আশঙ্কাজনক হারে কমছে প্রধান শ্রমবাজারের রেমিট্যান্স

হাছান আদনান

দেশের প্রধান শ্রমবাজারগুলোর একটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়া। দেশটির শ্রমবাজারে বাংলাদেশীদের উপস্থিতি কয়েক বছর ধরেই সংকুচিত হয়ে আসছে। প্রায় চার বছর ধরে বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশী শ্রমিকদের মালয়েশিয়ায় অভিবাসন। বিপরীতে মালয়েশিয়া থেকে ফিরেছেন কর্মহীন কয়েক লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহে। চলতি অর্থবছরে মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স কমেছে ৫০ শতাংশেরও বেশি।

মালয়েশিয়ার মতো না হলেও মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ এখন আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে ওমান থেকে, ৪১ শতাংশ। আর সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) থেকে কমেছে ২৭ শতাংশ। দেশের প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৯ দশমিক শতাংশ কমেছে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েত থেকে ১২ শতাংশ, কাতার থেকে দশমিক বাহরাইন থেকে দশমিক শতাংশ হারে রেমিট্যান্স কমেছে।

২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল হাজার ৬৬ কোটি ডলার। বিপরীতে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে দেশে হাজার ৭৩০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। হিসাবে চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ১৬ দশমিক শতাংশ।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আশঙ্কাজনক হারে রেমিট্যান্স কমলেও বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের দেশগুলোর ক্ষেত্রে। চলতি অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে দশমিক শতাংশ। যুক্তরাজ্য থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ অপরিবর্তিত রয়েছে। এতদিন দেশের সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহে দ্বিতীয় স্থানে ছিল ইউএই। কিন্তু সম্প্রতি দ্বিতীয় স্থানে যুক্তরাষ্ট্রের নাম উঠে এসেছে। আর সর্বোচ্চ রেমিট্যান্সের উৎস হিসেবে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে যুক্তরাজ্য। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ইউরোপের দেশ ইতালি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রায় ২৮ শতাংশ বেড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে এসেছে। প্রধান এসব শ্রমবাজারে বাংলাদেশীদের নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে না। আবার যেসব শ্রমিক আগে থেকেই আছেন, তাদের আয়ও কমে যাচ্ছে। কর্মহীন অনেক শ্রমিক দেশে ফিরে আসতেও বাধ্য হচ্ছেন। এসব কারণে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে।

মালয়েশিয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশী মোবারক হোসাইন বণিক বার্তাকে জানান, নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর আগে মালয়েশিয়ায় তার একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। দীর্ঘ লকডাউন আর অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে ২০২১ সালের মাঝামাঝি রেস্টুরেন্টটি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। তার রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন চার বাংলাদেশী শ্রমিক। কর্মহীন হয়ে পড়ায় তাদের তিনজনই দেশে ফিরে এসেছেন। তিনি নিজেই এখন একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করছেন।

মোবারক হোসাইনের বক্তব্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় তার মতোই পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন কয়েক লাখ বাংলাদেশী। এর মধ্যে অনেকে দেশে ফিরে গেছেন। যারা এখনো মালয়েশিয়ায় আছেন, তাদের আর্থিক অবস্থাও ভালো নেই।

সৌদি আরবের জেদ্দায় বসবাসকারী বাংলাদেশী ইশতিয়াক হোসেন জানান, অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য সৌদি সরকারের আইন রীতিনীতি দিন দিন কঠোর হয়ে যাচ্ছে। আগের মতো চাইলেই এখন বাংলাদেশে টাকা পাঠানোর সুযোগ নেই। টাকা পাঠাতে হলে পাসপোর্ট, আয়ের উৎসসহ অন্যান্য ডকুমেন্ট জমা দিতে হচ্ছে। কারণে যেসব বাংলাদেশী বাড়তি আয় করছেন, সে আয় বৈধ পথে দেশে পাঠানোর উপায় থাকছে না। বাধ্য হয়ে অনেকে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্সের অর্থ বাংলাদেশে পাঠাচ্ছেন। আবার ডলারের বিনিময় হারে বড় ধরনের তারতম্যের কারণে হুন্ডিতে পাঠালে ব্যাংকের চেয়ে বেশি টাকা পাওয়া যাচ্ছে। এজন্য অনেক বাংলাদেশী বৈধ মাধ্যমে না পাঠিয়ে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।

চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা চলছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল হাজার ২৮৩ কোটি ৬৯ লাখ ডলার, যা ছিল আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে দেশে হাজার ৯১৯ কোটি ৪৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। হিসাবে মে পর্যন্ত রেমিট্যান্স কমেছে ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৪১ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির মাধ্যমে মাত্র ১৩৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির রেমিট্যান্স আহরণ কমেছে ৪২ দশমিক শতাংশ।

শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকই নয়, বরং দেশের শীর্ষ রেমিট্যান্স আহরণকারী ১০ ব্যাংকের মধ্যে পাঁচটিরই আহরণ কমেছে। সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স কমেছে অগ্রণী ব্যাংকের, প্রায় ৪৩ শতাংশ। "্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩২ শতাংশ রেমিট্যান্স কমেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের। তৃতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের রেমিট্যান্স কমেছে ২৭ শতাংশ। শীর্ষ রেমিট্যান্স আহরণকারী ব্যাংকগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ১৬ দশমিক পূবালী ব্যাংকের দশমিক শতাংশ রেমিট্যান্স কমেছে।

প্রবাসী আয়ের দুঃসময়েও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) রেমিট্যান্স প্রবাহ ২৭ দশমিক শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে রেমিট্যান্স ৩৬ দশমিক শতাংশ বেড়েছে সাউথইস্ট ব্যাংকের। এছাড়া এনসিসি ব্যাংকের দশমিক আর ব্যাংক এশিয়ার দশমিক শতাংশ রেমিট্যান্স বেড়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ অপরিবর্তিত রয়েছে দেশের "্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণকারী ব্যাংক ডাচ্-বাংলার।

চলতি মাসেও দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক কোনো বার্তা নেই। আগামী মাসের শুরুতে দেশে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। সাধারণত ঈদের আগে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় ধরনের প্রবৃ"ি হয়। কিন্তু এবারের ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে এখনো রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি দেখা যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২৩ জুন পর্যন্ত দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১২৮ কোটি ৪৮ লাখ ডলার।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত ডলারের বিনিময় হার ৯২ টাকা ৯৫ পয়সা হলেও কার্ব মার্কেটে দর অনেক বেশি। খুচরা বাজারে বর্তমানে ১০০ টাকায়ও প্রতি ডলার বেচাকেনা হচ্ছে। কারণে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা পড়ার পাশাপাশি হুন্ডির বাজার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন