আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর অনেক উন্নয়ন
প্রকল্পের পাশাপাশি বেশকিছু মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেন। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি
হলো ‘পদ্মা সেতু
নির্মাণ’ প্রকল্প।
এটি বাংলাদেশীদের জন্য একটি স্বপ্ন হিসেবে চিত্রিত বা রূপায়িত হয়েছিল। আর এ স্বপ্নের
রূপকার ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের
ফলে এবং তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক যখন ২০১২ সালে ২৯ জুন পদ্মা সেতুর
ঋণ চুক্তি বাতিল করে এবং অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীও সরে দাঁড়ায় তখন ওই বছরই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃঢ় মনোভাবের বাস্তব রূপায়ণই আজকের স্বপ্নের পদ্মা সেতু। আমদের
মতো আমজনতার এটা জানা নেই যে তিনি কিসের ভিত্তিতে, কোন ভরসায় এ রকম একটি বড় সিদ্ধান্ত
নিতে পেরেছিলেন।
তবে এ ঘটনার পর পরই আমরা দেখতে পেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর মানবিক উন্নয়ন দর্শনের একজন নিঃস্বার্থ ছাত্র ও স্বনামধন্য গবেষক অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত পদ্মা সেতু নিয়ে গভীর বিশ্লেষণধর্মী ও প্রায়োগিক একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যা ওই সময় সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। বৃহৎ গবেষণাপত্রটির শিরোনাম ছিল ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু: জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সুযোগ’। গবেষণাপত্রটি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি কর্তৃক আয়োজিত ‘নিজ অর্থে পদ্মা সেতু’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে মূল প্রবন্ধ হিসেবে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই ড. আবুল বারকাত কর্তৃক পঠিত হয়। ওই গবেষণাপত্রেই তিনি উল্লেখ করেন, ‘বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল অনৈতিক ও মহা অন্যায়, তবে তা বাংলাদেশের জন্য এক মহা আশীর্বাদ (blessing in disguise)। ১৯৭২-৭৩-এর বাংলাদেশ অর্থনীতি আর ২০১২-এর অর্থনীতি এক কথা নয়। এখন আমাদের অর্থনীতি অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী; জনগণ অনেক গুণ বেশি আত্মশক্তিসম্পন্ন। পদ্মা সেতু নির্মাণে জনগণ এখন অনেক গুণ বেশি ত্যাগ স্বীকারে সর্বাত্মক প্রস্তুত। জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি ও তা সুসংহতকরণের এখনই শ্রেষ্ঠ সময়।’
২০১২ সালে ওই গবেষণাপত্রে তিনি দেখান ‘আগামী চার বছরেই পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব এবং এর জন্য ব্যয় হবে আনুমানিক ২৪ হাজার কোটি টাকা। আর ঠিক একই সময়ে, অর্থাত্ চার বছর সময়কালে ১৪টি বিভিন্ন উত্স থেকে সম্ভাব্য অর্থসংস্থান হতে পারে ৯৮ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা, সেহেতু পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ পরিকল্পিতভাবে এ মুহূর্তেই শুরু করা সম্ভব। অর্থসংস্থানের ক্ষেত্রে বিশেষ জোর দিতে হবে সুদবিহীন উত্সগুলোয়—যেসব উৎস থেকে সম্ভাব্য আহরণ হতে পারে মোট ৪৯ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, অর্থাৎ দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয়ের সমপরিমাণ অর্থ।’
তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘সেই সঙ্গে জোর দিতে হবে নিজস্ব অর্থায়নের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ সংশ্লিষ্ট খাতগুলোয়।
এক্ষেত্রে করণীয় হবে নিম্নরূপ:
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করা; প্রবাসীদের প্রেরিত হুন্ডিকৃত অর্থ উত্তরোত্তর
অধিক হারে ব্যাংকিং চ্যানেলে আনা; পদ্মা সেতু বন্ড (৮ থেকে ৩০ বছর মেয়াদি), সার্বভৌম
বন্ড ও পদ্মা সেতু আইপিওতে প্রবাসী-বিদেশীদের বিনিয়োগে আগ্রহী করা; টাকার অংকের উদ্বৃত্ত
অর্থ (৪ বছরে মোট ৭৪,২২৫ কোটি টাকা) উত্পাদনশীল বিনিয়োগ করে রফতানি আয় বৃদ্ধি করা।’
তিনি বলেন, ‘করণীয় বিষয়াদির মধ্যে গুরুত্বসহ বিবেচনা করতে হবে: (১) তিনটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন। সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ও বাস্তবায়ন সমন্বয়কারী কমিটি হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে পদ্মা সেতু ইন্টেগ্রিটি কমিটি, আর সঙ্গে থাকবে অর্থায়ন-অর্থসংস্থান কমিটি এবং কারিগরি-প্রযুক্তি কমিটি; (২) ‘পদ্মা সেতু পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি’ গঠন করে তার মাধ্যমে বাজারে আইপিও ছাড়া; (৩) পদ্মা সেতুসহ বৃহত্ অবকাঠামোর জন্য নির্মাণসামগ্রী (যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ, কাঁচামাল) উত্পাদন নিমিত্ত শিল্প স্থাপনে পদক্ষেপ নেয়া; (৪) সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের (দেশে-বিদেশে অবস্থানরত) হালনাগাদ তালিকা প্রণয়ন ও সংরক্ষণসহ জরুরি ভিত্তিতে এবং নিয়মিত তাদের পরামর্শ গ্রহণের জন্য জীবন্ত-রিয়েল টাইম ওয়েবসাইট চালু রাখা; (৫) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘Friends of Padma Bridge, Bangladesh’ চেতনায় উদ্বুদ্ধ সংগঠন গড়ে তোলা; (৬) গণঅবহিতকরণ কার্যক্রমসহ সংশ্লিষ্ট প্রচার ব্যবস্থা শক্তিশালী করা।’
হিসেবপত্তর করে তিনি আরো দেখান ‘পদ্মা সেতু নির্মাণের ৩০ বছরের মধ্যেই নির্মাণ ব্যয় উঠে আসবে; ১০ম বছর থেকে যেহেতু ঘাটতি থাকবে না, সেহেতু বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে পদ্মা সেতুর জন্য আর বরাদ্দ রাখার প্রয়োজন হবে না; সেতু চালু হওয়ার ৪০তম বছরে নিট ক্যাশ ফ্লো ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে আর ১০০তম বর্ষে তা ছাড়িয়ে যাবে ২ লাখ কোটি টাকা; উন্নত কানেকটিভিটি সমগ্র অর্থনীতির (শুধু দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের নয়) চেহারা আমূল পাল্টে দেবে। সুতরাং নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বিনির্মাণ বিষয়টি হতে পারে উন্নয়ন আন্দোলনের (development as movement) বিশ্বনন্দিত ‘Made in Bangladesh’।
বাঙালির অহংকার ও গর্ব—স্বপ্নের পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন হতে যাচ্ছে ২৫ জুন। এ নিয়ে দেশজুড়ে চলছে বেশ তোড়জোড়। আমাদের দেশের বিজ্ঞ সমাজের অনেকেই এখন এ নিয়ে বক্তব্য ও বিবৃতি দিচ্ছেন। কেউ কেউ দাবি করেও বসছেন যে তারাই পদ্মা সেতু যে নিজস্ব অর্থে তৈরি করা সম্ভব, তার পক্ষে প্রথম যুক্তিদাতা। কিন্তু সত্য হলো, ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে বলে বিশ্বব্যাংক পুরোপুরি উদ্দেশ্যমূলকভাবে পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি যখন বাতিল ঘোষণা করল, যার ফলে বিশ্বব্যাপী দেশ-জাতি-সরকারের ভাবমূর্তির অপরিসীম ক্ষতি হলো; আর অন্যদিকে সামনে ২০১৪ সালের নির্ধারিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন—ঠিক এ ধরনের জটিল পরিস্থিতিতে ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব’ শীর্ষক গভীর গবেষণালব্ধ লিখিত দলিল নিয়ে জাতির সামনে হাজির হয়েছিলেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি, ‘গণমানুষের অর্থনীতিবিদ’ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। আর সামগ্রিকভাবে প্রতিকূল এক জটিল অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি কালক্ষেপণ না করে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই ‘নিজ অর্থে পদ্মা সেতু’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনার আয়োজন করে।
ওই জাতীয় সেমিনারে অধ্যাপক আবুল বারকাত ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু: জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সুযোগ’ শিরোনামে তার সৃজনশীল ও বাস্তবধর্মী গবেষণাকর্ম উত্থাপন করেন। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ যে সম্ভব এ দেশে, এ কথা বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির প্লাটফর্মে তিনিই প্রথম নৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রায়োগিক যুক্তি দিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণপূর্বক উত্থাপন করেন।
অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত ছাড়া কেউ তখন বিস্তারিত হিসেবপত্তরসহ উল্লেখ করেননি যে
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব। একমাত্র তিনিই উল্লেখ করেছেন, বিশ্বব্যাংক
‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে বলে ঋণ চুক্তি বাতিল করে। এটিই ছিল বিশ্বব্যাংকের
সঙ্গে একমাত্র মেগা প্রকল্পের চুক্তি। যা চুক্তি স্বাক্ষরের পর বাতিল করা হয়। কারণটি
ছিল খুবই সোজা—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
ও বিশ্বব্যাংক ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে আর ক্ষমতায় দেখতে চাইনি। এটি তাদের
দ্বারা গতানুগতিক চর্চা করা ‘Regime
Change’ ফর্মুলা।
এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, পদ্মা সেতু এ দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাসে
এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ উন্নত দেশে রূপান্তর
হওয়ার ক্ষেত্রে ও জাতীয় একতা বৃদ্ধিতে এ সেতু মেলবন্ধন হিসেবে কাজ করবে। এক্ষেত্রে
ড. বারকাত কর্তৃক ‘নিজস্ব অর্থায়নে
পদ্মা সেতু: জাতীয় ঐক্যের শ্রেষ্ঠ সুযোগ’ গবেষণা কর্মটি তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলেই প্রতীয়মান হয়।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ভাবনা ও গবেষণায় নীরবে, নিভৃতে ড. বারকাত যে অবদান রেখেছেন ও
রেখে যাচ্ছেন, তার গুরুত্ব অপরিসীম। এ পর্যন্ত তিনি যত গবেষণাকর্ম করেছেন, সেসবের কয়েকটি
মাইলফলক বা দিকনির্দেশক হিসেবে যেমন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত হয়েছে, তেমনি
এ দেশের উন্নয়নে তথা নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা
সেতু বাস্তবায়ন শীর্ষক গবেষণাটিও ড. বারকাতের একটি দিকনির্দেশক ও মাইলফলক গবেষণা।
২০১২ সালে গবেষিত এবং প্রকাশিত ড. আবুল বারকাতের ওই গবেষণা পুস্তিকা একটি নতুন সংযোজিত অধ্যায়সহ ২০২১ সালে গ্রন্থাকারে দ্বিতীয়বার প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির শিরোনাম ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সুযোগ‒২০১২ সালে গবেষণায় প্রমাণিত‒২০২১ সালে দৃশ্যমান বাস্তবতা’। গ্রন্থটির দ্বিতীয় প্রকাশ সম্পর্কে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির তত্কালীন কার্যনির্বাহক কমিটি যে ভূমিকা-বক্তব্য প্রদান করেছে তা তাত্পর্যপূর্ণ বলে মনে করি। ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব’ দেশ ও জাতির গৌরবান্বিত উন্নয়ন-প্রগতিতে অধ্যাপক আবুল বারকাতের এ দিকনির্দেশক গবেষণাকর্মটির জন্য পুরো জাতি দেশপ্রেমিক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাতের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে—এ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
পরিশেষে বলা যায়, আবুল বারকাত হলেন সেই অর্থনীতিবিদ, যিনি সবসময় দেশের ও দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করেন। তাদের কথা বলেন, তাদের উন্নয়নে কাজ করেন। সেজন্য তিনি গণমানুষের অর্থনীতিবিদ হিসেবেও খ্যাত। তিনি অন্তরে ধারণ করে আছেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্ন। নিজ অর্থে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা নিয়ে তিনি নীরবে, নিভৃতে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে গবেষণা করে যে তথ্য জাতির সামনে তুলে ধরেছিলেন সে সময়, তেমনটি আর কেউ করেছিল বলে জানা নেই। তার সুগভীর ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণার মাধ্যমে প্রতি মুহূর্তে তিনি এ দেশে বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক, আলোকিত ও শোভন সমাজ বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছেন। আবুল বারকাতের মতো কল্যাণকামী অর্থনীতিবিদ আমাদের দেশে বড় প্রয়োজন।
লেখত : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী