নতুন অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা

সতর্ক থাকতে হবে, প্রয়োজনে যথোপযুক্ত ব্যবস্থাও নিতে হবে

মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে অর্থের জোগান আরো কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রেপো (পুনঃক্রয় চুক্তি) সুদহার আরো এক দফা বাড়িয়ে নতুন অর্থবছরের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি। টাকার অভ্যন্তরীণ বাহ্যিক মান অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বিনিময়হার স্থিতিশীল রাখাই হবে নতুন অর্থবছরের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ। এবার নীতি সুদহার বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে ব্যাংকগুলোকে বেশি সুদ দিতে হবে। এতে সস্তা টাকার দিন শেষ হয়ে আসবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজে আসবে। আর আমদানি বিকল্প পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে নতুন পুনঃঅর্থায়ন স্কিম চালুর ঘোষণা দিয়েছেন গভর্নর। পাশাপাশি বিলাসদ্রব্য যেমন বিদেশী ফল, অশস্য খাদ্যপণ্য, টিনজাত প্রক্রিয়াজাত পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ৭৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত মার্জিন আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। এতে ডলারের ওপর চাপ কমবে, যার বদৌলতে সুরক্ষিত রাখবে রিজার্ভ মুদ্রার বিনিময়হার। মুদ্রানীতিটি এক বছরের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে সময় অনুযায়ী প্রয়োজনে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে করে একদিকে তারল্যের প্রবাহে অর্থনীতির চাকা সচল রাখে, অন্যদিকে বেশি তারল্য যেন ক্ষতিকর না হয়।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি প্রণয়ন প্রকাশ করে। দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মুদ্রানীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে এর একটি পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। নতুন অর্থবছরের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। তবে মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু উপকরণ ব্যবহার ছাড়া তেমন কোনো করণীয় নেই। যে কয়েকটি উপকরণ রয়েছে, তার অন্যতম প্রধান হলো টাকার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে কম হারে ঋণ দেয়া। এজন্য আগামী অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা থেকে কমিয়ে আনা হয়েছে। দেখার বিষয় আগামী দিনগুলোয় এটি কতটা কাজ করে। কথা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশ মুদ্রানীতির প্রাথমিক তিনটি লক্ষ্য থাকে। এর মধ্যে রয়েছেমূল্য স্থিতিশীল রাখা, টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন কর্মসংস্থান সৃষ্টি। গত অর্থবছরগুলোয় মুদ্রানীতি বাংলাদেশ ব্যাংক অত্যন্ত সুচারুভাবে ঘোষণা দিতে সক্ষম হয়েছে। কারণ, তিন লক্ষ্য বাস্তবায়নে মুদ্রা ঋণের প্রয়োজনীয় প্রবৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে। তবে সাম্প্রতিককালে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতে। এর অংশ হিসেবে ঘোষিত মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে বেশ কিছুটা হোঁচট খেয়েছে। এর পরও বর্তমান গভর্নরের বিচক্ষণতা দূরদর্শিতায় অর্থনৈতিক গতি-প্রকৃতি সামাল দেয়া সম্ভব হয়েছে। কভিড অতিমারী থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি কমাতে মুদ্রা ঋণ খাতে বেশকিছু তাত্ক্ষণিক সময়োপযোগী নীতি গ্রহণ করেছিল, যা প্রশংসার দাবি রাখে। সরকারের ঘোষণা করা প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সহজ করা ছিল অন্যতম চাবিকাঠি।

অর্থনীতিতে মহামারীর নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে  ভারত গত দুই বছরে বেশ কয়েকটি সহায়ক নীতি গ্রহণ করে। যেমন, ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক বেঞ্চমার্ক সুদের হার শতাংশে নামিয়ে এনেছে এবং এতে দেশটির আর্থিক ব্যবস্থায় তারল্য বেড়েছে। পাশাপাশি, ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় একটি কার্যকর সম্প্রসারণমূলক রাজস্বনীতি গ্রহণ করেছে। এসব নীতির সমর্থনে, ভারতীয় অর্থনীতি মূলত তার প্রাক-মহামারী স্তরে পুনরুদ্ধার হয়েছে। ফেব্রুয়ারির শেষে ভারতের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত সামষ্টিক অর্থনীতির পূর্বাভাস দেখায় যে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারতের জিডিপি ২০১৯- ২০ অর্থবছরের প্রাক-মহামারী স্তরকে ছাড়িয়ে গেছে। মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ গত ১৬ মার্চ ঘোষণা করেছে যে, তারা সুদের হার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে .২৫ শতাংশ থেকে . শতাংশে উন্নীত করবে। ২০২০ সালের মার্চ থেকে মহামারীর প্রতিক্রিয়া ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমিয়েছিল। ফেডারেল রিজার্ভের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান জেরোমি পাওয়েল সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং শিথিল আর্থিক নীতির পরিবেশে, ফেড মে মাসে তার নিয়মিত মুদ্রানীতি সভায় সুদের হার বাড়াতে পারে। ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বৃদ্ধির এক নতুন রাউন্ড শুরু করেছে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে বৃহত্তর অস্থিরতার ঝুঁকি নিয়ে আসবে বলে শঙ্কা রয়েছে এবং উদীয়মান অর্থনীতি এতে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। উন্নত দেশগুলোতে আর্থিকনীতির স্বাভাবিকীকরণের গতিতে পরিবর্তন নিয়ে বৈশ্বিক আর্থিক বাজারগুলো অস্বস্তিতে রয়েছে। বেশির ভাগ উদীয়মান বাজার অর্থনীতি পুঁজির বহিঃপ্রবাহ বেকায়দায় আছে। গত ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত, ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ টানা ছয় সপ্তাহ ধরে হ্রাস পেয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বৃদ্ধি এবং রাশিয়া ইউক্রেনের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশের অবনতি হওয়ায় বিদেশী বিনিয়োগকারীরা টানা ছয় মাস ভারতীয় স্টক বিক্রি করেছেন। শুধু বছরের মার্চে, বিদেশী প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ভারতীয় স্টক থেকে ৪১০ বিলিয়ন রুপি প্রত্যাহার করেছেন, যা বাজারে অস্থিরতা যোগ করেছে। এখন ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে অর্থ প্রবাহের রাশ টানতে চাইছে। দেশটিতে এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিট অতিক্রম করেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আগে থেকেই সতর্ক অবস্থা গ্রহণ করেছে, যা ইতিবাচক।

আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ঋণের মানের অবক্ষয়। অনাদায়ী বা বিলোপিত ঋণের ক্ষয়ক্ষতি মেটানোর বাধ্যবাধকতার কারণে সুদের হার বাড়িয়ে রাখতে হয়। কিছু লোক ঋণ নিয়ে সময়মতো পরিশোধ করে না। কেউ কেউ আদৌ পরিশোধ না করার কৌশল নেয়। এটা ব্যাংক খাতে শুধু নয়, সার্বিক অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। আমরা দেখছি, বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ ঋণ অনাদায়ী। যেহেতু ব্যাংকগুলোকে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হয়, তারা সুদের হার বৃদ্ধি না করে পারে না। এর দায় চাপে ভালো ঋণগ্রহীতাদের ওপর। সুদের হার কমানোর সঙ্গে ব্যাংক খাতের সুশাসন দক্ষতা বিশেষভাবে বিবেচ্য বিষয়। এক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই সুশাসনে নজর দিতে হবে এবং দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্ল্যাসিফায়েড বা শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। কাজটি করতে হবে খুবই দ্রুত। এছাড়া বাংলাদেশের বিদ্যমান প্রবৃদ্ধির গতিকে যদি মুদ্রানীতির মাধ্যমে সহায়তা করতে হয়, তাহলে মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতা এবং ঋণমানের গুণগত উন্নতি অবশ্যই প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককেই আরো কার্যকর পন্থা গ্রহণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য, বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদন ক্ষমতা কর্মসংস্থান সৃষ্টি। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। এতে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অস্ত্র হলো মুদ্রানীতি। মুদ্রানীতির দুটি বাহক হচ্ছে সুদ আর বিনিময়হার। দুটিই এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে নেই। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্য কোনো উদ্যোগও কাজে আসছে না। আবার এখন যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে, তা সরবরাহজনিত। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে বিশ্বের পণ্যবাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। ফলে দেশী উদ্যোগও কাজে আসছে না। দেখার বিষয় এবারের মুদ্রানীতি কতটা ফলপ্রসূ হয়।

সরকার বাজেটে যে নীতি উন্নয়ন কর্মসূচি ঠিক করে, তা বাস্তবায়নে সহায়ক আর্থিক পরিবেশ সৃষ্টি এবং নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে অর্থের প্রবাহ ঠিক রাখাই মুদ্রানীতির লক্ষ্য। এমনভাবে নীতি সাজানো হয়, যাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নে বছরের পুরো সময়টায় বাজারে অর্থপ্রবাহ আঙ্গিক কেমন হবে, তাও মুদ্রানীতিতে ঠিক করে দেয়া হয়। আগামী অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতিতে ব্যাপক মুদ্রা (এম২) প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমিয়ে ধরা হয়েছে ১২ দশমিক শতাংশ, গতবার সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫ শতাংশ; চলতি জুন পর্যন্ত এর দশমিক শতাংশ অর্জিত হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেটে সরকার মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) দশমিক শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি দশমিক শতাংশ ধরে রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে।

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়াতে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা ঋণ বরাদ্দ রয়েছে, যার বড় অংশ বিতরণ হয়েছে। এসব টাকা ব্যাংকে ফেরত আনা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এর পরিবর্তে আরো ঋণ দেয়ার লক্ষ্য ঠিক করলে তা অর্থনীতির জন্য বুমেরাং হতে পারে। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণ বন্ধ করে খাত নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ প্রয়োজন। এখন জিডিপির সংখ্যা ভুলে গিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করা উচিত। এজন্য বেসরকারি ঋণের প্রবাহ কমাতে হবে, সরকারকেও কম খরচ করতে হবে। আমদানিনির্ভর বড় প্রকল্পগুলোর গতি কমিয়ে দিতে হবে। পাশাপাশি সুদহার ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে এমনিতেই চাহিদা কমে আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি জিডিপিকে প্রাধান্য দিয়েই মুদ্রানীতি পরিচালনা করে, তবে সেটি হবে বড় ভুল। এতে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে, যার মাশুল দিতে হবে পুরো দেশকে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন