পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

‘আমরা বিজয়ী হয়েছি’

নিজস্ব প্রতিবেদক, মাওয়া থেকে ফিরে

আজকে বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত। সেই সঙ্গে আমিও আনন্দিত, গর্বিত উদ্বেলিত। অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে, ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে আমরা আজকে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছি। সেতু শুধু একটি সেতু নয়, সেতু যে শুধু দুপারের বন্ধন সৃষ্টি করছে তাও নয়, সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিল-লোহা-কংক্রিটের একটি অবকাঠামো নয়; সেতু আমাদের অহংকার। সেতু আমাদের গর্ব। সেতু আমাদের সক্ষমতা, আমাদের মর্যাদার শক্তি। সেতু বাংলাদেশের জনগণের। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ, আমাদের সৃজনশীলতা, সাহসিকতা, সহনশীলতা আমাদের প্রত্যয় যে আমরা সেতু তৈরি করবই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন। বেলা ১১টা ৫৮ মিনিটে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সরকারপ্রধান। এর আগে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু আমরা যখন নির্মাণ করতে যাই, তখন অনেক ষড়যন্ত্র শুরু হয়। মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়। দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে একেকটি মানুষ, একেকটি পরিবারকে মানসিক যন্ত্রণা দেয়া হয়েছে। সে যন্ত্রণা ভোগ করেছিল আমার ছোট বোন শেখ রেহানা, আমার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, আমার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ, রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী, আমার অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা . মসিউর রহমান। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক যোগাযোগ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াসহ যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের ওপর মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়। তাদের অমানুষিক যন্ত্রণা, তাদের পরিবার যে যন্ত্রণা ভোগ করেছে, আমি তাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাই।

তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রের কারণে সেতুটি নির্মাণে দুই বছর বিলম্বিত হয়। কিন্তু আমরা কখনো হতোদ্যম হইনি, হতাশায় ভুগিনি। আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চলেছি এবং শেষ পর্যন্ত সব অন্ধকার ভেদ করে আলোর পথে আমরা যাত্রা করতে সক্ষম হয়েছি।

পদ্মা সেতু নির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সেতু নির্মাণের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেনসব প্রকৌশলী, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারী, দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞ পরামর্শক, ঠিকাদার প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ, শ্রমিক, নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনী পুলিশ বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। কৃতজ্ঞতা জানাই দেশবাসীর প্রতি, যারা সেদিন আমাকে শক্তি জুগিয়েছিল। সাহস জুগিয়েছিল। পাশে দাঁড়িয়েছিল। ধন্যবাদ জানাই পদ্মা সেতুর দুই পারের মানুষকে। যারা এখানে বসবাস করত, তারা নির্দ্বিধায় তাদের জমি হস্তান্তর করেছে। তাদেরকেও, তাদের পরিবারকেও আমরা পুনর্বাসন করেছি। তাদের প্রতিও আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। তাদের ত্যাগ সহযোগিতা না হলে হয়তো সেতু নির্মাণ করা কঠিন হতো।

পদ্মা সেতু নির্মাণকাজের গুণগত মান নিয়ে কোনো আপস করা হয়নি মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, সেতু নির্মিত হয়েছে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি উপকরণ দিয়ে। সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা বজায় রেখে। পুরো নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে। পদ্মা সেতুর পাইল বা মাটির গভীরে বসানো ভিত্তি এখন পর্যন্ত বিশ্বে গভীরতম। সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত সেতুর পাইল বসানো হয়েছে। ভূমিকম্প প্রতিরোধ বিবেচনায় ব্যবহূত হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি।

তিনি বলেন, বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে পদ্মা সেতুর নির্মাণ পদ্ধতি বিশ্বজুড়ে প্রকৌশলবিদ্যার পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হবেএটা নিশ্চিত। কারণ এটা একটা আশ্চর্য সৃষ্টি। বিশাল কর্মযজ্ঞ থেকে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছেন আমাদের দেশের প্রকৌশলীরা। ভবিষ্যতে নিজেরাই ধরনের জটিল সেতু বা অবকাঠামো নির্মাণ করতে সক্ষম হব আমরা।

সরকারপ্রধান বলেন, আজকে পদ্মার বুকে জ্বলে উঠেছে লাল, নীল, সোনালি, সবুজ আলোর ঝলকানি। ৪২টি স্তম্ভ, স্তম্ভ যেন স্পর্ধিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না। কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি। আমরা বিজয়ী হয়েছি। তারুণ্যের কবি সুকান্তের ভাষায় তাই বলতে চাই, সাবাশ বাংলাদেশ! পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়। জ্বলে-পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়। আমরা মাথা নোয়াইনি। আমরা কখনো মাথা নোয়াব না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কখনো মাথা নোয়াননি। তিনি আমাদের মাথা নোয়াতে শেখাননি।

পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ অনেক কঠিন ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সেতু নির্মাণ যেমন কঠিন ছিল, তেমনি আঁকাবাঁকা, খরস্রোতা উন্মত্ত পদ্মা নদীকে শাসনে রাখাটাও একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল। সে চ্যালেঞ্জও সফলভাবে মোকাবেলা করে নদীর দুই পাড়কে সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেতুর উভয় দিকে রয়েছে উন্নত ব্যবস্থাপনাসমৃদ্ধ দৃষ্টিনন্দন সার্ভিস এরিয়া। মাওয়া জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, যা মূল সেতুকে জাতীয় সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করেছে। সেতুর ৪১টির মধ্যে ৩৭টি স্প্যানের নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

সরকারপ্রধান বলেন, বহুমুখী সেতুর ওপরের ডেক দিয়ে যানবাহন এবং নিচের ডেক দিয়ে চলাচল করবে ট্রেন। সেতু চালু হওয়ার পর সড়ক রেলপথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। ফলে একদিকে যেমন অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের ভোগান্তি লাঘব হবে; অন্যদিকে অর্থনীতি হবে বেগবান। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হবে। আশা করা হচ্ছে, সেতু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে দশমিক ২৩ শতাংশের বেশি হারে অবদান রাখবে, ফলে দারিদ্র্য নিরসন হবে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে গড়ে উঠবে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল হাইটেক পার্ক। ফলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে এবং দেশের শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত হবে।

পদ্মার দুই পারে পর্যটন শিল্পেরও ব্যাপক প্রসার ঘটবে বলে সময় আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বছরের শেষ নাগাদ কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল ঢাকায় মেট্রোরেল চালু হবে। ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন শুরু হবে। ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। সেটিও ২০২৩ নাগাদ চালু হবে।

প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রবেশ করেন সকাল ১০টায়। সড়ক পরিবহন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম।

অনুষ্ঠানের শুরুতে শিল্পকলা একাডেমি নির্মিত দেশের বরেণ্য শিল্পীদের অংশগ্রহণে পদ্মা সেতুর থিম সং পরিবেশিত হয়। এছাড়া পদ্মা সেতুর ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়। সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট, স্যুভেনির শিট, উদ্বোধনী খাম সিলমোহর এবং ১০০ টাকা মূল্যের স্মারক নোট অবমুক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। সময় পদ্মা সেতুর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের (এমবিইসি) পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে পদ্মা সেতুর একটি রেপ্লিকা উপহার দেয়া হয়। সবশেষে পদ্মা সেতু নির্মাণ-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ছবি তোলেন তিনি। এরপর প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর টোল দিয়ে সেতু এলাকায় প্রবেশ করে। টোল প্রদানের পর মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক ম্যুরাল- উন্মোচন মোনাজাতে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন