মুখগহ্বরের ক্যান্সারজনিত মৃত্যুহারে শীর্ষে বাংলাদেশ

তামাক সেবন নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হোক

দেশে নানা ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। তার মধ্যে প্রকোপের দিক থেকে বেশি দৃশ্যমান একটি ধরন হলো মুখগহ্বরের ক্যান্সার। তথ্য বলছে, ২০২০ সালে দেশে সাড়ে ৩০ হাজার মুখগহ্বরের ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়েছে। একই বছর মারা গেছে ১৬ হাজার ৮৮৪ জন রোগী। বয়স-প্রমিত হারে মৃত্যুহার দাঁড়ায় প্রতি লাখে ১১ দশমিক জন, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। দেশে মুখগহ্বরের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশই দায়ী তামাক। কাজেই আলোচ্য রোগের বিস্তার রোধে তামাক সেবন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একই সঙ্গে দরকার আক্রান্তদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ কাম্য।

মুখগহ্বরের ক্যান্সার আগেও ছিল। তবে ততটা দৃশ্যমান ছিল না। এখন দিন দিন এর ব্যাপকতা বেড়েই চলছে। এর পেছনে নানা কারণ কাজ করছে। ২০৪০ সাল নাগাদ সরকার তামাকমুক্ত দেশ গড়ার ঘোষণা দিলেও এর ব্যবহার কমানো যাচ্ছে না। ধূমপান, পানের সঙ্গে সুপারি-জর্দা-চুন ব্যবহার, গুল প্রভৃতি পদ্ধতিতে মানুষ তামাক গ্রহণ করছে। এক্ষেত্রে তামাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের দায়ও কম নয়। সরকার তামাকমুক্ত করতে চাইলেও তারা বিভিন্ন কৌশলে তাদের ব্যবসা বাড়াচ্ছে। প্রচার-প্রচারণাসহ নানা উপায়ে মানুষকে প্রলুব্ধ করছে তামাক সেবনে। অনেকেই আবার ভারসাম্যহীন খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত। সুস্থ থাকার জন্য ফলমূল, শাকসবজি পুষ্টিকর খাদ্য অপরিহার্য হলেও তাদের অনেকেই সেটা খাচ্ছে না। তদুপরি নিয়মিত পান করছে অ্যালকোহল। অন্য অঙ্গের মতো মুখ বা মুখগহ্বরের সুস্থতার জন্য হাইজিন গুরুত্বপূর্ণ হলেও বড়সংখ্যক মানুষের মধ্যে সম্পর্কে সচেতনতা নেই। এছাড়া অনেকেই ভুগছে অতিরিক্ত ওজন স্থূলতায়, যার সঙ্গে মুখগহ্বরের পরোক্ষ সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন চিকিৎসকরা। আছে এইচপিভি গোত্রের ভাইরাসের প্রভাবও। আলোচ্য রোগের ক্ষেত্রে ভাইরাসের সংশ্লিষ্টতা উঠে এসেছে বিভিন্ন গবেষণায়। সব মিলিয়ে বাড়ছে মুখগহ্বরের ক্যান্সার।

বিশ্বে ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ ধরন হলো মুখগহ্বরের ক্যান্সার। এক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলো আরো ঝুঁকিপূর্ণ। তথ্য বলছে, রোগে আক্রান্তদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই শনাক্ত হচ্ছে এসব দেশে। সংগত কারণে চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়ে তত্পর হয়ে উঠেছে উল্লিখিত দেশগুলো। আমরা দেখছি ভারত ২০০৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করেছে। আইনে জনপরিসর কর্মক্ষেত্রে ধূমপান তামাক গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তামাক যেহেতু দেশটির সংস্কৃতি ঐতিহ্যের সঙ্গে কিছুটা যুক্ত, সেজন্য তারা জীবনযাপনের ধরন আচরণ পরিবর্তনে কিছু সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে নানাভাবে তামাকবিরোধী সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে। ভুটান প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম একীভূত করেছে। ধর্ম, সমন্বিত স্কুল স্বাস্থ্য সিওপিডি সংক্রমণ প্রতিরোধ কর্মসূচির মধ্যে তামাকবিরোধী বার্তা জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর সুফলও মিলছে সেখানে। আগের চেয়ে সেখানে তামাক গ্রহণের হার বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। সঙ্গে কমছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিও।

চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে অ্যালকোহল সেবনের মাত্রা কম। এখানে মুখের ক্যান্সারের মূল কারণ হিসেবে কাজ করছে তামাক সেবন। কাজেই তামাক সেবন কমাতে হবে। সরকার ধূমপান তামাক পণ্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন করেছে। তামাকের ওপর শুল্কও বাড়িয়েছে। তবু কমছে না এর ব্যবহার। শুধু আইন করলে হবে না। তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে। সব ধরনের তামাক সেবন ধূমপানে নিরুৎসাহিত করতে হবে। প্রচুর ফল, সবজিসহ পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়ামসহ স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মুখের হাইজিন বিষয়েও জনসাধারণকে সচেতন করে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা পরিবার কল্যাণ বিভাগের মাধ্যমে তামাকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার। একই সঙ্গে প্রয়োজন বিদ্যালয়গুলোয় সুস্বাস্থ্য নিয়ে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান চর্চা চালু করা, যাতে শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই স্বাস্থ্যসচেতন হিসেবে গড়ে ওঠে।

আমরা দেখছি শুধু মুখের নয়, ক্যান্সারের অন্য ধরনগুলোরও প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দূষণ, রাসায়নিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, কীটনাশকের অনিরাপদ ব্যবহার প্রভৃতি বিষয় এক্ষেত্রে দায়ী। আমাদের পানি, নদী, খাদ্য কৃষি ব্যবস্থা যেভাবে দূষিত হচ্ছে, তাতে সামনে ক্যান্সারের প্রকোপ আরো বাড়বে। তাই দূষণ কমাতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি চিকিৎসা সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। সাম্প্রতিক ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালকে ৫০ থেকে ৩০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। রেডিওথেরাপির আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ঢাকার বাইরে বগুড়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেডিওথেরাপির সর্বাধুনিক লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিন সংযুক্ত হয়েছে। বেসরকারি খাতে কয়েকটি বড় হাসপাতালে রেডিওথেরাপিসহ ক্যান্সার চিকিৎসা চালু হয়েছে। সর্বশেষ প্রযুক্তির মেশিনও তাদের কাছে রয়েছে। বর্তমানে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে ১৯টি হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসার সুযোগ আছে। তবে এখনো দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার খরচ অনেক বেশি। ফলে দরিদ্র অনেক রোগীর ক্যান্সার চিকিৎসার সামর্থ্য নেই। তাই খরচের চাপ কমাতে ক্যান্সার চিকিৎসাকে বীমার আওতায় আনার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এটা আমলে নেয়া জরুরি।

চিকিৎসা পাওয়া নাগরিকের মৌলিক অধিকার। অধিকার রক্ষায় সবার জন্য সুলভে ক্যান্সারের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে রোগী যে হারে বাড়ছে, তার তুলনায় বিদ্যমান চিকিৎসা সুবিধা অপ্রতুল। তাই এটা আরো বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সচেতনতা বাড়াতেও জোর দিতে হবে অত্যধিক। এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে স্বাস্থ্য বিভাগকে। প্রতিরোধ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থায় জোরালো পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশে ক্যান্সারের প্রকোপ কমবে বলে প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন