দেশজ জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ

রাষ্ট্রীয় নীতি-কৌশলে নিজস্ব জ্বালানির অনুসন্ধান ও উত্তোলন প্রাধান্য পাক

দেশে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানি করেই জ্বালানি চাহিদা মেটানো হচ্ছে এখন। ফলে চাপে আছে দেশের জ্বালানি বিদ্যুৎ খাত। ভর্তুকি বাড়িয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। অবস্থায় সংকট উত্তরণে আমদানিনির্ভরতা কমানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি সিপিডির এক আলোচনা সভায় জ্বালানির অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অনুসন্ধান বাড়ানোর কথা বলেছেন তারা। দেশে রফতানিমুখী শিল্পের দিন দিন প্রসার ঘটছে। শিল্পকে প্রতিযোগীসক্ষম করে তুলতে হলে উৎপাদন ব্যয় সীমিত রাখতে হবে। তার জন্য অবশ্যই প্রতিযোগিতামূলক দামে নিরবচ্ছিন্ন মানসম্পন্ন জ্বালানি জোগানো প্রয়োজন, যা আমদানিনির্ভরতার মাধ্যমে সম্ভব নয়। সুতরাং অর্থনৈতিক স্বার্থেই রাষ্ট্রীয় নীতি-কৌশলে নিজস্ব জ্বালানি অনুসন্ধান উত্তোলনের বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া জরুরি। 

স্বল্প মূল্যের প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর ভর করে দীর্ঘ সময় অর্থনীতির চাকা সচল রাখে বাংলাদেশ। ২০১০ সালে এসে গ্যাস সংকট জ্বালানি খাতে ভয়াবহ বিরূপ প্রভাব ফেলে। সময়ে আমদানীকৃত জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়। ২০১৫ সালে জ্বালানি সরবরাহের ভবিষ্যৎ রূপরেখায় নির্ধারণ হয় যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা রাখবে কয়লা, যার প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হবে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে দেশে প্রথমবারের মতো এলএনজি আমদানি শুরু হয়। এর মাধ্যমে গ্যাস সংকট কিছুটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ব্যয়বহুল এলএনজির ওপর ব্যাপক নির্ভরতা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এরই মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এলএনজি সরবরাহ অব্যাহত রাখতে সরকারকে দিতে হচ্ছে বিপুল ভর্তুকি। আমদানি করা জ্বালানির একটি বড় অংশ যাচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। ২০১৬ সালে আমাদের পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যানে বাংলাদেশ যে ভবিষ্যতে পুরোপুরি জ্বালানি আমদানিনির্ভর একটি দেশে পরিণত হবে, তার ইঙ্গিত রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ ভাগ আমদানীকৃত জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ আমদানিনির্ভর হবে। বলতে গেলে আমাদের পরিকল্পনার মধ্যেই গলদ বিদ্যমান।

চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধ জ্বালানি আমদানিনির্ভরতার ঝুঁকি নতুন করে সামনে এনেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ইউরোপের অনেক দেশ রাশিয়ার তেল আমদানি বন্ধ করেছে। সংকট উত্তরণে তারা দেশীয় উৎসের প্রতি নজর দিয়েছে। স্বয়ম্ভরতা বাড়াতে নিয়েছে বিশদ কর্মকৌশল। জার্মানি ফ্রান্স নবায়নযোগ্য জ্বালানি, পারমাণবিক জ্বালানিতে করছাড়সহ নানা রকম প্রণোদনা দিয়েছে। ধীরে ধীরে আমদানিনির্ভরতা কমানোর নীতি নিয়েছে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশও দেশীয় উৎস থেকে জ্বালানি জোগানোতেই বেশি দৃষ্টি দিয়েছে। ভিয়েতনাম বর্তমানে নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাস কয়লা ব্যবহারের মাধ্যমে মোট বিদ্যুতের যথাক্রমে ২৭ ২৫ শতাংশ উৎপাদন করছে। দেশটিতে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে জলবিদ্যুতের অবদান ৪৪ শতাংশ। বাকি শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে খুব সামান্য পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি করে। এখন দেশটি নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন ব্যবহারে আরো বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। একইভাবে কম্বোডিয়াও গতানুগতিক দেশীয় জ্বালানি উৎসের পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ জলবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্প খাতের জ্বালানি চাহিদা মেটাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায়ও সমরূপ অবস্থা। দেশটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস কয়লার প্রাধান্য থাকলেও ধীরে ধীরে জলবিদ্যুৎ জিওথার্মালের ব্যবহার বাড়ছে।

জ্বালানি বিভাগ বলছে, দেশীয় উৎস কমে আসায় গ্যাসভিত্তিক শিল্পায়নের চাকা সচল রাখতে ব্যয়বহুল এলএনজি জ্বালানি তেল আমদানির বিকল্প ছিল না। দেশের শিল্পায়নে চাহিদা পূরণ করতে স্বভাবত আমদানি করা জ্বালানি জোগানো হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে এলএনজি দামের উদ্বায়িতায় সৃষ্ট আর্থিক বোঝা দেশের অর্থনীতি কত দিন সামাল দিতে পারবে তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। আবার আর্থিক চাপের কারণে সাময়িকভাবে এলএনজি আমদানি বন্ধ করতে হলে অনেক গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ শিল্পকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অবস্থায় দেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান জোরদার করা প্রয়োজন। অর্থনীতির ভিত শক্তিশালী রাখতে হলে এর বিকল্প নেই।

হতাশাজনক বিষয় হলো দেশে প্রাথমিক জ্বালানি অনুসন্ধানে এখনো তেমন অগ্রগতি নেই। আমদানিনির্ভরতা কমাতে সুপরিকল্পিতভাবে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাতে হবে। গবেষণা বলছে, দেশের স্থল জলভাগে আরো গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এখনো স্থলভাগের অনেকাংশ অনুসন্ধানের আওতায় আনা যায়নি। জলসীমায় তো অনুসন্ধান চালানোই হয়নি। ২০১৪ সালে আমাদের সমুদ্রসীমা নিয়ে সব বিরোধের অবসান ঘটে। সমুদ্র-গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে আমাদের সামনে তখন থেকেই আর কোনো বাধা নেই। এরপর দেশের সমুদ্রসীমায় জরিপ করার জন্য দুবার টেন্ডার ডাকা হয়েছে এবং একটি কোম্পানিকেই দুবার কাজটি করতে দেয়া হয়েছে। পরে নানা অজুহাতে সেই টেন্ডার বাতিল করা হয়েছে। টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে দ্রুত স্থল জলভাগে অনুসন্ধান চালাতে হবে। মজুদকৃত কয়লা উত্তোলনেরও উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্র থেকে আরো উৎপাদন বাড়াতে হবে।

জোরালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি চাহিদাও দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু জ্বালানি সংকট নিরসনে বেশির ভাগ নীতি-কৌশল উদ্যোগই এখন আমদানিকেন্দ্রিক, যা অনেক ব্যয়বহুল। আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর নির্ভর করে পরিকল্পনা প্রণয়নের নানামুখী ঝুঁকি থাকে। আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি, উৎপাদন দাম নিয়ে কারসাজিসহ বিভিন্ন কারণে জ্বালানির বাজার সারা বছরই দোদুল্যমান থাকে। মাঝে মাঝেই দাম বেড়ে রেকর্ড করে। ফলে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারের ওপর নির্ভর করে পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন। প্রেক্ষাপটে সিপিডির আলোচনায় যে অভ্যন্তরীণ জ্বালানি উৎপাদন অনুসন্ধান বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে তা বাস্তবসম্মত। এটা বিবেচনায় নিয়ে অনুসন্ধান উত্তোলন কার্যক্রমে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন