ওসমানীসহ সিলেট ও সুনামগঞ্জের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত যন্ত্রপাতি রোগ নির্ণয় কার্যক্রম বন্ধ

নূর আহমদ, সিলেট

বন্যাকবলিত সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

সিলেট বিভাগের সর্ববৃহৎ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সেই হাসপাতালে বন্যার পানি ঢুকে নষ্ট করে দিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি। এমআরআই, সিটিস্ক্যান, রেডিওথেরাপির মতো মেশিনারিজে পানি ঢুকে গিয়েছে। ফলে বন্ধ রয়েছে রোগ নির্ণয় সেবা কার্যক্রম। বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত মেশিনগুলো পুনরায় চালু হবে কিনা, তা নিশ্চিত বলতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। শুধু ওসমানী হাসপাতালই নয়, সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগের প্রাথমিক তথ্যে সুনামগঞ্জের ১১টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সই বন্যাকবলিত। এসব হাসপাতালে নষ্ট হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ মেশিনারিজ। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো ব্যবহূত হচ্ছে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম। এদিকে হাসপাতালগুলোয় ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগবালাই নিয়ে আসছেন রোগীরা।

সিলেট বিভাগের বন্যায় আক্রান্ত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের তথ্যসংক্রান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিভাগের মোট ৪০টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে ২৪টি বন্যাক্রান্ত। ৮৫টি ইউনিয়ন সাব সেন্টারের মধ্যে আক্রান্ত ৩১টি। সুনামগঞ্জে ২০ শয্যার দুটি হাসপাতালে পানি প্রবেশ করেছে। ৯২৭টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে ৪১৪টি ক্লিনিক পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বন্যাজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে ৪৬ জনের। বিভাগে ৪৫ লাখ ৫৫ হাজার ৭০১ জন বন্যাকবলিত হয়েছেন।

সিলেটের জৈন্তাপুর, বিয়ানীবাজার   গোলাপগঞ্জ বাদে বাকি ১০ উপজেলার সব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ জলমগ্ন ছিল। কোম্পানীগঞ্জ গোয়াইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রায় ১০ ফুট পানি ছিল। স্রোতের কারণে এসব হাসপাতালের অনেক আসবাব ভেসে গিয়েছে।

সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালসহ পুরো জেলার সব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মাত্রার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এখনো জেলার অনেক উপজেলা পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। গত ১৮ জুন সিলেটে দেড় ঘণ্টার ভারি বর্ষণে নগরীর ৮০ ভাগ এলাকা ডুবে যায়। এতে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সিলেট শহীদ শামসুদ্দীন আহমেদ হাসপাতালের নিচতলা প্রায় তিন ফুট পানিতে তলিয়ে যায়। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জেনারেটর জলমগ্ন হওয়ায় বিকল্প বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নিচতলায় পানি ওঠায় রোগীরা চরম দুর্ভোগে।

সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগের প্রাথমিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সব উপদ্রুত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, ইপিআই আইএলআর ফ্রিজ, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি, এক্স-রে মেশিন, এমএসআর সামগ্রী নষ্ট হয়ে গিয়েছে। জলমগ্ন এসব যন্ত্র কার্যক্ষম কিনা, পানি না সরায় তা এখনো যাচাই করা যাচ্ছে না। সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানাতে আরো সময় লাগবে।

এদিকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া জানান, হাসপাতালের নিচতলা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার নিজের অফিসে ছিল হাঁটু সমান পানি।

তিনি জানান, হাসপাতালের নিচতলায় এমআরআই, সিটি স্ক্যান মেশিন, রেডিওথেরাপি মেশিন জলমগ্ন ছিল। রেডিওথেরাপি মেশিনটি চালুর চেষ্টা চলছে। এমআরআই, সিটি স্ক্যান মেশিনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না। ফলে রোগীরা সিটিস্ক্যান, এমআরআই, রেডিওথেরাপি সেবাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাইরে থেকে এসব পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে আসতে হচ্ছে। হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স, পরিচালকের গাড়িসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নষ্ট হয়েছে। পুরোপুরি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিশ্চিত করতে আরো সময় লাগবে।

অন্যদিকে বন্যাকবলিত বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহূত হচ্ছে। দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বন্যার্তরা গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। 

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইয়াসিন আরাফাত জানান, কমপ্লেক্সের নিচতলায় এখনো বন্যার পানি। হাসপাতাল আশ্রয়কেন্দ্র হওয়ায় সেবা দিতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। এরই মধ্যে পানিবাহিত নানা রোগ নিয়ে লোকজন আসতে শুরু করেছেন। আশ্রয়কেন্দ্র হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে সেবা কার্যক্রম। তিনি জানান, কিছু আশ্রয়প্রার্থীকে অন্য আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তর হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পানিতে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে জানান ডা. আরাফাত। তিনি মনে করেন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে। আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে থাকলে সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হবে।

সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. আনোয়ার হোসেন শিশির জানান, পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গত দুই/তিনদিন থেকে এর সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মনে হচ্ছে। তিনি জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে।

শাল্লা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিনা আক্তার জানান, তার কমপ্লেক্সটি উঁচু এলাকায় থাকলেও আবাসিক ভবনসহ আশপাশ এলাকায় পানি উঠেছিল। তবে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. কামরুজ্জামান রাসেল জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিচতলায় ১০ ফুট পানি ছিল। যতটুকু বহনযোগ্য সেসব মেশিনারি দ্বিতীয় তলায় তোলা হয়েছিল। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মেশিনারিজ রক্ষা করা যায়নি। অনেক আসবাব ভেসে গিয়েছে। তিনি জানান, এখন পানি কমতে শুরু করেছে। তারা সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন।

সিলেট বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. হিমাংশু লাল রায় বণিক বার্তাকে জানান, চলমান বন্যা স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক ক্ষতি করেছে। অবকাঠামো এমনকি মেশিনারিজ নষ্ট করে দিয়েছে। অনেক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এখনো পানি। তবু চিকিৎসকরা স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, পানি নামছে বিভিন্ন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পানিবাহিত রোগ নিয়ে লোকজন আসতে শুরু করেছেন। তিনি বলেন, চিকিৎসকরা নিয়মিত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন ইত্যাদি সরবরাহ করা হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন