যুবক-ডেসটিনির বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া চলমান

চাপা পড়েছে বেশির ভাগ এমএলএম প্রতারণার ঘটনা

জেসমিন মলি

নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে দেশে নতুন এক ধরনের ব্যবসার উদ্ভব হয়। সেখানে গ্রাহককে অস্বাভাবিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ সংগ্রহ করা হতো। শুরুতে কিছুদিন মুনাফা দেয়া হলেও এক পর্যায়ে গ্রাহকের সব অর্থ নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যেত প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনই একটি প্রতিষ্ঠানের নাম যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (যুবক) ১৯৯৭ সালে এর যাত্রা শুরু হয়। সে সময় আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান একই ধারার ব্যবসায়িক মডেল নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এরপর ২০০০ সালে দেশে ব্যবসার এক নতুন মডেল নিয়ে হাজির হয় মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম কোম্পানি ডেসটিনি ২০০০

অল্প সময়ের মধ্যে নেটওয়ার্কিং সম্প্রসারণ করে গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় যুবক ডেসটিনি ২০০০। পরে অবশ্য তাদের প্রতারণা অর্থ আত্মসাতের নানা চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। মামলা, ধরপাকড়, কার্যালয় সিলগালা, সম্পদ বাজেয়াপ্তের মতো ধারাবাহিক ঘটনাও ঘটে। যুবক বা ডেসটিনি বিষয়ে এসব আইনি পদক্ষেপ চলমান থাকলেও আড়ালে রয়ে গেছে প্রতারিত গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়টি। দুই প্রতিষ্ঠানের কিছু সম্পদ জব্দ করা গেলেও সমসাময়িক অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের অর্থসহ লাপাত্তা হয়ে গিয়েছে।

দুটি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ইউনিপেটুইউ, লাইফওয়ে বাংলাদেশ, নিউওয়ে, প্রাইম মাল্টিপারপাস, রূপসা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটিসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকদের বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বা গ্রাহকরা আদৌ অর্থ ফেরত পাবেন কিনা, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, তদন্তকাজ শেষই হয়নি। এক পর্যায়ে চাপা পড়ে গিয়েছে এসব ঘটনা। কেবল যে গ্রাহকরা প্রতারিত হয়েছেন, তাদেরই মনে আছে ঘটনার ক্রম। কেউ কেউ হয়তো এখনো আশায় বুক বেঁধে রেখেছেন, কোনো না কোনোদিন ফেরত পাবেন সেই অর্থ।

ডেসটিনি যুবকসহ বিভিন্ন এমএলএম কোম্পানির প্রতারণার শিকার গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও সেগুলোর ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক অগ্রগতির দেখা মেলেনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ডেসটিনির বিরুদ্ধে প্রায় হাজার ৮৬১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ পাচারের অভিযোগে মামলা করে। পরে যখন অভিযোগপত্র দেয়া হয়, তখন সেই টাকার পরিমাণ হাজার কোটি ছাড়িয়ে যায়।

এমএলএম কোম্পানির প্রতারণার লাগাম টেনে ধরতে ২০১৩ সালে নতুন আইন করে সরকার। সেই আইনের আওতায় ২৬টি কোম্পানি লাইসেন্সের আবেদন করেছিল। এর মধ্যে সাতটিকে লাইসেন্স দেয়া হলেও নবায়নের শর্ত ভঙ্গ করায় পরবর্তী সময়ে কোনোটিরই লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি।

সম্প্রতি অর্থ আত্মসাৎ পাচারের দায়ে বহুস্তর বিপণন প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীন, সভাপতি সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হারুন-অর-রশিদসহ ৪৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে রফিকুল আমীনকে ১২ বছর কারাদণ্ড ২০০ কোটি টাকা জরিমানা এবং হারুন-অর-রশিদকে চার বছরের কারাদণ্ড সাড়ে কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। অন্য আসামিদেরও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড জরিমানা ধার্য করেন আদালত।

আদালতের রায়ে ডেসটিনির ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের অর্থ ফিরিয়ে দিতে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতির নেতৃত্বে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করতে সরকারকে নির্দেশনা দেয়া হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, ডেসটিনির ৫৬০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ আছে। আসামিদের দেয়া জরিমানা থেকেও গ্রাহকদের অর্থ পরিশোধ করা হবে। তবে রায়ের সার্টিফায়েড কপি এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কপি হাতে পাওয়া গেলে আদেশ অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ডেসটিনির মোট গ্রাহক ছিল ৩৫ লাখ। দুদকের তদন্ত অনুযায়ী, বর্তমানে ডেসটিনির মোট স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের আর্থিক মূল্য ৫৯০ কোটি ৩৩ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে রফিকুল আমীনসহ ৩৫ আসামির ব্যাংকে রয়েছে ৮৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা। গ্রাহকদের ডেসটিনি থেকে পাওনা অন্তত ১৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সব মিলিয়ে যে অর্থ প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে রয়েছে তার চেয়ে গ্রাহকের পাওয়া আরো ১৩ হাজার কোটি টাকা বেশি।

যুবকের সম্পত্তি সরকারি হেফাজতে গ্রহণ, রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা বিক্রয়পূর্বক প্রকৃত গ্রাহকদের দেনা-পাওনা (আসল টাকা) পরিশোধের বিষয়ে সিনিয়র সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাপতিত্বে ২০১৪ সালের ২১ আগস্ট আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভার সিদ্ধান্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালক, বাণিজ্য সংগঠনকে আহ্বায়ক করে নয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে একটি উপায় বের করার জন্য তিনটি সভা করে। আইন, বিচার সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সেসব সভার সারসংক্ষেপ সেখানে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয়ও বিষয়ে তাদের মতামত দেয়। সেই মতামতের পরিপ্র্রেক্ষিতে যুবক- রিসিভার নিয়োগের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নীতিগত অনুমোদনে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন চেয়ে একটি খসড়া পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রী সারসংক্ষেপে এসব বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার নির্দেশনা দেন।

এরপর অর্থ মন্ত্রণালয়ে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ২০১৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর একটি সভার নোটিস জারি করা হয়। তবে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিনা, সে বিষয়ে কোনো তথ্য মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত নেই। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বা অর্থমন্ত্রী কী মতামত দিয়েছেন সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কাছে কোনো তথ্য নেই।

যুবক ডেসটিনির বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাওয়া গেলেও অন্যান্য এমএলএম কোম্পানি থেকে প্রতারিত গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। জাতীয় সংসদে -সংক্রান্ত এক প্রশ্নোত্তরে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, প্রতারিত গ্রাহকরা যেন টাকা ফেরত পান, সেজন্য সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ চলমান। একটি মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে। সেই মামলার সার্টিফায়েড কপি হাতে পাওয়া গেলে আদালতের আদেশ অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন