২৫ জুন, ২০২২
বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি বহুল কাঙ্ক্ষিত বা প্রতীক্ষিত একটি দিন। গৌরবের দিন!
কারণ নতুন সম্ভাবনা ও নতুন দিগন্ত নিয়ে যাত্রা শুরু করছে পদ্মা সেতু। শুধু বাংলাদেশের
জন্য নয়, পুরো বিশ্বের জন্যই এক বিস্ময়।
পদ্মা সেতুর
ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ধরা হলেও ব্যয় হয়েছে ২৭ হাজার ৭৩২ কোটি ৮ লাখ টাকা
বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন টাওয়ার ও গ্যাসলাইনের
১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়সহ মূল সেতু নির্মাণে ব্যয় ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ধরা
হলেও ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৯৩৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এছাড়া নদীশাসনে ৮ হাজার ৭০৬ কোটি ৯১
লাখ, অ্যাপ্রোচ সড়কে ১ হাজার ৮৯৫ কোটি ৫৫ লাখ, পুনর্বাসনে ১ হাজার ১১৬ কোটি ৭৬ লাখ
এবং ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৬৯৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
প্রবল স্রোতের
এ পদ্মায় সেতুটি তৈরি করতে আধুনিক মানের সব উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। পাঁচটি বিশ্বরেকর্ডও
গড়েছে এ সেতু। সর্বাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহূত হয়েছে এটির নির্মাণে। খরস্রোতা পদ্মায়
পানিপ্রবাহ বিবেচনায় বিশ্বে অ্যামাজন (ব্রাজিল) নদীর পরেই এর অবস্থান।
এ সেতুর প্রথম
বিশ্বরেকর্ডটি হলো, মাটির ১২০ থেকে ১২২ মিটার গভীরে গিয়ে পাইল বসানো (প্রায় ৪০ তলা),
পৃথিবীর অন্য কোথাও কোনো সেতুতে পাইল এত গভীরে প্রবেশ করাতে হয়নি। এসব পাইল তিন মিটার
ব্যাসার্ধের। বিশ্বে এখন পর্যন্ত কোনো সেতুর জন্য এত গভীরে পাইলিং প্রয়োজন হয়নি এবং
মোটা পাইল বসানো হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। দ্বিতীয় রেকর্ড হলো, ভূমিকম্পের
বিয়ারিং-সংক্রান্ত। এ সেতুতে ‘ফ্রিকশন
পেন্ডুলাম বিয়ারিংয়ের’ সক্ষমতা
হচ্ছে ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত কোনো সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। রিখটার
স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।
এর পরের বিশ্বরেকর্ড
হলো, পিলার ও স্প্যানের মাঝে যে বিয়ারিং থাকে সেটি। এখানে ১০ হাজার ৫০০ টন ওজনের একেকটি
বিয়ারিং ব্যবহৃত হয়েছে। পৃথিবীতে এর আগে এমন বড় বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি কোনো সেতুতে।
অন্য রেকর্ডটি
হলো নদীশাসন-সংক্রান্ত। ১৪ কিলোমিটার (১.৬ মাওয়া, ১২.৪ জাজিরা) এলাকা নদীশাসনের আওতায়
আনা হয়েছে। এ নদীশাসনে খরচ হয়েছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকারও বেশি। পরের রেকর্ডটি সেতুতে
ব্যবহৃত ক্রেন। পিলারের ওপর স্প্যান বসাতে যে ক্রেনটি ব্যবহৃত হয়েছে, সেটি আনা হয়েছে
চীন থেকে। প্রতি মাসে এর ভাড়া বাবদ গুনতে হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। সাড়ে তিন বছরে মোট খরচ
হয়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বিশ্বে প্রথম এ সেতু বানাতেই এত দীর্ঘদিন ক্রেনটি ভাড়ায়
থেকেছে। এ ক্রেনের বাজারদর ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আরেকটি রেকর্ড হলো, পদ্মা সেতুই
বিশ্বে প্রথম, যেটি কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে নির্মিত।
ব্রাজিলের অ্যামাজন
নদীর পর প্রমত্তা পদ্মা বিশ্বে খরস্রোতা নদীর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। নিজস্ব
অর্থায়নে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘতম এ পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের মানুষের
পারাপারের জন্য উন্মোচিত হবে নবদিগন্তের দুয়ার।
দ্বিতল পদ্মা
সেতু দিয়ে বিভিন্ন এলাকার মানুষ রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করতে পারবে সহজেই। পুরো সেতুতে
পিলারের সংখ্যা ৪২। প্রতিটি পিলারে রাখা হয়েছে ছয়টি পাইল। একটি থেকে আরেকটি পিলারের
দূরত্ব ১৫০ মিটার। এ দূরত্বের লম্বা ইস্পাতের কাঠামো বা স্প্যান জোড়া দিয়েই সেতু নির্মাণ
হয়েছে। ৪২টি পিলারের ওপর ৪১টি স্প্যান বসানো দেশের দীর্ঘতম সেতুটির আয়তন ৬ দশমিক ১৫
কিলোমিটার।
বিশ্বব্যাংক
পদ্মা সেতু থেকে সরে গেলে ২০১২ সালের জুলাইয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত
নেন যে সরকারের নিজস্ব তহবিল দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করবেন। ২০১৬ সালে কানাডিয়ান সুপ্রিম
কোর্টও পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ বলে মামলাটি খারিজ করে দেয়। বাংলাদেশ
কলঙ্কমুক্ত হয়। প্রধানমন্ত্রীর ‘চ্যালেঞ্জ’ জয় লাভ করে।
আমাদের যোগাযোগ
ছিল একসময় নদীনির্ভর। এক্ষেত্রেও বাধা ছিল অসংখ্য নদ-নদী। যেকোনো সড়ক তৈরি করতে গেলেই
ছোট-বড় নদী অতিক্রম করতে হতো। একসময় উত্তরাঞ্চলের মানুষ কখনো ভাবতেই পারেনি সকালে রওনা
দিয়ে দুপুরে ঢাকা পৌঁছে যাবে। আবার কাজ শেষ করে সেদিনই ফিরে আসা সম্ভব হবে। ১৯৯৮ সালের
২৩ জুন যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুর উদ্বোধন করা হয়। সে সময়েই বহুপ্রতীক্ষিত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের
মানুষের যোগাযোগের সুবিধার জন্য স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়।
পদ্মা বহুমুখী
সেতু শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে দেবে। আরো বিশদভাবে
বলতে গেলে এ সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক
ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে এ সেতু আসলেই দেশের মানুষের স্বপ্নের
সেতু হয়ে উঠেছে।
এছাড়া সেতুটি
ভবিষ্যতে ট্রান্স-এশীয় রেলপথের অংশ হবে। তখন যাত্রীবাহী ট্রেন যত চলবে, তার চেয়ে অনেক
অনেক বেশি চলবে মালবোঝাই ট্রেন। ডাবল কনটেইনার নিয়ে ছুটে চলবে ট্রেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের
সঙ্গে যুক্ত হবে মোংলা ও পায়রা বন্দর। অর্থনীতিতে যুক্ত হবে নতুন সোনালি স্বপ্ন এবং
দেশের প্রবৃদ্ধিতে এ সেতু ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে।
পদ্মা সেতুর
কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘুরে যাবে দ্রুত। বাড়বে জীবনযাত্রার মান
ও কর্মসংস্থান। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য জেলার অধিবাসীদের
প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধক ছিল যমুনা নদী। এ নদীর ওপর যখন বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মিত
হলো, পাল্টে যায় অর্থনীতির গতিপথ।
পদ্মা সেতু
কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি, শিক্ষা, বাণিজ্য—সব ক্ষেত্রেই বিশাল ভূমিকা থাকবে। দক্ষিণাঞ্চলের
কুয়াকাটা ও সুন্দরবনসংলগ্ন ছোট ছোট বিভিন্ন দ্বীপ পর্যটন উপযোগী করা যাবে। কুয়াকাটা
সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন ও পায়রা বন্দরকে ঘিরে দেখা দেবে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা।
পদ্মা সেতু
চালু হওয়ার পর সড়ক ও রেল দুই পথেই দক্ষিণ বাংলার মানুষ অল্প সময়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে
পারবে। সেতুটির কারণেই প্রথমবারের মতো পুরো দেশ একটি সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোয় চলে আসবে।
দক্ষিণ বাংলার গ্রামেও পরিবর্তনের হাওয়া লাগবে। এ অঞ্চলের কৃষক, মত্স্যজীবী, তাঁতি,
ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভোক্তার সমাবেশ যে রাজধানী ঢাকা, তার সঙ্গে
অনায়াসে সংযুক্ত হতে পারবেন। অন্যদিকে তারা রাজধানী থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিয়ে
যেতে পারবেন তাদের গ্রামে ও আশপাশের এসএমই উদ্যোগগুলোর জন্য। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু
হবে শুনেই ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত হতে শুরু করেছে। পদ্মা সেতুর দুই পাড়েই এক্সপ্রেসওয়ের
পাশের জমির দাম তিন-চার গুণ বেড়ে গেছে।
নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য,
শিল্প-কারখানা, আবাসন প্রকল্প, রিসোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক
পার্ক, মানবসম্পদ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রেস্টুরেন্ট ও নানা ধরনের এসএমই উদ্যোগ স্থাপনের
হিড়িক পড়ে গেছে। খুলনা ও বরিশালে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের প্রসার ঘটতে শুরু করেছে। কুয়াকাটায়
পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটছে দ্রুতগতিতে। আগামী দিনে বিকাশের এ ধারা আরো বেগবান হবে।
পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে রেলের পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুত্ ও ইন্টারনেট অবকাঠামোও স্থাপিত
হবে। কলকাতার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগের সময় প্রায় অর্ধেকে নেমে আসবে। এর প্রভাবে বাংলাদেশ,
ভারত, ভুটান ও নেপালের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরের
পণ্যসেবার পরিমাণ বাড়বে। নতুন নতুন জাহাজ ভিড়বে। ইন্টারনেট সেবা সহজেই পেলে দক্ষিণাঞ্চলে
ডিজিটাল ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা বাড়বে। আর গ্যাস ও
বিদ্যুত্ সহজলভ্য হলে এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশও ঘটবে। কৃষিসহ দক্ষিণাঞ্চলের
সামগ্রিক উত্পাদন, সেবা, পর্যটন, শিল্প-বাণিজ্যেও বিনিয়োগ বাড়বে। বাড়বে কর্মসংস্থান।
আর সেটা হলে এখন যে জলবায়ু চ্যালেঞ্জের শিকার অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ গ্রাম ছেড়ে ঢাকায়
এসে ঝুঁকিপূর্ণ অনানুষ্ঠানিক কাজকর্ম করতে বাধ্য হচ্ছে, তাদের সংখ্যা কমে আসবে। দক্ষিণ
বাংলায় নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। নতুন নতুন শহরও গড়ে উঠবে।
পদ্মা সেতুকে
ঘিরে দুই পারে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে শহর গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা রয়েছে।
নদীর দুই তীরে আসলেই আধুনিক নগর গড়ে তোলা সম্ভব। তবে সেজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা
নিতে হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে যাবে। আর প্রতি বছর দারিদ্র্য
নিরসন হবে শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ। এর মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়নে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার
প্রায় ৬ কোটি মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন আনবে পদ্মা সেতু। একসময় দেশের উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা
দেখা দিত। এখন মঙ্গার কথা আর তেমন একটা শোনা যায় না। বঙ্গবন্ধু সেতু উত্তরাঞ্চলের এ
মঙ্গা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ঠিক একইভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো
এখনো শিল্পের দিক দিয়ে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। এ এলাকার বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ দারিদ্র্যসীমার
নিচে বসবাস করছে। পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ শেষ হলে সবার আগে উপকার হবে এই পিছিয়ে পড়া
মানুষগুলোর। কারণ পদ্মা সেতুর কল্যাণে ওইসব এলাকায় ব্যাপক আকারে শিল্পায়ন হবে, লাখ
লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। মানুষের আয় বাড়বে এবং জীবন-জীবিকায় পরিবর্তন আসবে।
২০৩৫-৪০ সালে
বাংলাদেশ যে উন্নত দেশ হবে, সেক্ষেত্রে এ সেতু নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, স্বপ্নের এ সেতুকে কেন্দ্র করেই সেতু অর্থনীতির সেতুবন্ধ ও নতুন
দিগন্ত উন্মোচন করবে।
বাংলাদেশ আজ
উন্নয়নশীল দেশের পথে। তাছাড়া পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতুই নয়, এটি আমাদের উন্নয়ন, অহংকার,
অহংকারের প্রতীক। আত্মমর্যাদা, আত্মপরিচয়, যোগ্যতা সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার
প্রত্যয়ের ফসল। বিশ্বের অন্যতম সুখী দেশের পথে বাংলাদেশও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে।
সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে নির্মাণ হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক