অভিমত

পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট

ড. এম কবির হাসান , ড. মোহাম্মাদ দুলাল মিয়া

অবকাঠামোগত উন্নয়ন একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। অর্থনীতির গতি বেগবান করার লক্ষ্যে বড় বড় প্রকল্প প্রণয়ন দরকার হয়, যেগুলো হবে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। যেমন শিল্পের প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন জোগান শিল্প উৎপাদন ক্ষমতা দক্ষতা বাড়ায়। তেমনি উন্নত রাস্তাঘাট, কালভার্ট সেতু নির্মাণ পরিবহন ব্যাবস্থাকে আধুনিক এবং উন্নততর করে পণ্য সেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে শিল্পের দরকারি কাঁচামাল সরবরাহ করা যায় নির্বিঘ্নে। ফলে পণ্যদ্রব্যের পরিবহন ব্যয় কমে অনেকাংশে, যে সুফলের একটা অংশ যায় প্রান্তিক ভোক্তার কাছে। সামষ্টিক অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে রাজস্ব ব্যয় বাড়িয়ে অবকাঠামোর উন্নয়ন দেশের মঙ্গল বয়ে আনে। বাংলাদেশের পদ্মা সেতুও তেমনি একটি বৃহৎ প্রকল্প, যা শিল্প উন্নয়ন প্রসারিত করার মাধ্যমে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিতে জোরালো ভূমিকা রাখবে।

পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাথমিক সূচনা হয় মূলত যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের মাধ্যমে। পরিবহন যোগাযোগ খাতের উন্নয়নে অর্থনীতির যে ইতিবাচক প্রভাব তা আরো স্পষ্ট হয় বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পর। এর রেশ ধরেই পদ্মা সেতুর প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি বা প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। ২০০১ সালে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হলে ওই বছরের জুলাইয়ে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ২০০৩ সালে জাপানের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয় সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য, যার অর্থায়ন করে জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা (জাইকা) মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টকে সেতুর উপযুক্ত স্থান হিসেবে উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবেদন জমা দেয় ২০০৫ সালে। তার পরের বছর শুরু হয় ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা। ২০০৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল বা ডিপিপি অনুমোদন পায়। পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়।

শুরুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার পরিকল্পনায় ২০১০ সালে মূল সেতু নির্মাণে ঠিকাদারদের প্রাথমিক যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়। দেশী-বিদেশী বেশকিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। যাচাই-বাছাই করে সেতুর চূড়ান্ত নকশা অনুমোদন হওয়ার পর ২০১১ সালে প্রকল্প অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকসহ আরো কিছু আঞ্চলিক উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে ঋণ চুক্তি হয়। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি মার্কিন ডলার ( মার্কিন ডলার ৭৪ টাকা হিসেবে ৮৮৮০ কোটি টাকা) ঋণ অনুমোদন দিয়েছিল, যা ২০১১ সালে দুর্নীতির অভিযোগ এনে স্থগিত করা হয় এবং ২০১২ সালে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে অফিশিয়ালি সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। তারপর ২০১২ সালের জুলাই মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে কয়েক দফায়। ২০০৭ সালে একনেকে যে ডিপিপি অনুমোদিত হয়, তার প্রাক্কলিত ব্যয় দেখানো হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের মধ্যে সেতুর কাজ শেষ হবে ধরে নিয়ে একনেক ডিপিপি অনুমোদন দেয়। ২০১০ সালে নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর ২০১১ সালে ডিপিপির সংশোধন করা হয়। সংশোধিত ডিপিপিতে প্রকল্পের ব্যয় একলাফে বেড়ে দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। চার বছরে ব্যয়ের এমন উল্লম্ফনের জন্য অনেক নিয়ামককে দায়ী করা হয়। প্রথমত, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। দ্বিতীয়ত, প্রাথমিক প্রস্তাবনায় পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছিল দশমিক ৫৮ কিলোমিটার। কিন্তু নদীর অবকাঠামো পরিবর্তনের ফলে চূড়ান্ত পর্যায়ে সেতুর দৈর্ঘ্য বেড়ে দাঁড়ায় দশমিক ১৫ কিলোমিটার। তৃতীয়ত, প্রথম ডিপিপিতে সেতুর ৪১টি স্প্যানের মধ্যে শুধু তিনটি স্প্যানের নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সংশোধিত ডিপিপিতে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে ৩৭টি স্প্যানের নিচ দিয়ে। চতুর্থত, অতিরিক্ত ভার বহনের উপযোগী করার জন্য কংক্রিটের বদলে ইস্পাত বা স্টিলের কাঠামো যুক্ত হয়। সেই সঙ্গে পাইলিংয়ের গভীরতাও বাড়ানো হয়। এসব কারণে নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যায়।

এর পর আরো তিন দফায় ডিপিপির পরিবর্তন করা হয়। ২০১৬ সালের সংশোধনীতে প্রাক্কলিত ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ ছিল টাকার অবমূল্যায়ন, নদীশাসনের আওতা বৃদ্ধি, সংযোগ সড়কের নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদি। তদুপরি জমি অধিগ্রহণের খরচও বাড়ে সমানতালে। ২০১৮ সালে আবারো ডিপিপির সংশোধন করে ব্যয় বাড়ানো হয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। ব্যয়ের মধ্যে জাপান সরকারের অনুদান আছে ৩০০ কোটি টাকা, যা পরিশোধ করতে হবে না। বাকি অর্থ সেতু বিভাগ পেয়েছে অর্থ বিভাগ থেকে। তাই সেতু বিভাগ সরকারকে শতাংশ হারে সুদসহ আসল ৩৫ বছরে পরিশোধ করবে। ২০১৯ সালে ডিপিপি আবারো সংশোধন করা হয়, তবে প্রকল্পের ব্যয় বাড়েনি; কিন্তু কাজ শেষ করার সময় বাড়ানো হয় ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত।

আগেই বলা হয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন অর্থনীতিকে গতিশীল করে। প্রকল্পের সমীক্ষা অনুযায়ী পদ্মা সেতুর প্রভাবে মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে দশমিক ২৩ শতাংশ। সেতুর ইতিবাচক প্রভাব যতটুকু না প্রত্যক্ষ, তার চেয়ে অনেক বেশি পরোক্ষ। সেতুর প্রাথমিক আয় বলতে ধরা হয় যানবাহন থেকে টোল আদায়কে। এরই মধ্যে সরকার যানবাহনের টোলের পরিমাণ নির্ধারণ করেছে, যা পরিবহনের শ্রেণীভেদে ১০০ থেকে হাজার টাকার বেশি হতে পারে। টোলের হার এবং প্রতিদিন যে পরিমাণে যানবাহন চলাচল করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে, তাতে প্রথম বছরেই আয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৪৬৮ কোটি টাকা। সেতু বিভাগের মতে, প্রথম দিকে দৈনিক গড়ে আট হাজার যানবাহন চলাচল করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। হিসাবে যানবাহনপ্রতি গড়ে টোলের পরিমাণ হবে হাজার ৬২৫ টাকা। তবে ২০২৫ সালের মধ্যে যানবাহনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে (প্রতিদিন প্রায় ৪১ হাজার) বাড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

এবার আসা যাক পদ্মা সেতুর পরোক্ষ সুবিধার কথায়। ফেরি সীমিতসংখ্যক যানবাহন পারাপার করতে পারে, ফলে ঘাটে অপেক্ষার সময় দীর্ঘ হয়। আবার বৈরী আবহাওয়ার জন্য ফেরি চলাচল পুরোপুরি বন্ধ থাকে অনেক সময়। এতে মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় এবং পচনশীল দ্রব্যের উৎপাদনের স্থান থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। সেতু নির্মাণের ফলে সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হবে। পণ্যের কাঁচামালের সহজলভ্যতা এবং সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা নিয়ে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। সেই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটবে, যা স্থানীয় লোকজনের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করবে। এতে নদীর অন্য প্রান্তে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটবে। অধিকন্তু, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলকে রেললাইনে সংযুক্ত করতে পারলে আন্তঃদেশীয় যানবাহন চলাচলের দ্বার উন্মুক্ত হবে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে ফেরি বা ট্রলারে চলাচলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি। পদ্মা সেতু অবশ্যই দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাবে বহুলাংশে।  

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জন্য একটাড্রিম প্রজেক্ট দেশের উন্নয়নে সেতু ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, সে ব্যাপারে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। প্রত্যক্ষ সুবিধার চেয়ে পরোক্ষ সুবিধা পাবে সেতুর দুই পাশের জনগণ।

 

. এম কবির হাসান: অধ্যাপক, নিউঅরলিন্স বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র

. মোহাম্মাদ দুলাল মিয়া: সহযোগী অধ্যাপক, নিজওয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ওমান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন