর সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হবে।

গভর্নর বলেন, অপেক্ষাকৃত দুর্বল ১০টি ব্যাংক আমরা চিহ্নিত করেছি। খেলাপি ঋণের মাত্রা, মূলধন পর্যাপ্ততা, ঋণ-আমানতের অনুপাত এবং সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ হারের ভিত্তিতে এসব ব্যাংক চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ওয়ান-টু-ওয়ান ভিত্তিতে আলোচনা শুরু করেছে। চিহ্নিত ১০ ব্যাংকের কাছ থেকে তিন বছরের একটি ব্যবসায়িক পরিকল্পনা করা হবে।

সম্প্রতি পরিচালকদের অনিয়ম-দুর্নীতিতে দুর্বল হয়ে যাওয়া বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল লিমিটেডের সঙ্গে বৈঠকে বসে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই বৈঠকের বিষয়টি উদ্ধৃত করে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, এরই মধ্যে একটি ব্যাংকের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। তাদের আমরা বলেছি, পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত দেবে। আর গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের শতভাগ দায়িত্ব ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের। পরিচালনা পর্ষদ নিজেদের দায়িত্বের বাইরে গিয়ে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর অনৈতিক হস্তক্ষেপ করলে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে। প্রত্যেককে নিজের দায়িত্বের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বাদশ গভর্নর হিসেবে গত ১২ জুলাই দায়িত্ব নেন সাবেক অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়নসহ দেশের অর্থনীতির সংকটময় একটি সময়ে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের চার সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্পরতা সম্পর্কে জানাতে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন আব্দুর রউফ তালুকদার। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো শীর্ষক একটি পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ . মো. হাবিবুর রহমান এটি তুলে ধরেন। পরে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গণমাধ্যম কর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

দেশের অর্থনীতি মুহূর্তে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদহার বাড়াচ্ছে। পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকও ঋণের সর্বোচ্চ সুদ শতাংশ নির্ধারণ থেকে বের হয়ে আসবে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য দুটি মাধ্যম বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এর একটি হলো সুদহার বাড়িয়ে অর্থপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ। অন্যটি ট্যাক্স বাড়িয়ে জনগণকে কেনাকাটায় নিরুৎসাহিত করা। আমরা দুটির একটিও না বাড়িয়ে তৃতীয় বিকল্প বাস্তবায়ন করছি। সেটি হলো মানুষের বিভিন্ন চাহিদা কমিয়ে আনার পাশাপাশি উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া।

গভর্নর বলেন, দুই বছর পর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দুই অংকে উন্নীত হয়েছে। প্রতি বছর দেশের ২০ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে। তরুণদের বড় অংশের কর্মসংস্থান হয় বেসরকারি খাতে। অবস্থায় ঋণের সুদহার বেড়ে গেলে বেসরকারি বিনিয়োগ কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। তাই বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ টেনে ধরা ঠিক হবে না। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে বাজারে সাড়ে বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকা উঠে এসেছে। পরিমাণ তারল্য উঠে আসার কারণে ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে বাজারে তারল্য সংকট বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তারল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে ঋণের সুদহার বাড়ানোর প্রসঙ্গ আর উঠবে না।

আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, কভিড-১৯ সৃষ্ট দুর্যোগের সময় আমরা প্রচলিত রীতিনীতির বাইরে গিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। এর মাধ্যমে সফলও হয়েছি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই সবার আগে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে। আশা করছি, চলমান দুর্যোগও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখনো আমদানির প্রাধান্য বেশি। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস, ভোজ্যতেলসহ সব পণ্যের দাম বেড়েছে। অবস্থায় অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও চাপের মুখে আছে। মুহূর্তে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মূল্যস্ফীতিকে চিহ্নিত করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো ডলারের বিনিময় মূল্য ৯৪ টাকায় বেঁধে রেখেছে। অথচ দেশের ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স হাউজগুলো থেকে ১১০-১১২ টাকায় ডলার কিনছে। এটি ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার নীতির প্রতিফলন কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, দাতা সংস্থা, অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে সবাই ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। আমরাও হয়তো সে পথে যাব। তবে এজন্য কিছুটা সময় লাগবে। গত অর্থবছরে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে। গত এক মাসে আমরা আমদানি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছি। এর ফলও দৃশ্যমান হয়েছে। জুলাইয়ে আমদানি ব্যয় বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। গত মাসে রফতানি রেমিট্যান্স মিলিয়ে আমাদের যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে সেটি আমদানির চেয়ে বেশি। আগামী দু-তিন মাস ধরনের পরিস্থিতি চলতে থাকলে ডলারের বাজার স্থিতিশীল হয়ে আসবে। তখন ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি ভাবা হবে।

প্রভাবশালীদের চাপের মুখে বাংলাদেশ ব্যাংকও অনেক ক্ষেত্রে নতি স্বীকার করেছে। অবস্থায় ব্যাংকগুলোয় সুশাসন ফেরাতে গিয়ে রাজনৈতিক চাপের মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিছু হটবে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, আইন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রাজনৈতিক কোনো চাপের মুখে পড়তে হবে বলে মনে করি না। কারণ রাজনীতিবিদরাই আইন তৈরি করেন। সে আইনের বাস্তবায়ন ঘটাতে গেলে রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকে বাধা আসার কথা নয়।

আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, এরই মধ্যে আমরা ব্যাংকের এমডিদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। সেখানে তাদের বলেছি, আপনারা আইন অনুযায়ী কাজ করবেন। কাজ করতে গিয়ে যদি কোনো পক্ষ থকে অনৈতিক চাপ আসে, তাহলে আমাদের জানাবেন। আমরা কার্যকর ব্যবস্থা নেব। কিন্তু কোনো ব্যাংকার যদি নিজেই আইন লঙ্ঘন করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে বলেছি। চাপ বলতে কিছু নেই। সোজা কথা হলো আমি আইনের মধ্যে আছি, নাকি নেই।

দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপগুলো তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বলা হয়, ব্যাংক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম চিহ্নিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০টি পরিদর্শক দল সার্বক্ষণিক কাজ করছে। অনিয়মে জড়িত থাকায় এখন পর্যন্ত পাঁচটি মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। ৪৫টি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হয়েছে। রফতানি উন্নয়ন তহবিলের সুদহার থেকে শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। রফতানিকারকদের ইআরকিউ হিসাবের স্থিতি ৫০ শতাংশ তাত্ক্ষণিক নগদায়নের নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি এর সীমা ১৫, ৬০ ৭০ শতাংশ থেকে কমিয়ে যথাক্রমে দশমিক , ৩০ ৩৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশে আনার পদ্ধতি সহজ করা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন