ফজলে কবিরের শেষ মুদ্রানীতি ঘোষণা

মূল্যস্ফীতি ও টাকার মান ধরে রাখার চ্যালেঞ্জে জয়ী হতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি আর ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখার চাপে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের শুরু থেকেই বাজারে নিত্যব্যবহার্য প্রায় সব পণ্যেরই দাম বেড়েছে। ফলে মে মাসে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ঠেকেছে দশমিক ৪২ শতাংশে। অন্যদিকে রেকর্ড আমদানি দায় পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে দেশের ব্যাংক খাত। ফলে প্রতিনিয়ত ডলারের বিপরীতে মান হারাচ্ছে বাংলাদেশী মুদ্রা। ২০২১ সালের জুনে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৪ টাকা ৮১ পয়সা। চলতি বছরের জুনে এসে প্রতি ডলারের মূল্য ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা ছুঁয়েছে। যদিও খুচরা বাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকারও বেশি দরে। পরিস্থিতিতেই ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে টাকার অভ্যন্তরীণ বাহ্যিক মান অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখাই হবে মুদ্রানীতির মূল চ্যালেঞ্জ। আর চ্যালেঞ্জে জয়ী হতে ঘোষণা করা হয়েছে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বাজারে টাকার সরবরাহ হ্রাসের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য বাড়ানো হয়েছে নীতিহার হিসেবে বিবেচিত রেপোর সুদহার। দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে রেপোর সুদহার দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। জোর দেয়া হয়েছে আমদানি বিকল্প পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোয়। এজন্য নতুন নতুন পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বিলাসপণ্য, বিদেশী ফল অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির লাগাম টানতে এলসি মার্জিন বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে মুদ্রানীতিতে। মূল্যস্ফীতি টাকার মান ধরে রাখতে এসব কর্মসূচি ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

২০১৬ সালের ২০ মার্চ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করছেন ফজলে কবির। ছয় বছরের বেশি গভর্নর পদে দায়িত্ব পালন শেষে জুলাই অবসরে যাচ্ছেন তিনি। গভর্নর হিসেবে ফজলে কবিরের শেষ মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয় গতকাল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ২০২২-২৩ অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। করোনাভাইরাসের কারণে এর আগের দুই অর্থবছরের মুদ্রানীতি প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছিল।

আগামী অর্থবছরের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৩ দশমিক শতাংশ অর্জিত হয়েছে। যদিও গত দুই অর্থবছরেই খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের নিচে ছিল। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল ভূমিকায় থাকলেও সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে উদার দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩৬ দশমিক শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ মাস তথা জুন পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলিত হয়েছে ২৭ দশমিক শতাংশ।

মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, কভিড-১৯-এর অনাকাঙ্ক্ষিত অভিঘাত ভূরাজনৈতিক সংকটে বর্তমান বিশ্ব এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছে। সফলভাবে কভিডের টিকাদান থেকে শুরু করে অন্যান্য কর্মসূচির কারণে যখন বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল, ঠিক তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ২০২১ সালের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক পণ্যবাজার আরো বেশি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সর্বশেষ প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০২২ সালে উন্নত দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি হবে দশমিক শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির হার দশমিক শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরো অঞ্চল ভারতের মতো অনেক উন্নত উন্নয়নশীল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির পথ অনুসরণ করেছে।

গভর্নর তার লিখিত বক্তব্যে বর্তমান পরিস্থিতিতে মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের অন্তরায় চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেন। কভিডের অভিঘাত মোকাবেলায় সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেয়া পদক্ষেপের

কথা উল্লেখ করে ফজলে কবির বলেন, ২০২০ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সরকার কর্তৃক লাখ হাজার ২৯ কোটি টাকার ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে লাখ ৬৮ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ১০টি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি যুক্ত ছিল।

অনুষ্ঠানে গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশ্নের জবাবে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে দশমিক বিলিয়ন ডলার কিনে নিয়েছিল। বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে এটি করতে হয়েছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছরে রেকর্ড আমদানি দায় পরিশোধের চাপের কারণে বাজারে দশমিক বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। হিসাবে বলা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির চেয়ে বাজার থেকে বেশি কিনেছে।

গভর্নর পদে দায়িত্ব পালনের সময় কতটা স্বাধীনতা ভোগ করেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ফজলে কবির বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি মানুষের জন্য যেটি সঠিক মনে হয়েছে, সে সিদ্ধান্তই নিয়েছি। আমার মেয়াদে যে কয়টি নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে, তার প্রতিটিই পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের সুপারিশ সত্ত্বেও একটি ব্যাংকের লাইসেন্স না দিয়ে প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সরকার কিংবা অন্য কোনো পক্ষ থেকে আমি চাপ অনুভব করিনি।

মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, কাজী ছাইদুর রহমান, একেএম সাজেদুর রহমান খান, আবু ফরাহ মো. নাছের, বিএফআইইউর প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস, প্রধান অর্থনীতিবিদ . হাবিবুর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্বাহী পরিচালক, পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন