ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি

জমেনি ‘দার্জিলিং জমজমাট’

মাহমুদুর রহমান

ফেলুদা পর্দায় ফিরলেন আবার। এবারো পরিচালক সৃজিত মুখার্জির হাত ধরে। গত এক দশকে কলকাতায় থ্রিলার সিনেমা নির্মাণের হিড়িক পড়েছিল যা গত কয়েক বছরে আরো বেড়েছে। ওটিটি আসার পর সিনেমার পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে ওয়েব সিরিজ। এর মধ্যে ব্যোমকেশকে নিয়ে সিরিজ হয়েছে। ফেলুদা বাদ থাকে কেন! সৃজিত মুখার্জি সে দায়িত্বটা নিলেন এবং নির্মাণ করেছিলেন ফেলুদা ফেরত। সব্যসাচী চক্রবর্তীর পর ফেলুদার চারমিনার উঠেছিল টোটা রায়চৌধুরীর হাতে। জটায়ুর চরিত্রে অনির্বাণ চক্রবর্তী এবং তোপসের চরিত্রে কল্পন মিত্র। আড্ডা টাইমসে মুক্তি পেয়েছিল সে সিরিজটি কিন্তু এবারের প্লাটফর্ম হইচই। ছয় পর্বের সিরিজের নাম দেয়া হয়েছে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি: দার্জিলিং জমজমাট ফেলুদা ফেরত রাখা যায়নি আড্ডা টাইমসের সঙ্গে আইনি জটিলটার কারণে।

নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে দার্জিলিং জমজমাটের প্লট কোথায়। পুলক ঘোষালের সিনেমার শুটিংয়ের দাওয়াত পেয়ে থ্রি মাসকেটিয়ার্স চলে গেলেন দার্জিলিং আর ফেলুদা যেখানে যাবেন সেখানে রহস্য থাকবে না, একটা কেস তার হাতে এসে পড়বে না এমন হতেই পারে না। তাই এখানে খুন হলেন বিরূপাক্ষ মজুমদার। তার বাড়িতেই হচ্ছিল সিনেমার শুটিং আর সেখানে ঘটনাচক্রে লালমোহন বাবুও একজন অভিনেতা। খুনের আগে বিরূপাক্ষের বাড়িতে তারই শোনা একটা কথা এই কেসের বড় একটা ক্লু।

সৃজিত মুখার্জির আর যে সমস্যাই থাকুক না কেন, সিনেমা বা সিরিজে কিছু নান্দনিকতা তিনি রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু দিনে দিনে সেটাও ক্লিশে হয়ে যাচ্ছে। দার্জিলিং জমজমাটে দার্জিলিং শহরটার তেমন কোনো উপস্থাপনা নেই। ফেলুদা, জটায়ু, তোপসে যখন কেবল কারে করে ওপর থেকে শহর দেখে আর ঝাউবনের একটা দৃশ্য সেখানে কিছুটা ছাপ পাওয়া যায়। এর বাদে ম্যালের কয়েকটা বেঞ্চি দেখানো কলকাতার সিনেমায় এখন পানসে একটা ব্যপার। এর বাইরে আরেকটা দৃষ্টিকটু ব্যাপার হলো হইচইয়ের বেশকিছু সিনেমা আর সিরিজ একই বাড়িতে শুটিং হয়। কেবল বাড়ি নয়, নির্দিষ্ট করে বললে একটা বারান্দা। সৃজিতের ফান্ডের খুব একটা অভাব আছে বলে তো মনে হয় না। আরেকটু এক্সপ্লোর করার সুযোগ ছিল।

এক্সপ্লোর করার কথাটা এল কেননা সত্যজিৎ রায়ের গল্প তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করেছেন, ব্যাপারটা এমন না। বেশকিছু জায়গায় তিনি সরে গেছেন। নিজের মতো অনুষঙ্গ যোগ করেছেন। যতদূর মনে পড়ে সত্যজিৎ রায়ের গল্পে ব্যোমকেশের কোনো উল্লেখ ছিল না। কিন্তু সিনেমায় ব্যোমকেশের উল্লেখ করে তাকে ট্রিবিউট দেয়া হয়। এর আগে হইচইয়ের ব্যোমকেশ ফ্র্যাঞ্চাইজির চোরাবালি সিরিজে সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদাকে ট্রিবিউট দেয়া হয়েছিল অনির্বাণ ভট্টাচার্যের মুখ দিয়ে। এই ইন্টারকানেকশন ব্যাপারটা অনেকের ভালো লেগেছে আবার অনেকের মনে হয়েছে কোনো প্রয়োজন ছিল না।

মেকিংয়ের দিক থেকে দেখলে মনে হবে বড় পরিচালকেরা তাদের বড় বড় কাজের মাঝখানে কিছু খুচরা কাজ করেনকোনোমতে একটা গল্প খাড়া করে সেটা শুট করে ছেড়ে দেনএই সিরিজটা সে রকম। এক কালার প্যালেট বাদ দিলে কোনো কিছুই দেখার মতো না। আর সেই রঙটাও এমনভাবে দেয়া যে মনে হয় পুরোটা সময় সোনালি রোদ পড়ে আছে এবং সেটা খাদের পাশে রাস্তা থেকে বিরূপাক্ষের ঘরের ভেতর পর্যন্ত।

হইচই নির্দিষ্ট কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে কাজ করে। ফলে যাকে ব্যোমকেশ সিরিজে দেখা যায় তাকে ফেলুদার গল্পেও দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে অস্বস্তি লাগে অনির্বাণ চক্রবর্তীকে জটায়ুর চরিত্রে দেখতে। কেননা তিনি একেন বাবু চরিত্রেও অভিনয় করেন আর সেই চরিত্রটা অনেক জায়গায় তিনি কিংবা একেন সিরিজের পরিচালক জটায়ুর সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। জটায়ু চরিত্রে ভালো করতে অনির্বাণের চেষ্টার খামতি ছিল না সেটা বলতে হবে। আর ফেলুদা হিসেবে টোটা রায়চৌধুরীর উন্নতি হয়েছে আগের চেয়ে। এছাড়া তার লুক, সত্যজিতের স্কেচের সঙ্গে একেবারে মিলে যায় কিছু জায়গায়। কিন্তু তার অভিনয়গুণ ফুটিয়ে তুলতে পারেননি পরিচালক। এখনো তার কথা বলা, হাঁটাচলায় ফেলুদাকে মাঝে মাঝেই খুঁজে পাওয়া যায় না।

সন্দীপ রায়ের ফেলুদার পর সৃজিত হাত দিয়ে অনেকে ভালো কিছু আশা করেছিল। ভালো করা সম্ভবও ছিল কিন্তু শেরদিল, এক্স=প্রেম, সাবাস মিঠু, মৃণালের বায়োপিক আর শ্রীচৈতন্য নিয়ে ব্যস্ত থাকার মধ্যে ফেলুদাকে না টানলেও পারতেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন