বিশ্ব অর্থনীতি

মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় করপোরেটের অত্যধিক বাজারশক্তি নিয়ন্ত্রণ জরুরি

ইয়ানিস ভারুফাকিস

দামের উল্লম্ফন ঘিরে দোষারোপের খেলা চলছে। উঠছে একগুচ্ছ প্রশ্ন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছে, বর্তমান দাম বাড়ার পেছনে কি দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রবাহিত অতিরিক্ত অর্থ কাজ করেছে, যা মূল্যস্ফীতি ঘটিয়েছে? কারো কারো প্রশ্ন, নাকি এক্ষেত্রে চীন ফ্যাক্টর কাজ করেছে, যেখানে মহামারীতে লকডাউন দেয়ার আগেই বেশির ভাগ ভৌত উৎপাদন স্থানান্তরিত হয়েছিল এবং ব্যাহত হয়েছিল বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা? কেউবা আবার প্রশ্ন তুলছে, নাকি এক্ষেত্রে রাশিয়া দায়ীইউক্রেনে যার আক্রমণের ফলে বৈশ্বিক গ্যাস, তেল, খাদ্যশস্য সার সরবরাহ বহুলাংশে বাধাগ্রস্ত হয়েছে? আবার কারো কারো প্রশ্ন, নাকি এটা প্রাক-মহামারী কৃচ্ছ্রতা থেকে অনিয়ন্ত্রিত আর্থিক উদারতার কিছুটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন স্থানান্তরের ফল? এসব প্রশ্ন বৈশ্বিক দৃশ্যপটে এখন ঘুরছে।

তবে মজা হলো, প্রশ্নকর্তারা এক্ষেত্রে এমন এক উত্তর শুনবে, যেটা আগে কখনো শোনেনি তারা। আর তাহলো দামের উল্লম্ফনের জন্য উল্লেখিত সব বিষয়ই দায়ী, আবার কোনোটাই দায়ী নয়।

আমরা দেখেছি, প্রধান অর্থনৈতিক সংকটগুলো বারবারই নানা ব্যাখ্যা সামনে আনে, যার সবই সঠিকযদিও অনেক সময় সেখানে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি অনুপস্থিত থাকে। যখন ২০০৮ সালে ওয়ালস্ট্রিটের পতন ঘটেছিল, শুরু হয়েছিল বৈশ্বিক আর্থিক সংকট, তখন অনেক ব্যাখ্যাই দেয়া হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, অর্থায়নকারীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণমূলক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, শিল্পপতিদের চালকের আসনে বসানো, ঝুঁকিপূর্ণ অর্থায়নের প্রতি সাংস্কৃতিক ঝোঁক, নতুন প্যারাডাইম বিপুল বুদ্বুদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ে রাজনীতিবিদ অর্থনীতিবিদদের ব্যর্থতা এবং অন্যসব তত্ত্ব। সব ব্যাখ্যাই ঠিক ছিল, কিন্তু কোনোটিই মূল বিষয়ের গভীরে যায়নি।

আজকেও একই বিষয় সত্যি।আমরা তোমাদের তাই বলেছিলামবক্তব্যের অর্থনীতিবিদরা, ২০০৮ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের স্থিতিপত্র ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণের কারণে যারা উচ্চ মূল্যস্ফীতি অনুমান করেছিল তারা আমার মতো বামপন্থীদের ওই বছরের আনন্দটা মনে করিয়ে দেয় যারা আমরা অব্যাহতভাবে পুঁজিবাদের প্রায় মরণ দশাঅনুমানকরি। এটা যেন ঠিক ওই বন্ধ ঘড়ির মতো যেটি দিনে দুবার ঠিক হয়। নিশ্চিত, অর্থ প্রকৃত অর্থনীতিতে চুঁইয়ে পড়বেএমন মিথ্যা আশ্বাসে ব্যাংকারদের জন্য বিপুল ওভারড্রাফ সৃষ্টির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বড় ধরনের মূল্যস্ফীতি (শেয়ারবাজার, গৃহায়ন বাজার আরো অনেক কিছু চাঙ্গা করে) ঘটিয়েছে।

কিন্তু আর্থিকতাবাদী গল্প যথাযথ ব্যাখ্যা করতে পারে না, ২০০৯-২০ সাল পর্যন্ত প্রকৃত অর্থনীতিতে বিপুল অর্থ প্রবাহিত করে এবং ভোক্তা মূল্যস্ফীতি নিজেদের শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রেখেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো কেন ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই কিছু একটা নিশ্চয়ই মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির পেছনে কাজ করেছে। 

চীনকেন্দ্রিক সরবরাহ ব্যবস্থার বিপত্তি সুস্পষ্টভাবে একটি তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, যেমনটা রেখেছে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা। তবে এর মধ্যে কোনো ফ্যাক্টরই বিরাজমান মূল্য সংকোচন থেকে যুগপত্ভাবে সব পণ্য বেড়ে যাওয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা সংক্রান্ত পশ্চিমা পুঁজিবাদের আকস্মিকরেজিম চেঞ্জেরবিষয়টি ব্যাখ্যা করে না। বিরাজমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় নিশ্চয়ই প্রয়োজন হবে মজুরি বৃদ্ধি। এভাবে নিজেকে নিজে টিকিয়ে রাখার একটা চক্র তৈরি হবে যে, মজুরি বাড়ালে দাম বাড়বে, সেটি আবার মজুরি বৃদ্ধি ঘটাবে। একটা অনিঃশেষ প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। সেক্ষেত্রে শ্রমিকদের উচ্চতর মজুরি দাবি থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানোই কেবল কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের জন্য যুক্তিসংগত হবে।

কিন্তু আজ শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি করা থেকে বিরত থাকার বিষয়টি বলাটা অদ্ভূত, অযৌক্তিক। সব তথ্যপ্রমাণ বলছে, সত্তরের দশকের মতো মজুরি দামের চেয়ে অনেক কম গতিতে বাড়ছে। বিপরীতে ক্রমে দাম বৃদ্ধি কেবল অব্যাহতই নয়, বরং তা বেশ দ্রুততার সঙ্গে বাড়ছে। 

কাজেই সত্যি আসলে কী ঘটছে? বড় করপোরেশন, ওয়ালস্ট্রিট, সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো অর্ধ শতকজুড়ে যে দীর্ঘ ক্ষমতার খেলা চালিয়েছে তা ভুল পথে গেছে। ফলে পশ্চিমা কর্তৃপক্ষ এখন এক অসম্ভব পরিস্থিতির মুখোমুখি। সেটি হলো, রাষ্ট্রগুলো দেউলিয়া হওয়া কিংবা মূল্যস্ফীতি অনিয়ন্ত্রিত রেখেও কনগ্লোমারেটগুলোকে বেশি সুবিধা দেয়া। 

গত পঞ্চাশ বছর মার্কিন অর্থনীতি ইউরোপ, জাপান, কোরিয়া, চীন এবং অন্য উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর নিট রফতানি পুষ্ট করেছে; যদিও এসব বিদেশী মুনাফার  সিংহভাগই গেছে ওয়ালস্ট্রিটে উচ্চ রিটার্নের সন্ধানে। যুক্তরাষ্ট্রের দিকে পুঁজি গমনের সুনামির পিঠে বন্দর, জাহাজ, ওয়্যারহাউজ, গুদাম এবং সড়ক-রেল নেটওয়ার্কের বৈশ্বিক গোলকধাঁধা তৈরিতে করপোরেশনগুলোকে অর্থায়ন করতে অর্থায়নকারীরা প্রাইভেট মানির (যেমনঅপশন ডেরিভেটিভস) পিরামিড গড়েছিল। যখন ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট এসব পিরামিড ধসিয়ে দিয়েছিল, তখন বৈশ্বিক জাস্ট-ইন-টাইম সরবরাহ ব্যবস্থার পুরো গোলকধাঁধাও ব্যাহত হয়েছিল।

কেবল ব্যাংকারদের নয়, খোদ গোলকধাঁধাকেও বাঁচাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররা রাষ্ট্রীয় অর্থ দিয়ে অর্থায়নকারীদের পিরামিড প্রতিস্থাপন করতে এগিয়ে এসেছিল। ইত্যবসরে সরকারগুলো সরকারি ব্যয়, চাকরি সেবা কমিয়েছিল। এটা পুঁজির স্বল্পকালীন খরুচে সমাজতন্ত্র এবং শ্রমিকের কঠিন কৃচ্ছ্রতা ছাড়া কিছু ছিল না। এর প্রভাবে মজুরি সংকুচিত হয়, মূল্য মুনাফা স্থবির হয়ে পড়ে, তবে ধনীদের কেনা সম্পদের দাম এবং তাদের ধনসম্পদ আকাশচুম্বী হতে থাকে। এভাবে বিনিয়োগ (বিদ্যমান নগদ অর্থের তুলনায়) নিচে নেমে এসেছে, সক্ষমতা সংকুচিত হয়েছে, বাজারশক্তি চাঙ্গা হয়েছে এবং পুঁজিপতিরা আরো ধনী হয়েছে। একই সঙ্গে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থের ওপর অধিক নির্ভরশীল হয়েছে।  

এটা ছিল নতুন এক ক্ষমতার খেলা। মুনাফা মজুরি বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্জিত মোট আয়ে নিজস্ব হিস্যা বাড়াতে পুঁজি  শ্রমের মধ্যকার গতানুগতিক লড়াই অব্যাহত থাকে বটে, কিন্তু বেশির ভাগ নতুন সম্পদের উৎস আর থাকেনি। ২০০৮ সালের পর সর্বজনীন কৃচ্ছ্রতা নিম্ন বিনিয়োগ (অর্থের চাহিদা) ঘটায়, যা একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিপুল তারল্যের (অর্থ সরবরাহ) প্রবাহ তৈরি করে এবং অর্থের মূল্য (সুদহার) প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে যায়। উৎপাদিকা সক্ষমতা নিষ্প্রভ হওয়া, শোভন কর্মসংস্থান সংকোচন হওয়া, মজুরি স্থবির হয়ে পড়ার সঙ্গে সম্পদগুলো গিয়েছিল ইকুইটি এবং আবাসন বাজারেযা প্রকৃত অর্থনীতি থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

তারপর এল মহামারী, যেটি বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। পশ্চিমা সরকারগুলো লকডাউনে অবরুদ্ধ মানুষের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থের কিছু নতুন স্রোত প্রবাহিত করতে বাধ্য হয় অর্থনীতিতে, যা পুরো দশকজুড়েই পণ্য উৎপাদনে তাদের সক্ষমতা নিঃশেষ করবে। লকডাউন যেহেতু ঘাটতি পণ্যের আমদানি ব্যয় কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়, সেহেতু দাম বেড়ে যায়। বিপুল কাগুজে সম্পদের অধিকারী করপোরেশনগুলো তাদের ব্যাপক বাজার শক্তি ব্যবহার করে দাম আরো বাড়িয়ে দেয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকসমর্থিত স্ফীত সম্পদের দাম এবং বেড়ে চলা করপোরেট ঋণের দুই দশকের পর সামান্য দামজনিত মূল্যস্ফীতি ছিল ক্ষমতার খেলা শেষ হওয়ার শুরু, পুনরুজ্জীবিত শাসকশ্রেণীর ইমেজে, যা ২০০৮-পরবর্তী বিশ্বে দানা বেঁধেছিল। এখন তাহলে কী ঘটছে?

সম্ভবত ভালো কিছু নয়। অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে কর্তৃপক্ষকে প্রথমে কাগুজে সম্পদ সস্তা ঋণ সৃষ্টির একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাপ্ত একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতার অবসান ঘটাতে হবে। কিন্তু কোনো লড়াই ছাড়া ওই ক্ষুদ্র গোষ্ঠী আত্মসমর্পণ করবে না। সুতরাং এটা বিবেচনায় রেখে বৃহত্তর কল্যাণের রাজনীতি গড়ে তোলা জরুরি।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

ইয়ানিস ভারুফাকিস: গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী

মেরে২৫ দলের নেতা

অ্যাথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন