দক্ষিণ এশিয়া

দেউলিয়া শ্রীলংকাই বন্দর ব্যবস্থাপনায় সেরা

বণিক বার্তা ডেস্ক

শ্রীলংকার কলম্বো বন্দর ছবি: রয়টার্স

বিশ্ব বাণিজ্যে আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে বন্দরগুলোর পারফরম্যান্স পরিচালন দক্ষতা নিয়ে প্রতি বছরই যৌথভাবে র্যাংকিং করে থাকে বিশ্বব্যাংকের ট্রান্সপোর্ট গ্লোবাল প্র্যাকটিস বিভাগ এবং এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল মার্কেট ইন্টেলিজেন্সের মেরিটাইম ট্রেড অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ডিভিশন। সর্বশেষ এসব বন্দরের গত বছরের বাণিজ্যিক পারফরম্যান্স নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থা দুটি। কনটেইনার পোর্ট পারফরম্যান্স ইনডেক্স (সিপিপিআই) ২০২১ শীর্ষক র্যাংকিংয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে রয়েছে কলম্বো বন্দর। এদিক থেকে গোটা বিশ্বে বন্দরটির অবস্থান ২২তম।

অবস্থানগত কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলোর একটি শ্রীলংকার কেলানি নদীর দক্ষিণ-পশ্চিম পারে গড়ে ওঠা কলম্বো বন্দর। গোটা ভারত মহাসাগরের ব্যস্ততম বন্দর এটি। প্রায় দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যবহার হয়ে আসা বন্দরটি আধুনিক যুগে এসে হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কৃত্রিম পোতাশ্রয়যুক্ত বন্দরগুলোর অন্যতম। চার দশক ধরে ব্যাপক আধুনিকায়নের মধ্য দিয়ে গিয়েছে ১২ থেকে ১৮ মিটারের বেশি ড্রাফটের বন্দরটি। রাষ্ট্রীয় দেউলিয়াত্বের মধ্যেও বন্দরটি ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা হারায়নি, বরং মুহূর্তে বন্দরটিকে দেখা হচ্ছে শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সংকট দূর করার সবচেয়ে বড় মাধ্যমগুলোর একটি হিসেবে।

শ্রীলংকাকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসার জন্য মূলত রাজাপাকসে সরকারের অর্থনীতি পরিচালনায় দুর্বলতাকে দায়ী করে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, রাজাপাকসেদের বেপরোয়া অর্থনীতি পরিচালনায় একদিকে দিনে দিনে আর্থিক সক্ষমতা হারিয়েছে শ্রীলংকা, অন্যদিকে ভোক্তাশ্রেণী হিসেবে বিনাশ ঘটেছে মধ্যবিত্তের। সব মিলিয়ে মুহূর্তে শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের সক্ষমতাও প্রায় নিঃশেষ। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশটির অর্থনীতিতে আশা সঞ্চারের মতো যে কয়টি খাত টিকে রয়েছে তার অন্যতম হলো কলম্বো বন্দর। পরিচালন দক্ষতা সক্ষমতার দিক থেকে বন্দরটি দক্ষিণ এশিয়ায় সেরা। আবার কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকেও বন্দরটি গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শতকোটিরও বেশি ভোক্তার দেশ ভারতের দক্ষিণ উপকূল থেকে বন্দরটির অবস্থান খুবই কাছে। এশিয়া-ইউরোপ সমুদ্রপথটিও কলম্বোর কাছ দিয়ে। জ্বালানি অন্যান্য পণ্য পরিবহনে চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে গড়ে ওঠা বাণিজ্যপথের একেবারে কেন্দ্রে উঠে এসেছে কলম্বো বন্দর। একই সঙ্গে হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলংকার প্রতিবেশী অন্য দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় ট্রান্সশিপমেন্ট হাব।

ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে বিশ্বব্যাপী ঋণ অনুদানের গ্রহীতা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে শ্রীলংকা। যদিও ট্রান্সশিপমেন্টসহ বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সামান্যতম গুরুত্ব হারায়নি কলম্বো বন্দর। ২০২১ সালে বন্দরটিতে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে মোট ৭২ লাখ ৫০ হাজার টোয়েন্টি ফিট ইকুইভ্যালেন্ট কনটেইনার্স (টিইউএস, বন্দরে হ্যান্ডলিং হওয়া কনটেইনার পরিমাপের একক) চলতি বছরেও প্রথম পাঁচ মাসে বন্দরটিতে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে শতাংশ। এরই ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, সিপিপিআই র্যাংকিংয়ে কলম্বো বন্দরের অবস্থানে বন্দরটি নিয়ে বৈশ্বিক বাণিজ্য খাতসংশ্লিষ্টদের আস্থারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। মূলত দুটি ভিন্ন আঙ্গিক থেকে সিপিপিআই র্যাংকিংটি করা হয়েছেপরিসংখ্যানগত প্রশাসনিক। পরিসংখ্যানের দিক থেকে কলম্বো বন্দর বিশ্বে ২২তম। প্রশাসনিক দিক থেকে ২৪।

শ্রীলংকার বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এখন সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছেন। তবে এর বিপরীত দৃশ্য দেখা যায় বন্দর অবকাঠামো খাতে। কলম্বো বন্দরের দুটি টার্মিনাল এখন বিদেশী বিনিয়োগে নির্মাণাধীন রয়েছে। এর মধ্যে ইস্ট কনটেইনার টার্মিনালটি (ইসিটি) নির্মাণ করছে চীনের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। স্থানীয় জন কিলস হোল্ডিংস লিমিটেডের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে ওয়েস্ট কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করছে ভারতের আদানি গ্রুপ। টার্মিনাল দুটি নির্মাণ হলে কলম্বো বন্দরের পণ্য হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বাড়বে আরো ৭০ লাখ টিইউএস। কলম্বো বন্দরের ভূরাজনৈতিক অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় নির্মীয়মাণ টার্মিনাল দুটির নির্মাণকাজের দায়িত্ব পাওয়া নিয়ে ভারত চীনের মধ্যে রীতিমতো জোর প্রতিযোগিতা হয়েছে। আবার দুই টার্মিনালের নির্মাণকাজ দুই দেশের হাতে যাওয়ায় এদিক থেকে অনেকটা ভারসাম্যও রক্ষা হয়েছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি ভূ-অর্থনীতির পর্যবেক্ষকরা।

বর্তমানে শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে কলম্বো বন্দর বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যেকোনো সমুদ্রবন্দরের পারফরম্যান্স অনেক বড় একটি বিষয়। দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ বন্দরেই কনটেইনার পরিবহনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো হ্যান্ডলিংয়ের সময়, প্রক্রিয়াগত জটিলতা, প্রতিযোগী সক্ষমতা বন্দর পরিচালন দক্ষতা ইত্যাদি।

বিষয়ে সিপিপিআই প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক এসঅ্যান্ডপির পক্ষ থেকে বলা হয়, একটি দেশ থেকে বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনা করতে গিয়ে কেমন ব্যয় হবে, তা নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বন্দর সুবিধা। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, বন্দর টার্মিনালগুলোবিশেষ করে কনটেইনার টার্মিনালগুলো পণ্য পরিবহনে বিলম্বের উৎস হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে তা সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত ঘটানোর পাশাপাশি ব্যয় বৃদ্ধি এবং প্রতিযোগী সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য বন্দরের তুলনায় কলম্বোর পারফরম্যান্স অনেকটা ভালো হলেও অধিকাংশ বন্দরের অবস্থান হতাশাজনক বলে সিপিপিআই রেটিংয়ে উঠে এসেছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর এদিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য বন্দরের মধ্যে সিপিপিআই রেটিংয়ে ভারতের গুজরাটের এপিএম পোর্ট পিপাপাভ ২৬তম, মুন্দ্রা পোর্ট ৪৮তম, মুম্বাইয়ের জহরলাল নেহেরু বন্দর ৫৪, চেন্নাই ৭৯, কোচিন ৯৯তম, পাকিস্তানের পোর্ট মুহাম্মদ বিন কাসিম ৮১, করাচি ৯০ বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর ৩৪১তম।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন