অভিমত

পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা নিয়ে বিতর্ক ও কিছু ভাবনা

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী

বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার সুযোগ প্রদান প্রসঙ্গ নিয়ে প্রতিদিন পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন অন্যান্য মিডিয়ায় বক্তৃতা-বিবৃতি, তর্ক-বিতর্ক, আলাপ-আলোচনায় রীতিমতো ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে রাজনীতির মাঠেও বেশ তর্ক-বিতর্ক চলছে, অর্থনীতিবিদ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও আলোচনা থেকে পিছিয়ে নেই। প্রায় সবাই বলছে, কম হারে কর দিয়ে পাচারকৃত অর্থ বৈধ করার বিষয়টি অনৈতিক। অনেক ব্যবসায়ী নেতা বিষয়টি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করার সহায়ক হবে বলে মন্তব্য করছে। তাদের কথা হলো, যারা নিয়মিত উচ্চহারে কর দিয়ে আসছেন তাদের জন্য এটি একটি হতাশার কারণ হবে। তাছাড়া অনেকে কর না দিয়ে বিদেশে অর্থ পাচার করে তা আবার দেশে এনে কম হারে কর দেয়ার সুবিধা নেয়ারও চেষ্টা করবেন। রকম নানা আলোচনা-সমালোচনা শুনে সরকারপক্ষের কেউ কেউ আবার একটু পিছু হটছেন। তারা বলছেন বাজেট এখনো পাস হয়নি। সুতরাং বাজেট পাস হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বিষয়টি পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। মানে সরকারপক্ষের কেউ কেউ পরোক্ষভাবে মেনে নিচ্ছেন বিষয়টি নৈতিক নয়। বিভিন্ন পক্ষের বিবৃতিতে অনেকটা একই সুর প্রতিধ্বনিত হলেও বিষয়টির একটি সার্বিক বিশ্লেষণের অনুপস্থিতি লক্ষ করা যায়। সার্বিক দিক বিবেচনা করে বিষয়টির একটি চুলচেরা বিশ্লেষণ মুহূর্তে জরুরি।

বিশ্লেষণের প্রথমে জানা প্রয়োজন বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা নিয়ে নীতি-নৈতিকতার যে প্রশ্নটি সামনে উঠে এসেছে এবং যা নিয়ে এত আলাপ আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে তা কতুটুকু প্রাসঙ্গিক। অর্থমন্ত্রী বা পরিকল্পনামন্ত্রী বা সরকারপক্ষের অন্য কেউ বাইরে বক্তৃতা-বিবৃতিতে যা- বলুক না কেন বাস্তবে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার জন্য এবারের বাজেটে সরকার কি সত্যি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এক কথায় এর উত্তর হলো না। বিষয়টি অনেকটা চিলে কান নিয়ে গেছে, সেই পুরনো গল্পের মতো। মাঠে-ঘাটে বক্তৃতা-বিবৃতিতে যা বলা হয় তা হলো রাজনৈতিক বক্তব্য। বক্তব্য যদি বাজেট বক্তৃতা এবং অর্থ বিলে না থাকে তাহলে মাঠের বক্তৃতা সম্পূর্ণই অসার। আবার বাজেট বক্তৃতায় যা- থাক না কেন প্রস্তাবিত অর্থ আইনে যদি এর প্রতিফলন না থাকে তাহলে বাস্তব ক্ষেত্রে ওই বাজেট বক্তৃতারও কোনো গুরুত্ব থাকে না। এমনকি বক্তৃতা-বিবৃতি এবং বাজেট বক্তৃতায় একই কথা বলা হলেও অর্থ আইনে যদি তা না থাকে তবুও তা ফলবলহীন হয়। কারণ বক্তৃতা-বিবৃতি কিংবা বাজেট বক্তৃতা কোনো আইন নয়। আবার ঘটনাটি যদি এমন হয়, বাজেট বক্তৃতায় যা কিছু বলা হয়েছে অর্থ বিলে এর উল্টো কিছু আছে তবে উল্টোটিই বাস্তবায়নযোগ্য হবে, বাজেট বক্তৃতা নয়। অনেক সময় দেখা যায় বাজেট বক্তৃতায় কিছুই বলা হয়নি অথচ অর্থ বিলে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় কিছু না বলে অর্থ বিলে তা ঢুকিয়ে দেয়ার এমন ঘটনা হরহামেশাই হয়ে থাকে।

এবারো কিন্তু এর ব্যতিক্রম নয়। যেমন এবারের বাজেট বক্তৃতায় কর পরিপালন সহজীকরণের কথা বলে কর রেয়াতের হার সব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি করদাতার জন্য একটি ইতিবাচক খবর, এটি শুনলে করদাতা খুশি হবেন। কিন্তু প্রস্তাবিত অর্থ আইনে রেয়াতযোগ্য অংকের পরিমাণ পূর্বের ২৫ শতাংশ থেকে হ্রাস করে যে ২০ শতাংশ করা হলো তা কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়নি। এটি করদাতার জন্য একটি নেতিবাচক খবর। এটি শুনলে করদাতার মন খারাপ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যায়, যেমন বিদ্যমান আইন অনুসারে কর রেয়াতের জন্য বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা ছিল মোট আয়ের ২৫ শতাংশ কিন্তু এবারের প্রস্তাবিত অর্থ আইন অনুসারে কর রেয়াত সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য বিনিয়োগের সর্বোচ্চ হার করা হয়েছে মোট আয়ের ২০ শতাংশ। আগে একজন করদাতার মোট আয় ১০ লাখ টাকা হলে এর ২৫ শতাংশ মানে লাখ ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ১৫ শতাংশ হিসেবে ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা কর রেয়াত সুবিধা পেতেন। প্রস্তাবিত অর্থ আইন অনুসারে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ মানে লাখ টাকার ওপর ১৫ শতাংশ হিসেবে ৩০ হাজার টাকা পাবেন, অর্থাৎ পূর্ব অপেক্ষা হাজার ৫০০ টাকা কম কর রেয়াত সুবিধা পাবেন। কর রেয়াত সুবিধা হ্রাস করার বিষয়টি কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়নি অথচ অর্থ বিলের মাধ্যমে সংশোধনী এনে করদাতার সুবিধা হ্রাস করা হয়েছে। এভাবে বাইরে বক্তৃতা-বিবৃতি কিংবা বাজেট বক্তৃতায় যা- বলা হোক না কেন, অর্থ বিলে তা না আনা হলে কার্যত এর বাস্তবায়নের কোনো সুযোগ নেই। ঠিক তেমনি বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার কথা খুব আলোচিত হলেও বিষয়টি বাজেট বক্তৃতা কিংবা অর্থ আইনের কোথাও নেই। সুতরাং এটি নিয়ে যেকোনো তর্ক-বিতর্ককে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক বলা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, সরকারপক্ষের কেউ একবারও বিষয়টি অস্বীকার করছেন না। প্রশ্ন হতে পারে, সরকার যদি নামমাত্র কর দিয়ে পাচারকৃত অর্থ দেশে আনার জন্য কোনো আইনি ব্যবস্থা না করে থাকে তাহলে এত আলোচনা-সমালোচনাইবা কেন হবে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন বটে, এমন প্রশ্ন যে কারো মনে উদয় হতে পারে। তাছাড়া সরকারপক্ষের নীরবতা কিংবা এক ধরনের পরোক্ষ সম্মতি প্রশ্নকে আরো জোরদার করছে। তাহলে আলোচনা করা যাক, এবারের বাজেট বক্তৃতায় বিষয়ে কী বলা হয়েছে। বাজেট বক্তৃতার দশম অধ্যায়ে ২৪৯ অনুচ্ছেদটি বিষয়ে প্রাসঙ্গিক। এখানে অর্থমন্ত্রী নভেল করোনাভাইরাস চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার পূর্বাভাসের কথা বলে বিদেশে অর্জিত অর্থ সম্পদকে অর্থনীতির মূল স্রোতে আনয়নের কথা বলেছেন। বক্তৃতার হুবহু মূল অংশটি হলোবিদেশে অর্জিত স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনীত না হলে এর ওপর ১৫ শতাংশ, বিদেশস্থ অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনীত না হলে এর ওপর ১০ শতাংশ এবং বাংলাদেশে রেমিটকৃত নগদ অর্থের ওপর শতাংশ হারে কর ধার্যের প্রস্তাব করছি। সুবিধা ২০২২ সালের জুলাই হতে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বিদেশে অর্জিত অর্থসম্পদকে দেশে আনা কিংবা বিদেশে থাকলে তা ঘোষণা দেয়ার কথা বলেছেন। অর্থাৎ বাজেট বক্তৃতার মূল বিষয়টি হলো বিদেশে অর্জিত অর্থ। বিদেশে অর্জিত অর্থ দেশে আনা আর পাচারকৃত অর্থ দেশে আনা এক কথা নয়। প্রস্তাবিত অর্থ বিলেও বিষয়টির হুবহু প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। বাস্তবতা হলো, বিদেশে আমাদের দেশের অনেক নাগরিক অর্থ উপার্জন করেন এবং অনেকে উপার্জিত অর্থ দেশে আনেন আবার অনেকে আনেন না। যারা বিদেশে অর্জিত অর্থ দেশে আনেন তা আয়কর অধ্যাদেশের ষষ্ঠ তফসিলের ৪৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে করমুক্ত বা কর অব্যাহতিযোগ্য। এদের মধ্যে দেশে যাদের আয়কর বিবরণী দাখিল করতে হয় তারা অর্থ করমুক্ত আয় হিসেবে এবং আয় দিয়ে দেশে অর্জিত স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ আয়কর বিবরণী সম্পদ বিবরণীতে প্রদর্শন করেন। কিন্তু যারা বিদেশে অর্জিত অর্থ সম্পদ দেশে না এনে বিদেশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিক হন, তারা আমাদের বিদ্যমান আইনের অস্পষ্টতার কারণে ওই সম্পদ দেশে ঘোষণা প্রদান করেন না। এবারের বাজেটে আবাসিক শ্রেণীর করদাতার বিদেশে অর্জিত সম্পদ দেশে ঘোষণা দেয়ার আইনগত অস্পষ্টতা দূরীভূত করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে আবাসিক শ্রেণীর করদাতা তাদের বিদেশে অবস্থিত অর্থসম্পদ দেশে ঘোষণা দিতে বাধ্য হবেন, এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক। নিয়ে কোনো বিতর্ক কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু বিদেশে অর্জিত অর্থ দেশে এনে শতাংশ হারে কর দেয়ার বিষয়টি বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

বিদ্যমান আইন অনুসারে বাংলাদেশের নাগরিক বিদেশে অর্জিত অর্থ দেশে আনলে তা করমুক্ত হবে। কিন্তু এবারের বাজেটে প্রস্তাব এবং অর্থ আইনে আনীত সংশোধনী অনুসারে বিদেশে অর্জিত অর্থ দেশে আনলে তা শতাংশ হারে করযোগ্য হবে। সিক্স শিডিউল পার্ট-এর ক্লজ ৪৮-এর ভাষাটি হলো ‘Any income earned in abroad by an individual assessee being a Bangladeshi Citizen and brought any such income into Bangladesh as per existing Law applicable in respect of foreign remittance’ এখানে Citizan শব্দটি দিয়ে সব নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানে নাগরিকের মধ্যে কোনো বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়নি, ফলে বাংলাদেশের সব নাগরিকের বিদেশে অর্জিত অর্থ বাংলাদেশে আনা হলে তা করমুক্ত। কিন্তু এবারের বাজেট বক্তৃতা অনুসারে প্রস্তাবিত অর্থ আইনে ১৯ (এফ) নামে একটি নতুন ধারা সংযোজন করা হয়েছে। ১৯ (এফ) ধারাটির টেবিলে সারণি-- বলা হয়েছে, Any cash or cash equivalence, bank deposit, bank note, bank accounts, convertible Securities and financial instruments repatriated to Bangladesh, Rate of Tax 7%, এটি সিক্স শিডিউল পার্ট-এর ক্লজ ৪৮-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তাই বিষয়টি চূড়ান্তভাবে অর্থ আইন পাস হওয়ার সময় বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ নতুন সংযোজিত আইনের কারণে এর আগে যারা নিয়মিত অর্থ দেশে পাঠাতেন তারা হয়রানির শিকার হতে পারেন। এটি অবশ্য একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু বিদেশী পাচারকৃত অর্থ দেশে আনা নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়। বরং এবারের প্রস্তাবিত অর্থ আইনে আয়কর আইনের ৮০ ধারা সংশোধন করে All asset-এর স্থলে Local and Global asset প্রতিস্থাপন করে দেশে বিদেশের সম্পদ ঘোষণার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে, যা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। ঘোষণা শুধু আবাসিক করদাতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা হয়েছে। অনাবাসী করদাতার বিদেশে রক্ষিত সম্পদ ঘোষণার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়নি। সব শ্রেণীর নাগরিকের জন্য দেশে-বিদেশের সব সম্পদ ঘোষণার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হলে স্বচ্ছতা আরো নিশ্চিত হতো। অনাবাসী বাংলাদেশীকে বিদেশে অবস্থিত সম্পদ ঘোষণা দেয়া থেকে কেন বাদ রাখা হলো তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু পাচারকৃত অর্থ ফেরত প্রসঙ্গ নিয়ে চলমান বিতর্ক একটি অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক বটে।

 

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী: আয়কর আইনজীবী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন