নওগাঁয় ১০ বছরে আম বাগান বেড়েছে তিন গুণ

আরমান হোসেন রুমন, নওগাঁ

নওগাঁর একটি আম বাগান ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

উত্তরাঞ্চলে ধান-চাল উৎপাদনে বৃহত্তর জেলা হিসেবে নওগাঁর পরিচিতি রয়েছে বেশ কয়েক যুগ ধরেই। এরই মধ্যে জেলার অর্জনের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে আম। লাভবান হওয়ায় আম চাষে ঝুঁকছেন জেলার তরুণ উদ্যোক্তারা। গত ১০ বছরে জেলায় আমের বাগান তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জকে ছাড়িয়ে নওগাঁ পরিচিতি পেয়েছে।    

দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আম রফতানি করে লাভবান হচ্ছেন জেলার তরুণ উদ্যোক্তারা। গত বছর কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় ১৫ টন আম রফতানির পর এবার নতুন করে আরো ১০০ টন আম রফতানি হবে বলছে কৃষি বিভাগ। এরই মধ্যে গত ২০ জুন জেলার সাপাহারের তরুণ আমচাষী ১০০ টন আম্রপালি যুক্তরাজ্যে রফতানি করেছেন। জেলায় আমকেন্দ্রিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে দ্রুত অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়ন এবং আম সংরক্ষণাগার স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন চাষীরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে জেলায় হাজার ২৭০ হেক্টর জমিতে আমের বাগান ছিল। জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা সাপাহার, পোরশা, পত্নীতলা, ধামইরহাট নিয়ামতপুর উপজেলা বরেন্দ্র এলাকা হিসেবে পরিচিত। পানিস্বল্পতার কারণে ১০ বছর আগেও ওই এলাকার কৃষকদের বছরে একবার বৃষ্টিনির্ভর ফসল আমন ধানের ওপর নির্ভর করে চলতে হতো। এতে আর্থসামাজিক উন্নয়ন থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়তে হয়েছিল তাদের। এর পরই ওই অঞ্চলের কৃষক জমিতে ধানের আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আম চাষের দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করেন। আম চাষ শুরুর পর তাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১০ বছরের ব্যবধানে চলতি মৌসুমে আমের বাগান তিন গুণ বেড়ে জেলায় ২৯ হাজার ৪৭৫ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের আমের বাগান গড়ে উঠেছে। প্রতি হেক্টর জমিতে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ১২ টন। সে হিসাবে বছর প্রায় লাখ ৬৮ হাজার ৪৩৫ টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ।

জানা যায়, জেলার সবচেয়ে বড় আমের পাইকারি বাজার সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর পত্নীতলার আড়তগুলোয় গত দুই সপ্তাহ যাবত দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা আসছেন। বর্তমানে সেখানে প্রতি মণ ল্যাংড়া আম হাজার ৮০০ টাকা থেকে হাজার ৩০০ টাকা, নাকফজলি আম হাজার ৬০০ টাকা থেকে হাজার ২০০, আম্রপালি হাজার টাকা থেকে ৩৫০০ টাকায় কেনাবেচা করছেন আমচাষীরা। চার জাতের আমের মধ্যে নওগাঁর আম্রপালি আমের চাহিদা দেশীয় বাজারে সবচেয়ে বেশি।

সাপাহার উপজেলার গোডাউনপাড়ায় ১৫০ বিঘা জমিতে বরেন্দ্র এগ্রো পার্ক নামের পৃথক দুটি সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তুলেছেন তরুণ উদ্যোক্তা আমচাষী সোহেল রানা। যেখানে বিদেশে রফতানির জন্য আলাদাভাবে ৭০ বিঘা জমিতে আম্রপালি, বারি-, গৌড়মতি, ব্যানানা ম্যাংগো, কাটিমন, ল্যাংড়া, হিমসাগর, ফজলি, মিয়াজিকিসহ দেশী-বিদেশী বিভিন্ন জাতের আমের বাগান গড়ে তুলেছেন। তিনি বলেন, গত বছর ইংল্যান্ড কাতারে আম্রপালি এবং ব্যানানা ম্যাংগো জাতের আট টন আম রফতানি করে দেশীয় বাজারের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি দাম পেয়েছিলাম। বছর রফতানির জন্য আম্রপালি, বারি-, গৌড়মতি ব্যানানা ম্যাংগো জাতের ৫০ টন আমের চাহিদা পেয়েছি। গত ২০ জুন এক টন আম্রপালি আম যুক্তরাজ্যে পাঠিয়েছে।

একই উপজেলার তিলনা ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা আমচাষী মোনেম শাহরিয়ার নবাব বলেন, গত পাঁচ বছর আগে আট বিঘা জমিতে ধানের আবাদ বন্ধ করে আম্রপালি ফজলি জাতের আমের বাগান গড়ে তুলি। এর দেড় বছর পর থেকেই বাগানে আম পাচ্ছি। আম চাষ লাভবান হওয়ার পর আরো ১২ বিঘা জমিতে আমের বাগান গড়ে তুলেছি।

পোরশা উপজেলার ঘাটনগর গ্রামের আমচাষী আশরাফুল ইসলাম বলেন, ৭৫ বিঘা বাগানে প্রায় ৭০ হাজার পিচ ব্যানানা ম্যাংগো জাতের আম ফ্রুট ব্যাগিং করে রেখেছি। ফ্রুট ব্যাগিং করায় কীটনাশকের খরচ কম পড়ছে। বছর কয়েকটি দেশে আম রফতানির জন্য কথা চলছে। দেশের বিভিন্ন সুপারশপের সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তি হয়েছে। বিদেশে যেসব আম রফতানি করা হবে সেগুলো ঢাকায় কোয়ারেন্টাইন হয়। আমের কোনো রোগবালাই বা কীটনাশক আছে কিনা, তা পরীক্ষার পর বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) একেএম মনজুরে মাওলা বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলা এবং বাইরের দেশগুলোয় নওগাঁর আমের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণ অঞ্চলের মাটি এঁটেল দোঁআশ হওয়ায় আম অনেক সুস্বাদু হয়। দেশের বিভিন্ন জেলায় যখন আমের মৌসুম শেষের পথে, তখনও এখানে প্রচুর আম্রপালি আম পাওয়া যায়। শেষ মুহূর্তে এসে চাষীরা বেশি দামে আম বিক্রি করতে পেরে লাভবান হচ্ছেন। এজন্য প্রতি বছর জেলায় আমের বাগান উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে।

নওগাঁ জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, জেলায় আমকেন্দ্রিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে চাষীদের বিপণন সুবিধার্থে স্থানীয় বাজারগুলো অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের মাধ্যমে প্রশস্ত করা হয়েছে। চাষীরা যাতে আমের ন্যায্যমূল্য পান, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রতিটি বাজারে মনিটরিং টিম কাজ করছে। জেলায় আমের ফলন ভবিষ্যতে আরো বাড়ানোর লক্ষ্যে কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় আধুনিক উপায়ে আম চাষে কৃষকদের উৎসাহ এবং প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল দ্রুত বাস্তবায়ন এখানে আমকেন্দ্রিক কারখানা গড়ে উঠলে চাষীরা আরো লাভবান হবেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন