২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাস

চলতি হিসাবে ঘাটতি ১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বিশ্ববাজারে রফতানি হয়েছে বাংলাদেশের হাজার ১১০ কোটি ডলারের পণ্য। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৪ শতাংশেরও বেশি। যদিও রফতানির উচ্চপ্রবৃদ্ধি স্বস্তি আনতে পারছে না সামগ্রিক অর্থনীতিতে।

বাণিজ্য ঘাটতির প্রভাব পড়েছে সরকারের চলতি হিসাবে। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই সরকারের চলতি হিসাবে তৈরি হয়েছে ১৫ দশমিক বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি। দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতিও ছাড়িয়েছে দশমিক বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্সে মন্দা ভাবের পাশাপাশি আমদানি ব্যয়ের উচ্চপ্রবৃদ্ধির প্রভাবে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতির সঙ্গে নতুন দুশ্চিন্তাও যুক্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতিতে। প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থের পণ্য রফতানি হচ্ছে, সেটি প্রত্যাবাসিত হচ্ছে না। শুধু গত আড়াই বছরেই রফতানি অর্থ প্রাপ্তির ব্যবধান হাজার ২৯১ কোটি বা ১২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। করোনার প্রভাবে বিদেশী ক্রেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশী রফতানিকারকদের বাণিজ্য বিরোধের ঘটনা বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে রফতানির বিপরীতে পণ্যের মূল্যহ্রাসের ঘটনাও। ঋণপত্রের বিপরীতে অর্থ পরিশোধের সময়সীমা বেড়ে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাবও রফতানি আয় প্রত্যাবাসনের ওপর পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রফতানি আয়ের যে প্রবৃদ্ধি সেটি আমদানি ব্যয়ের তুলনায় খুবই কম। কারণে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি রেকর্ড উচ্চতায় গিয়ে ঠেকেছে। করোনাভাইরাস-সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ, ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক নানা কারণে জ্বালানি তেল-গ্যাসসহ খাদ্যপণ্যের দাম ওঠানামা চলছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক টেকসই হয়ে আসবে এমন কোনো অবস্থাও দেখা যাচ্ছে না। ফলে সরকারের চলতি হিসাব ব্যালান্স অব পেমেন্টের বিদ্যমান ঘাটতি বছর শেষে আরো বড় হবে, বর্তমান ধারায় এমনটাই প্রক্ষেপণ করা যাচ্ছে। আগামী দুই বছর একই পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে হাজার ১১০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। যেটি ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। বিপরীতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে দেশে হাজার ৮৬৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪১ দশমিক ৪২ শতাংশ। রেকর্ড প্রবৃদ্ধি দেশের হাজার ৭৫৬ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি করেছে।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের অর্থে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ হতো। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। সময় দেশে হাজার ৭৩০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। রেমিট্যান্স রফতানি আয় বাবদ নয় মাসে দেশে হাজার ৮৪০ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে। বিপরীতে একই সময়ে হাজার ৮৬৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ।

বৈদেশিক মুদ্রা আয় ব্যয়ে তৈরি হওয়া অসামঞ্জস্যের কারণে এপ্রিল শেষে সরকারের চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে হাজার ৫৩১ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৬৫ কোটি ডলার। চলতি হিসাবের বড় ঘাটতি রাষ্ট্রের ব্যালান্স অব পেমেন্টেও বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি করেছে। এপ্রিল শেষে ঘাটতির পরিমাণ ৩৭১ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে গড়ে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৬৮৬ কোটি ডলার। পরের দুই মাসে একই হারে আমদানি হলে বছর শেষে দেশের আমদানি ব্যয় ৮২ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। আমদানির প্রবৃদ্ধি চলতি হিসাবের ঘাটতিকে ২০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে পারে। অবস্থায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের বিদ্যমান সংকটের মাত্রা ভয়াবহ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অর্থনীতিবিদ . আহসান এইচ মনসুর মনে করেন ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক নানা কারণে আগামীতে জ্বালানি তেল-গ্যাসসহ খাদ্যপণ্যের দাম আরো বাড়বে। কারণে আমদানি ব্যয় ৮২ বিলিয়ন ডলারে সীমাবদ্ধ থাকার সম্ভাবনাও কম বলে মত তার। . আহসান এইচ মনসুর বলেন, চলতি অর্থবছরেই চলতি হিসাবে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঘাটতি হবে। পরিস্থিতি দু-তিন বছর স্থায়ী হলে আমাদের অর্থনীতির বেশ অবনতি হতে পারে। দেশী-বিদেশী উৎস থেকে সরকার ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বহুগুণ বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতেও বিদেশী ঋণ বড় হচ্ছে। আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে বিদেশী ঋণ পরিশোধ প্রক্রিয়া যুক্ত হলে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের সংকট আরো গভীর হবে।

প্রতি মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে রফতানি পরিসংখ্যান হালনাগাদ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ইপিবি। সম্প্রতি ১১ মাসের পরিসংখ্যান দিয়ে সর্বশেষ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, শুধু মে মাসে পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৩ দশমিক ২৪ শতাংশ।

তবে রফতানির বর্তমান প্রবৃদ্ধি নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে তৈরি পণ্যগুলো রফতানির প্রধান গন্তব্য পশ্চিমা দেশগুলো। কভিড-১৯ মহামারীর অভিঘাত কাটিয়ে দেশগুলোর বাজার চাঙ্গা হতে শুরু করেছিল। অনেক দিন নিষ্ক্রিয় থাকা বিক্রয় কেন্দ্রগুলো সক্রিয় হওয়ার পর চাহিদার উল্লম্ফনও দেখা গিয়েছিল, যার প্রতিফলন হিসেবে মোট রফতানিতে বড় প্রবৃদ্ধি দেখতে পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে প্রবৃদ্ধি টেকসই হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কারণ নভেল করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে পশ্চিমা বাজারগুলোর চাহিদায় ভাটার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বণিক বার্তাকে বলেন, পশ্চিমা বাজারগুলোর চাহিদা বৃদ্ধির প্রতিফলন হিসেবে বিপুল পরিমাণ ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে এসেছে। এছাড়া করোনা মহামারীর মধ্যে সরকার রফতানি খাতে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করায় উদ্যোক্তারা সে ক্রয়াদেশ গ্রহণ করে সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ করতে পেরেছেন। পরবর্তী সময়ে কভিডের প্রভাব কাটিয়ে পশ্চিমা ক্রেতাদের চাহিদাও বেড়েছে। সার্বিকভাবে রফতানি বেড়েছে। বর্তমানে পণ্য পরিবহনসহ সার্বিক লজিস্টিক খরচ অনেক বেড়ে গিয়েছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাটা চ্যালেঞ্জ হবে।

অর্থমূল্য বিবেচনায় বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া শীর্ষ তিন পণ্য পোশাক, পাট পাটজাত এবং চামড়া চামড়াজাত পণ্য। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের মোট রফতানির ৮৬ দশমিক শতাংশজুড়েই ছিল তিন পণ্য। আধিপত্য বজায় রয়েছে চলতি অর্থবছরও। তবে মোট রফতানিতে বড় অবদান রাখা পণ্যের তালিকায় যুক্ত হয়েছে হোমটেক্সটাইল। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাস শেষে পোশাক রফতানি বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ। হোমটেক্সটাইল রফতানি বেড়েছে ৪১ দশমিক শতাংশ। চামড়া চামড়াজাত পণ্য রফতানিও বেড়েছে ৩১ দশমিক ৮৪ শতাংশ। পাট পাটজাত পণ্য রফতানি কমেছে দশমিক ১৯ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে পোশাক রফতানির অর্থমূল্য ছিল হাজার ৮৫২ কোটি ১১ লাখ ৬০ হাজার ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয় হাজার ৮৫৬ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার ডলারের।  মোট রফতানির ৮১ দশমিক ৬৫ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক। হোমটেক্সটাইল পণ্য রফতানি চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে হয়েছে ১৪৬ কোটি ৭১ লাখ ৯০ হাজার ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয়েছে ১০৩ কোটি ৮৩ লাখ ৬০ হাজার ডলারের। হিসেবে হোমটেক্সটাইল পণ্য রফতানি বেড়েছে ৪১ দশমিক শতাংশ।

চামড়া চামড়াজাত পণ্য রফতানি চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে হয়েছে ১১১ কোটি ৫৫ লাখ ৮০ হাজার ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয় ৮৪ কোটি ৬০ লাখ ৮০ হাজার ডলারের পণ্য। হিসেবে চামড়া চামড়াজাত পণ্য রফতানি বেড়েছে ৩১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এদিকে পোশাক, হোমটেক্সটাইল, চামড়া চামড়াজাত পণ্য রফতানি বাড়লেও কমেছে বাংলাদেশের সোনালি আঁশ খ্যাত পাট পাটজাত পণ্যের। পণ্যের রফতানি চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত ছিল ১০৫ কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয় ১০৮ কোটি ৯৮ লাখ ১০ হাজার ডলারের। হিসেবে পণ্যটি রফতানিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে বা কমেছে দশমিক ১৯ শতাংশ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন