সংসদীয় কমিটিতে বিপিডিবির তথ্য প্রকাশ

নয় মাসে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা

জেসমিন মলি

দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। তবে ব্যবহার হয় মাত্র সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট। অতিরিক্ত সক্ষমতা বসিয়ে রাখতে হয়। আর সক্ষমতা বসিয়ে রাখা হলেও এর বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ বা সক্ষমতার ব্যয় হিসেবে বিপুল পরিমাণ অর্থ গুনতে হচ্ছে সরকারকে। গত অর্থবছরের (২০২১-২২) প্রথম নয় মাসেই (জুলাই-মার্চ) বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য সক্ষমতা ব্যয় বাবদ সরকারকে গুনতে হয়েছে ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে গতকাল বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) পক্ষ থেকে কথা জানানো হয়েছে।

বৈশ্বিক জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সারা দেশে এখন এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং চলছে। বিদ্যুৎ জ্বালানি সাশ্রয়ের ঘোষণা দিয়ে রাত ৮টার পর শপিংমল দোকানপাট বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বন্ধ রাখা হয়েছে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও। এমন এক পরিস্থিতিতে গতকাল জাতীয় সংসদের বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠক আয়োজন করা হয়।

সেখানে উপস্থাপিত বিপিডিবির প্রতিবেদনে উঠে আসে, ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে দেশের ৬১টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র (আইপিপি) থেকে বিদ্যুৎ কিনতে সরকারকে সক্ষমতা ব্যয় হিসেবে গুনতে হয়েছে ১১ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডকে। কোম্পানিটির বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। নয় মাসে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডকে সক্ষমতা ব্যয় বাবদ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে বিপিডিবি।

বেসরকারি অন্য বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে বাংলা ট্র্যাক পাওয়ার ইউনিট- লিমিটেডকে ২৬৭ কোটি টাকা, এপিআর এনার্জিকে ৪০১ কোটি, দেশ এনার্জি চাঁদপুর পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডকে ২০১ কোটি, মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেডকে ২১১ কোটি, নতুন বিদ্যুৎ (বাংলাদেশ) লিমিটেডকে ২৩৩ কোটি, প্যারামাউন্ট বিট্র্যাক এনার্জি লিমিটেডকে ২৬৪ কোটি, সেম্বকর্প এনডব্লিউপিসি লিমিটেডকে ৪৪৬ কোটি, সামিট বিবিয়ানা- পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডকে ২৫১ কোটি, সামিট গাজীপুর- পাওয়ার লিমিটেডকে ২৬৪ কোটি, সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেডকে ৩৪০ কোটি ইউনাইটেড আনোয়ারাকে ৩০৩ কোটি টাকা সক্ষমতা ব্যয় বাবদ পরিশোধ করেছে বিপিডিবি।

বিদ্যমান লোডশেডিং পরিস্থিতির কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বাবদ ব্যয় আরো বাড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সিনিয়র সহসভাপতি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ক্যাপাসিটি পেমেন্ট চুক্তিই করা হয়েছিল বিদ্যুৎ লাগুক আর না লাগুক তাদের টাকা দিতেই হবে। যে আইনবলে চুক্তি করা হয়েছে, সেখানে রকম সুবিধা দেয়া আছে। রকম টাকা পাওয়ার সুযোগ আছে বলেই খাতে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে চুক্তিই এমনতাদের প্রতি মাসে-প্রতি বছরে বিদ্যুৎ নেয়া হোক আর না হোক, টাকা দিতেই হবে। বেশি বিদ্যুৎ কিনলে প্রতি ইউনিট হিসেবে টাকার পরিমাণ কমে আসেএই হচ্ছে অংক। এখন যেমন লোডশেডিং হচ্ছে বিদ্যুৎ কেনা হবে না, কিন্তু সক্ষমতা ব্যয় ঠিকই পরিশোধ করতে হবে।

গত অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ১২টি রেন্টাল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে সরকারের সক্ষমতা ব্যয় বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৬৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট করা হয়েছে অ্যাক্রন ইনফ্রাস্ট্রাকচার সার্ভিস লিমিটেডকে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ১০০ মেগাওয়াট।

গত অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে চারটি আমদানি করা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সক্ষমতা ব্যয় হিসেবে দেয়া হয়েছে ৮৬৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনভিভিএনের দুটি কেন্দ্রের জন্য যথাক্রমে ১৮৩ কোটি ২৪৩ কোটি টাকা, পিটিসি ইন্ডিয়া লিমিটেডকে ১৩ কোটি সেম্বকর্প এনার্জি ইন্ডিয়া লিমিটেডকে ৪২৮ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তামিম বলেন, সারা বছর কোনোভাবে ব্যবহার না করে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হলে সেটি সমস্যার। কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রকে সারা বছর বসিয়ে রেখে বা খুব কম চালিয়ে সক্ষমতা ব্যয় পরিশোধ করা হলে বুঝতে হবে ওই কেন্দ্রটির দরকার নেই। যেটা অর্ধেক সময় বসিয়ে রেখে অর্ধেক সময় ব্যবহার হয়, সেটা তো ঠিকই আছে। নিয়ম অনুযায়ী, বসিয়ে রাখার সময় ক্যাপাসিটি চার্জ দিতেই হবে।

তামিম আরো বলেন, চলমান লোডশেডিং জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য করা হচ্ছে। একটা বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখা হয়েছে। যখন জরুরিভাবে দরকার হবে, গরম বাড়বে তখন সেটা ব্যবহার করা হবে কিন্তু অন্য সময় সক্ষমতা ব্যয় পরিশোধ করে যেতে হবে।

গত অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়সীমার মধ্যে ১৬টি সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ব্যয় হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে আশুগঞ্জ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড দক্ষিণকে ৪১৩ কোটি টাকা, ইলেকট্রিক জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইজিসিবি) সিদ্ধিরগঞ্জকে ৩৩৯ কোটি, নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) ভেড়ামারাকে ৩২৬ কোটি, আশুগঞ্জ ২২৫ মেগাওয়াট পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডকে ২৪৮ কোটি, আশুগঞ্জ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড উত্তরকে ২৭২ কোটি, আশুগঞ্জ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডকে (৫৭৩ মেগাওয়াট) ১৭৭ কোটি, এনডব্লিউপিজিসিএল সিরাজগঞ্জ ইউনিট--কে ১২১ কোটি, এনডব্লিউপিজিসিএল সিরাজগঞ্জ ইউনিট--কে ২১৪ কোটি, এনডব্লিউপিজিসিএল সিরাজগঞ্জ ইউনিট--কে ২২১ কোটি, এনডব্লিউপিজিসিএল মধুমতিকে ১০২ কোটি, এনডব্লিউপিজিসিএল খুলনাকে ২৫৩ কোটি, ইজিসিবি হরিপুরকে ২২৫ কোটি, বিআর পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেডকে ১৭৪ কোটি, ইজিসিবি সিদ্ধিরগঞ্জকে (২১০ মেগাওয়াট) ১১২ কোটি, আশুগঞ্জ ৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডকে ১৬ কোটি এনডব্লিউপিজিসিএল সোলার কোম্পানিকে কোটি ৬১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জাতীয় সংসদের বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ওয়াসিকা আয়শা খান এমপি বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি খাতকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ক্যাপাসিটি পেমেন্টের সুযোগ রাখা হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী অর্থ দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে এখন নতুন করে যেসব চুক্তি নবায়ন করা হচ্ছে সেখানে বাধ্যবাধকতার বিষয়টি তুলে নেয়া হচ্ছে। এখন নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট রকম করে চুক্তি নবায়ন করা হচ্ছে।

সংসদীয় কমিটির সভাপতি বলেন, সারা বিশ্বেই জ্বালানি নিয়ে এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। আমাদের জ্বালানি সাশ্রয় করে চলতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। যাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমে আসে। বিষয়ে যত দ্রুত উদ্যোগী হব, ততই আমাদের জ্বালানি সংকট থেকে উত্তরণ ঘটবে। 

সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা বিপিডিবির প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এর আগে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে সক্ষমতা ব্যয় বাবদ খরচ হয় ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০২টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট করা হয় ১৮ হাজার ১২৩ কোটি টাকা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন