দেশসেরা ব্যাংক ইস্টার্ন তারপর সিটি ও ডাচ্-বাংলা

হাছান আদনান ও মেহেদী হাসান রাহাত

দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংক নিয়ে ২০১৩ সালে প্রথম সেরা ব্যাংক নির্বাচন করে বণিক বার্তা। তার পর থেকেই প্রতি বছর এ র‍্যাংকিং প্রকাশ করা হচ্ছে। ২০২১ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এবার দশম র‍্যাংকিং তৈরি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুসরণ করে সাতটি নির্দেশকে স্কোরিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর আর্থিক কার্যক্রমের মূল্যায়ন করা হয়েছে

২০২১ সাল ছিল নভেল করোনাভাইরাস সৃষ্ট দুর্যোগ সামাল দেয়ার বছর। সংক্রমণের প্রকোপ বাড়লেও মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল সাহস। সংকটকে পাশ কাটিয়ে প্রাণবন্ত ছিল দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। সে সময় ব্যাংকগুলোকে নীতিসহায়তা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সমস্যা ও সম্ভাবনার দোলাচলের বছরে প্রত্যাশার চেয়েও ভালো করেছে দেশের বেশকিছু ব্যাংক। আবার ভালো অবস্থানে থাকা কিছু ব্যাংক নিজেদের মর্যাদা খুইয়েছে।

গত বছরের আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর র‍্যাংকিং করেছে বণিক বার্তা। ২০১৩ সাল থেকে প্রতি বছরই নিয়মিতভাবে এ র‍্যাংকিং প্রকাশ করা হচ্ছে। বিভিন্ন করপোরেট রিসার্চ টিমের সহায়তায় দশমবারের মতো এটি প্রস্তুত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে লংকাবাংলা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এবারের র‍্যাংকিংয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ২০টির প্রাপ্ত স্কোর বেড়েছে। কমেছে ১০টি ব্যাংকের। গত বছরের র‍্যাংকিংয়ে শীর্ষস্থানে থাকা ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড এবার তৃতীয় স্থানে নেমে এসেছে। শীর্ষে উঠে এসেছে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল)। গত বছর তৃতীয় স্থানে থাকা দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড এবার আরো এক ধাপ এগিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। তবে শীর্ষ তিন ব্যাংকেরই প্রাপ্ত নম্বর ৩৫-এর ঘরে। ফলে ব্যাংকগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থান দখল নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে।

গোটা বিশ্বেই একটি ব্যাংকের সক্ষমতা, পারফরম্যান্স ও প্রকৃত পরিস্থিতির চিত্র বিশ্লেষণে নির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ড বা নির্দেশক ব্যবহার করা হয়। এগুলো হচ্ছে সম্পদের বিপরীতে আয় (রিটার্ন অন অ্যাসেট বা আরওএ), শেয়ারহোল্ডারদের মালিকানার বিপরীতে আয় (রিটার্ন অন ইকুইটি বা আরওই), শ্রেণীকৃত ঋণ (এনপিএল) অনুপাত, কর-পরবর্তী নিট মুনাফা, শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস), মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত (ক্যাপিটাল অ্যাডিকুয়েসি রেশিও বা সিএআর) ও শাখাপ্রতি পরিচালন মুনাফা (ওপিবি)। আগের বছরগুলোয় শেয়ারপ্রতি আয়কে (ইপিএস) সেরা ব্যাংক নির্ধারণের ক্ষেত্রে অন্যতম নির্দেশক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তবে ২০২০ সাল থেকেই সেরা ব্যাংক নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্দেশক হিসেবে ইপিএসের পরিবর্তে কর-পরবর্তী নিট মুনাফাকে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। মূলত স্টক লভ্যাংশ ঘোষণা করার কারণে ব্যাংকের নিট মুনাফায় হেরফের না হলেও ইপিএস কমে যায়। এ কারণেই ইপিএসের পরিবর্তে নিট মুনাফাকে বিবেচনা করা হয়েছে।

র‍্যাংকিংয়ে আরওএর ক্ষেত্রে শীর্ষ মান নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ শতাংশ। একইভাবে আরওইর ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ, এনপিএলের ক্ষেত্রে ১ শতাংশ, সিএআরের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ, নিট মুনাফার ক্ষেত্রে ১ হাজার কোটি টাকা, এনএভিপিএসের ক্ষেত্রে ১০০ টাকা এবং ওপিবির ক্ষেত্রে ১০ কোটি টাকাকে শীর্ষমান হিসেবে ধরা হয়েছে। আর প্রতিটি নির্দেশকের সর্বোচ্চ নম্বর ধরা হয়েছে ১০।

লংকাবাংলা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির সহকারী ব্যবস্থাপক মো. মোস্তফা নোমান এ র‍্যাংকিং তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ঋণ শ্রেণীকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি ছাড়, কভিড-পরবর্তী সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে ঊর্ধ্বগতি ও আমানতের নিম্ন সুদহারের কারণে ২০২১ সালে অধিকাংশ ব্যাংক ভালো মুনাফা করেছে। অবশ্য ঋণ শ্রেণীকরণে নীতি ছাড় সত্ত্বেও বেশির ভাগ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। ২০২১ সাল শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৯ শতাংশে, যা আগের বছর ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। নীতি ছাড় উঠিয়ে নেয়ার পর পরিস্থিতির আরো অবনতি এড়াতে ব্যাংকগুলোকে আরো দক্ষতার সঙ্গে তাদের ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে হবে। অধিকন্তু উচ্চমূল্যস্ফীতি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রক্ষণশীল মুদ্রানীতির কারণে স্প্রেডের (আমানত ও ঋণের সুদহারের পার্থক্য) ওপর চাপ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সাত নির্দেশকের ভিত্তিতে তৈরি এ র‍্যাংকিংয়ে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ইবিএল, দ্য সিটি ব্যাংক ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড। এর আগে ২০২০ সালের পারফরম্যান্স নিয়ে গত বছর করা র‍্যাংকিংয়েও ব্যাংকগুলো শীর্ষ তিনে ছিল। এবারের র‍্যাংকিংয়ে শীর্ষ দশে জায়গা করে নেয়া অন্য ব্যাংকগুলো হলো ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড, প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড, ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড, প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড, ব্যাংক এশিয়া, মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) লিমিটেড।

নিট মুনাফা ও এনএভিপিএস বাদে পাঁচটি নির্দেশকের ভিত্তিতে করা এবারের র‍্যাংকিংয়ে শীর্ষ তিনের মধ্যে রয়েছে ইবিএল, সিটি ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংক। গত বছর প্রকাশিত র‍্যাংকিংয়ে এ তালিকায় শীর্ষে ছিল ইবিএল, ডাচ্-বাংলা ও সিটি ব্যাংক।

দুই বছরের র‍্যাংকিং উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গতবারের তুলনায় এবারের র‍্যাংকিংয়ে সার্বিক স্কোর বেড়েছে ২০টি ব্যাংকের। এগুলো হলো ইবিএল, সিটি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, এমটিবি, এনসিসি ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, আইএফআইসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), এবি ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।

অন্যদিকে স্কোর হ্রাস পাওয়া ১০ ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক (এনবিএল) ও রূপালী ব্যাংক লিমিটেড।

২০২০ সালের র‍্যাংকিংয়ে সাতটি সূচকের মধ্যে ছয়টিতেই প্রথম স্থান অর্জন করে শীর্ষস্থান দখলে নিয়েছিল ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে নিজের অবস্থান খুইয়েছে ব্যাংকটি। ২০২১ সালের র‍্যাংকিংয়ে দেশসেরা ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড। ৭০-এর স্কেলে ব্যাংকটির স্কোর ৩৫ দশমিক ৬৫। দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে দ্য সিটি ব্যাংক। আর ডাচ্-বাংলা ব্যাংক নেমে গিয়েছে তৃতীয় স্থানে। এর মধ্যে সিটি ব্যাংকের স্কোর ৩৫ দশমিক ৬১ আর ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ৩৫ দশমিক ১৫।

দেশসেরা ব্যাংকের স্বীকৃতি আনন্দের - আলী রেজা ইফতেখার

তবে ৭০ ও ৫০ উভয় স্কেলেই শীর্ষস্থান পাওয়া ইস্টার্ন ব্যাংকের স্কোর ২০২০ সালের তুলনায় খুব বেশি বাড়েনি। বরং ৫০-এর স্কেলে ব্যাংকটির প্রাপ্ত নম্বর আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। ২০২০ সালে ৫০-এর স্কেলে ইস্টার্ন ব্যাংকের প্রাপ্ত নম্বর ছিল ২৭ দশমিক ৭৩। আর ২০২১ সালে এ স্কেলে ব্যাংকটি নম্বর পেয়েছে ২৭ দশমিক ৫৪। মূলত ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের স্কোর কমে যাওয়ায় শীর্ষস্থানে ফিরতে পেরেছে ইস্টার্ন ব্যাংক।

ইস্টার্ন ব্যাংকের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হলো শাখাপ্রতি পরিচালন মুনাফা। দেশব্যাপী মাত্র ৮৫টি শাখার মাধ্যমে ১ হাজার ৮৬ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে ব্যাংকটি। শাখাপ্রতি পরিচালন মুনাফার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড। দ্য সিটি ব্যাংক রয়েছে তৃতীয় স্থানে। আরওএ, আরওই, নিট মুনাফায়ও ভালো অবস্থানে রয়েছে ইস্টার্ন ব্যাংক। তবে ব্যাংকটির সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো সিএআর ও খেলাপি ঋণ।

টানা তিন বছর ধরে র‍্যাংকিংয়ে উন্নতির ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে দ্য সিটি ব্যাংক। ২০২০ সালে র‍্যাংকিংয়ে তৃতীয় স্থানে থাকা ব্যাংকটি এবার দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। ৭০ ও ৫০ উভয় স্কেলে দেশসেরা ব্যাংকের দ্বিতীয় স্থান দখলে নিয়েছে ব্যাংকটি। ৭০ স্কেলে এবার ব্যাংকটির প্রাপ্ত নম্বর ৩৫ দশমিক ৬১। ২০২০ সালে এ স্কেলে ৩০ দশমিক ৩৭ নম্বর পেয়েছিল সিটি ব্যাংক। ৫০-এর স্কেলে ২৭ দশমিক শূন্য ৪ নম্বর পেয়েছে ব্যাংকটি, যা আগে ছিল ২৩ দশমিক ১০।

সিটি ব্যাংক দেশের সবচেয়ে উজ্জ্বল ব্র্যান্ড - মাসরুর আরেফিন

২০২১ সালে আরওএ, আরওই, নিট মুনাফা ও শাখাপ্রতি মুনাফায় ভালো করেছে সিটি ব্যাংক। কিন্তু খারাপ করেছে খেলাপি ঋণের হার, এনএভিপিএস ও সিএআরে। আরওই ও আরওএতে সিটি ব্যাংকের অবস্থান পুরো ব্যাংক খাতে প্রথম। আর নিট মুনাফার দিক থেকে ব্যাংকটির অবস্থান দ্বিতীয়। তবে খেলাপি ঋণের দিক থেকে ১৮তম ও সিএআরে ১২তম অবস্থান সিটি ব্যাংকের।

ইস্টার্ন ব্যাংককে পেছনে ফেলে ২০২০ সালে দেশসেরা ব্যাংক হয়েছিল ডাচ্-বাংলা। কিন্তু ২০২১ সালে ৭০ স্কেলের র‍্যাংকিংয়ে ব্যাংকটি তৃতীয় স্থানে নেমে গিয়েছে। আর ৫০-এর স্কেলে ডাচ্-বাংলার অবস্থান পঞ্চম। অবস্থান হারানোর পাশাপাশি ২০২১ সালে নম্বরও কমেছে ব্যাংকটির। ২০২০ সালে ৭০-এর স্কেলে ডাচ্-বাংলার প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৩৮ দশমিক ৩৩, এবার তা ৩৫ দশমিক ১৫-তে নেমেছে। আর ৫০-এর স্কেলে এবার ২৩ দশমিক ৭৪ নম্বর পেয়েছে ডাচ্-বাংলা, ২০২০ সালে যা ছিল ২৬ দশমিক ৯৭।

নিট মুনাফা ও এনএভিপিএসের দিক থেকে নিজের শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে ডাচ্-বাংলা। তবে খারাপ করেছে শাখাপ্রতি মুনাফা, খেলাপি ঋণ, সিএআরে। এ তিনটি নির্দেশকে খারাপ করার কারণে পিছিয়ে পড়েছে ব্যাংকটি।

তবে নিজেদের অবস্থান ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ আশাবাদী ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন। তিনি বলেন, বণিক বার্তার র‍্যাংকিংয়ে বরাবরই ডাচ্-বাংলা ব্যাংক দেশসেরা ছিল। এবারো ভালো কিছু হবে, এমনটাই প্রত্যাশা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত হয়নি দেখে হতাশ নই। যে কয়েকটি সূচকে ২০২১ সালে ডাচ্-বাংলা পিছিয়ে ছিল, চলতি বছরে তার সবক’টিতেই উন্নতি হবে। আশা করছি, আবারো আমরা দেশসেরা ব্যাংকের স্বীকৃতি পাব।

২০২১ সালের র‍্যাংকিংয়ে সবচেয়ে বড় চমক ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড। ২০২০ সালের র‍্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়া ব্যাংকটি এবার এক লাফে পাঁচ ধাপ উন্নতি করেছে। ৭০-এর স্কেলে ট্রাস্ট ব্যাংকের এবারের র‍্যাংকিং চতুর্থ। আর ৫০-এর স্কেলে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে ট্রাস্ট ব্যাংক। র‍্যাংকিংয়ের পাশাপাশি প্রাপ্ত নম্বরও বেড়েছে ব্যাংকটির।

র‍্যাংকিংয়ের ফলাফল অনুপ্রাণিত করবে - হুমায়রা আজম

সাতটি নির্দেশকে ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রাপ্ত নম্বর ৩১ দশমিক ৫৬। ২০২০ সালে সাত নির্দেশকে ২৫ দশমিক ১৩ নম্বর পেয়েছিল ব্যাংকটি। অন্যদিকে পাঁচ নির্দেশকে এবার ২৬ দশমিক ২৫ নম্বর পেয়েছে ট্রাস্ট ব্যাংক, যা ২০২০ সালে ছিল ২০ দশমিক ৫৯। ট্রাস্ট ব্যাংক শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে শাখাপ্রতি মুনাফার সূচকে ভর করে। এ সূচকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ব্যাংকটি। খেলাপি ঋণের হার, সিএআরে ভালো অবস্থানে আছে ট্রাস্ট ব্যাংক। তবে আরওএ, নিট মুনাফা ও এনএভিপিএসের দিক থেকে পিছিয়ে আছে ব্যাংকটি।

এবারের র‍্যাংকিংয়ে বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংকের। ২০২০ সালে পিছিয়ে পড়া ব্যাংকটি এবার ৭০ স্কেলের র‍্যাংকিংয়ে পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে। আর ৫০ স্কেলের র‍্যাংকিংয়ে চতুর্থ স্থান পেয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংক। র‍্যাংকিংয়ে উন্নতির পাশাপাশি প্রাপ্ত নম্বরও বেড়েছে ব্যাংকটির। খেলাপি ঋণের নিম্নহারের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে সেরা ব্যাংক প্রিমিয়ার। ২ দশমিক ৭১ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে ব্যাংকটির অবস্থান সবার শীর্ষে। খেলাপি ঋণের সর্বনিম্ন হারের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পূবালী ব্যাংক। আর এক্ষেত্রে তৃতীয় স্থান যমুনা ব্যাংকের। প্রিমিয়ার ব্যাংকের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হলো এনএভিপিএস, সিএআর ও নিট মুনাফা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রিমিয়ার ব্যাংকের উপদেষ্টা মুহাম্মদ আলী বলেন, প্রিমিয়ার ব্যাংক ধারাবাহিক উন্নয়নের পথে রয়েছে। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রেখে আমরা ব্যবসা সম্প্রসারণ করছি। করপোরেট ঋণের তুলনায় রিটেইল ও এসএমই খাতকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় প্রিমিয়ার ব্যাংকের ভিত এখন অনেক বেশি মজবুত। আগামীতে আমরা আরো ভালো অবস্থানে যাব।

টানা তিন বছর ধরেই র‍্যাংকিংয়ে অবনমনের পথে হাঁটছে ব্র্যাক ব্যাংক। ৭০ ও ৫০—দুটি স্কেলেই নিজের অবস্থান হারিয়েছে ব্যাংকটি। সাত নির্দেশকভিত্তিক র‍্যাংকিংয়ে আগেরবার চতুর্থ স্থানে থাকা ব্র্যাক ব্যাংক এবার ষষ্ঠ স্থানে নেমে গিয়েছে। পাঁচটি নির্দেশকের র‍্যাংকিংয়ে ব্যাংকটির এবারের অবস্থান ১৪তম, যেখানে গত বছরের র‍্যাংকিংয়ে অবস্থান ছিল অষ্টম। র‍্যাংকিংয়ে অবস্থান হারালেও দুই স্কেলেই স্কোর বেড়েছে বাজার মূলধনে দেশের সবচেয়ে বড় এ ব্যাংকটির।

আগেরবার সাতটি নির্দেশকে ব্র্যাক ব্যাংকের সার্বিক স্কোর ছিল ২৭ দশমিক ৯৮। এবারের র‍্যাংকিংয়ে ব্যাংকটির স্কোর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ১৮। পাঁচ নির্দেশকের সার্বিক স্কোর আগেরবারের ২০ দশমিক ২৯ থেকে বেড়ে এবার দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৪২। শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য ও নিট মুনাফায় ভালো অবস্থানে থাকলেও ব্র্যাক ব্যাংকের পারফরম্যান্স দুর্বল হয়েছে মূলত আরওই, সিএআর ও খেলাপি ঋণের হারের কারণে।

ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্র্যাক ব্যাংককে আর্থিক সূচকগুলো দিয়ে পরিমাপ করলে সেটি ন্যায়বিচার হবে না। ব্র্যাক ব্যাংকের ঋণ পোর্টফোলিওর ৫৩ শতাংশ এসএমই খাতে। এ খাতের ঋণ বিতরণ, তত্ত্বাবধান ও আদায় প্রক্রিয়ায় বেশি ব্যয় হয়। ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদ ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়ায় এ খাত থেকে মুনাফা করতে পারছে না ব্র্যাক ব্যাংক। আর পুরনো কিছু ঋণ খেলাপি হওয়ায় এর জের টানতে হচ্ছে। অন্য ব্যাংকগুলো এ ধরনের ঋণ পুনঃতফসিল করে দিলেও আমরা সে পথে হাঁটিনি। ব্র্যাক ব্যাংক কঠোরভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে চলে। এ কারণে হিসাবায়নের ক্ষেত্রে শতভাগ স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়।

গত বছরের তুলনায় ১০ ধাপ এগিয়ে এ বছর র‍্যাংকিংয়ের সপ্তম স্থানে উঠে এসেছে প্রাইম ব্যাংক। সাতটি নির্দেশকে ব্যাংকটির গত বছরের স্কোর ২২ দশমিক ৯২ থেকে বেড়ে এবার ২৭ দশমিক ৯৯-এ দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে পাঁচটি নির্দেশকের ভিত্তিতে করা র‍্যাংকিংয়ে প্রাইম ব্যাংক গত বছরের তুলনায় ছয় ধাপ এগিয়ে এবার ষষ্ঠ অবস্থানে উঠে এসেছে। এ বছর ব্যাংকটির স্কোর দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ১২, যা গত বছর ছিল ১৮ দশমিক ৫৮। সিএআরে শীর্ষে থাকলেও খেলাপি ঋণ, এনএভিপিএস, আরওই ও আরওএতে পিছিয়ে আছে প্রাইম ব্যাংক।

গত বছরের চেয়ে পাঁচ ধাপ এগিয়ে ২৭ দশমিক ১২ স্কোরের ভিত্তিতে সাতটি নির্দেশকের র‍্যাংকিংয়ে এবার অষ্টম স্থান অর্জন করেছে ব্যাংক এশিয়া। যেখানে গত বছর ২৪ দশমিক ৪৯ স্কোরের ভিত্তিতে ১৩তম স্থানে ছিল ব্যাংকটি। পাঁচটি নির্দেশকের র‍্যাংকিংয়ে আগেরবারের নবম স্থান থেকে উন্নীত হয়ে এবার সপ্তম স্থানে উঠে এসেছে ব্যাংকটি। এবার ব্যাংকটির স্কোর দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক শূন্য ৬, যা গত বছর ছিল ২০ দশমিক ১৩। ওপিবি ও সিএআরের দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও খেলাপি ঋণ, এনএভিপিএস, আরওএ, আরওইতে পিছিয়ে রয়েছে ব্যাংকটি।

র‍্যাংকিংয়ে বেশ বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের। গত বছর ২২তম স্থানে থাকা ব্যাংকটি এবার নবম স্থানে উঠে এসেছে। ২০২১ সালে ব্যাংকটির স্কোর দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৭৩, যা আগের বছর ছিল ২০ দশমিক ৯৯। পাঁচটি নির্দেশকের ভিত্তিতে করা র‍্যাংকিংয়ে মার্কেন্টাইল ব্যাংক গতবারের ২১তম স্থান থেকে এবার ১২তম স্থানে উঠে এসেছে। আগেরবারের স্কোর ১৬ দশমিক ৫১ থেকে বেড়ে এবার ২০ দশমিক ৭৭-এ দাঁড়িয়েছে। আরওএ, আরওই ও নিট মুনাফার দিক দিয়ে শীর্ষ দশে থাকলেও ওপিবি, এনএভিপিএস, সিএআর ও খেলাপি ঋণের বিবেচনায় পিছিয়ে রয়েছে ব্যাংকটি।

২০২১ সালের র‍্যাংকিংয়ে বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়েছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের। ৭০ স্কেলের র‍্যাংকিংয়ে ২০২০ সালে ২৪তম স্থানে ছিল ব্যাংকটি। কিন্তু এবার দশম স্থানে উঠে এসেছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট। এবার ব্যাংকটির প্রাপ্ত নম্বর ২৬ দশমিক ৩৮। ২০২০ সালে ব্যাংকটির প্রাপ্ত নম্বর ছিল ১৭ দশমিক ৫৭।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ২০২১ সালে আমরা প্রতিটি সূচকেই ভালো করেছি। বণিক বার্তার র‍্যাংকিংয়ে বড় ধরনের উন্নতি সেটিরই প্রমাণ। চলতি বছর আমরা আরো ভালো অবস্থানে যেতে পারব।

সেরা ব্যাংকের তালিকায় ২০২১ সালের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে করা এবারের সাতটি নির্দেশকের র‍্যাংকিংয়ে গতবারের ১৮তম স্থান থেকে উন্নীত হয়ে ১১তম স্থানে দাঁড়িয়েছে এনসিসি ব্যাংক। অন্যদিকে পাঁচটি নির্দেশকের ভিত্তিতে করা র‍্যাংকিংয়ে ব্যাংকটি গতবারের ১৫তম স্থান থেকে এবার নবম স্থানে উঠে এসেছে। সিএআরের বিবেচনায় ব্যাংকটি দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। তবে পিছিয়ে আছে এনএভিপিএস ও নিট মুনাফায়।

সাতটি নির্দেশকের র‍্যাংকিংয়ে গতবারের অষ্টম অবস্থান থেকে নেমে এবার ১২তম স্থানে দাঁড়িয়েছে পূবালী ব্যাংক। অন্যদিকে পাঁচটি নির্দেশকের র‍্যাংকিংয়ে গতবারের ১৬তম থেকে এবার ১৭তম স্থানে নেমে গেছে ব্যাংকটি। খেলাপি ঋণ, এনএভিপিএস ও নিট মুনাফায় এগিয়ে থাকলেও পূবালী ব্যাংক ওপিবি, আরওই, আরওএ এবং সিএআরের দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে।

সম্পদ ও দায়ের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক হলো ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির দায় ও ইকুইটির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। আর্থিক অবয়বের তুলনায় মুনাফা কম হওয়ায় ব্যাংকটি বেশির ভাগ নির্দেশকেই পিছিয়ে পড়েছে। আরওএ, আরওই, সিএআর, শাখাপ্রতি পরিচালন মুনাফার দিক থেকে পিছিয়ে থাকায় র‍্যাংকিংয়ে অবনমন হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের। ২০২১ সালের র‍্যাংকিংয়ে দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংকটির অবস্থান ১৩তম। যদিও আগের বছরের র‍্যাংকিংয়ে ষষ্ঠ স্থানে ছিল ইসলামী ব্যাংক।

ইসলামী ব্যাংকের সবচেয়ে শক্তির জায়গা হলো নিট মুনাফা ও এনএভিপিএস। এ দুটি নির্দেশকে ব্যাংকটির অবস্থান সব ব্যাংকের মধ্যে তৃতীয়। আর খেলাপি ঋণের নিম্নহারের দিক থেকে চতুর্থ স্থানে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের আরওএ ২৫তম, আরওই ২১তম। সিএআরের দিক থেকে ব্যাংকটির অবস্থান ২২তম।

এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, ইসলামী ব্যাংক দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক। জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের চূড়ায় থাকায় ব্যাংকটি আজকের অবস্থানে এসেছে। আমাদের ব্যাংকের মূলধন, সম্পদ ও ইকুইটির আকার অনেক বড়। ফলে এ দুটি সূচকে ইসলামী ব্যাংক পিছিয়ে যায়। আমরা মানবিক ব্যাংকিংয়ে বিশ্বাসী। ব্যাংকিংকে ব্যবসা হিসেবে না দেখে আমরা মানবসেবা হিসেবে দেখি। এ কারণে ইসলামী ব্যাংক প্রথাগত মুনাফার পেছনে ছোটে না। তবে আশা করছি, ভবিষ্যতে ইসলামী ব্যাংকের সূচকগুলোর উন্নতি হবে।

২০২১ সালের সেরা ব্যাংকের র‍্যাংকিংয়ে সিএআর ও আরওইতে ভালো করায় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ২১ থেকে ১৬, ওপিবি ও নিট মুনাফার কারণে আইএফআইসি ব্যাংক ২৮ থেকে ২৩ এবং ওপিবি, এনএভিপিএস ও নিট মুনাফার কারণে এসআইবিএল ২৬ থেকে ২৪তম স্থানে উঠে এসেছে। অন্যদিকে ওপিবি, নিট মুনাফা, আরওএ এবং আরওইর কারণে ঢাকা ব্যাংক ১০ থেকে ১৪; ওপিবি, নিট মুনাফা ও আরওইর কারণে যমুনা ব্যাংক ৫ থেকে ১৫; সিএআর, এনএভিপিএস, ওপিবি, আরওএ ও খেলাপি ঋণের কারণে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১৬ থেকে ১৭; আরওই, আরওএ ও নিট মুনাফার কারণে সাউথইস্ট ব্যাংক ১২ থেকে ১৮; আরওই, আরওএ, সিএআর ও নিট মুনাফার কারণে ইউসিবি ১৫ থেকে ২০; নিট মুনাফা, ওপিবি, আরওএ, আরওই ও খেলাপি ঋণের কারণে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ১১ থেকে ২১; আরওএ, আরওই, এনএভিপিএস ও নিট মুনাফার কারণে এক্সিম ব্যাংক ১৪ থেকে ২২; আরওএ, খেলাপি ঋণ ও এনএভিপিএসের কারণে ওয়ান ব্যাংক ২৩ থেকে ২৬তম অবস্থানে নেমে গিয়েছে। আর সব নির্দেশকেই পিছিয়ে থাকায় এনবিএলের অবস্থান ২০ থেকে ২৮তম হয়েছে। এবারের র‍্যাংকিংয়ে অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে উত্তরা ব্যাংক (১৯), এবি ব্যাংক (২৫), স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক (২৭), রূপালী ব্যাংক (২৯) ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের (৩০)।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন