পদ্মা সেতু

অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও আত্মপ্রত্যয়ের প্রতীক

পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিঃসন্দেহে অনেক বড় অর্জন, অনেক বড় সফলতা এবং অত্যন্ত গৌরবজনক একটি বিষয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন অগ্রগতির নতুন যুগে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ আজ নতুন এক পরিচয়ে পরিচিত হয়েছে। যে পরিচয় সম্মানের, গৌরবের, সফলতার সক্ষমতার। পদ্মা সেতু চালু হলে এটি যে কেবল আশপাশের জনগণের জীবনমান এগিয়ে নেবে তা নয়, বরং এটা প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে পুরো বাংলাদেশের মানুষের জীবনকেই এগিয়ে নেবে। পুরো দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু হবে একটি নতুন মাইলফলক। ধরনের মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশেষভাবে অভিনন্দন ধন্যবাদ। তার অসামান্য উদ্যোগ, অসীম সাহস দৃঢ়তা বাংলাদেশের জন্য আজ সফলতা, অর্জন গৌরব বয়ে এনেছে। পাশাপাশি সেতু তৈরির সঙ্গে জড়িত দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞ, কর্মকর্তা-কর্মচারী, কলাকৌশলী, শ্রমিকদের অবদানকে স্বীকার করতে হবে। সেতু নির্মাণকালে যারা প্রয়াত হয়েছেন, তাদেরও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।

পদ্মা সেতুর মতো এত বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য সত্যিই একটি চ্যালেঞ্জ। তার পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সারা দেশের মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এটি বাংলাদেশের অন্যতম সাফল্যে পরিণত হয়েছে। সফলতা সহজে বাস্তবায়ন হয়নি। আর্থিক সংকট, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বিশ্বাস, মনোবল ইত্যাদি ছাড়াও নানা ধরনের বিষয় সামাল দিতে হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশ যেকোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার সক্ষমতা রাখে। একই সঙ্গে এটি প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় মনোবল, সাহসিকতা সক্ষমতার পরিচায়ক। নিজেদের শক্তি, সক্ষমতা ভূগোল নিজেদের মতো করে ব্যবহার করার প্রয়োজনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে। দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশকে বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করা এবং এর মধ্য দিয়ে দেশের মধ্যকার এতদিনকার অভ্যন্তরীণ দূরত্ব লাঘব হবে। ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, উন্নয়ন, কর্মসংস্থান তথা সব খাতে প্রভূত গতিসঞ্চার হবে। দেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদীর ওপর নিজস্ব অর্থায়নে বিশালাকৃতির সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে এটি আজ বাংলাদেশের জাতীয় আকাঙ্ক্ষা, প্রতীক চেতনায় পরিণত হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের সফলতা কেবল সেতুর সচলতার মধ্যে সীমাবদ্ধ বা নির্দিষ্ট নয়। পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্ধনের মাধ্যমে গোটা দেশের সঙ্গে সংযোগ যোগাযোগ স্থাপন করবে।

বাংলাদেশ যখন পরাধীন তখন বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার। সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে তার নেতৃত্বে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে স্বপ্ন দেখেছিলেন শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার, সোনার বাংলা গড়ার। কিন্তু তাকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে খুনিরা তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে দেয়নি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পদ্মা সেতুর সফল নির্মাণে দেশের মানুষও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। পদ্মা সেতুর প্রভাবে বাংলাদেশের, বিশেষ করে দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। অঞ্চলের একুশ জেলার অর্থনীতি সমাজে আসবে অকল্পনীয় পরিবর্তন। সেতু চালু হওয়ার পর সড়ক রেলদুই পথেই দক্ষিণ বাংলার মানুষ অল্প সময়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবে। দিনের পর দিন পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে না। ঝড়বৃষ্টিতে ফেরি বন্ধ থাকার কারণে মানুষের যাতায়াত থমকে থাকবে না। সেতুটির কারণেই প্রথমবারের মতো পুরো দেশ একটি সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোয় চলে আসতে সক্ষম হবে।

সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে যে সফলতা, এটি ব্যবস্থাপনায়ও তা ধরে রাখতে হবে। প্রকাণ্ড সেতু নির্মাণ ঈর্ষণীয় অর্জন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে তা যেন ভূলুণ্ঠিত না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবার সজাগ দৃষ্টি আবশ্যক। যদি বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে তাহলে পদ্মা সেতু থেকে ঈপ্সিত সাফল্য অর্জিত হবে কিনা, জনমনে এমন সন্দেহ থেকেই যায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিদ্যমান অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, পদ্মা সেতু ব্যবস্থাপনায় আরো দক্ষতা, আন্তরিকতা আইনানুগ পদক্ষেপ অনিবার্য। যোগাযোগ, সংযোগ অর্থনীতির সূচক ছাড়াও সেতুতে টাকা বিনিয়োগ থেকে দ্বিগুণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সুবিধা অর্জিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সুতরাং পদ্মা সেতুকে কেবল লোহার সেতু বা এর স্থাপনাকে প্রকৌশলগত অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা সমীচীন হবে না। বরং একে প্রযুক্তি, শিক্ষা, উন্নয়ন, ভূরাজনীতি সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করতে হবে।

প্রথমত, বাংলাদেশ যেকোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার সক্ষমতা রাখে, এটি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। একই সঙ্গে এটি শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবল, সাহসিকতা সক্ষমতার পরিচায়ক। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে আগের তথা প্রাচ্যের কাছে প্রতীচ্যের পূর্বতন সক্ষমতার নবতর উন্মোচন। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে নেতৃত্বদানকারী গৌরবান্বিত দেশের মর্যাদাসীন। তৃতীয়ত, নিজেদের শক্তি, সক্ষমতা ভূগোল নিজেদের মতো করে ব্যবহার করার প্রয়োজনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে বহুমুখী সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে। চতুর্থত, দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশকে বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করা এবং এর মধ্য দিয়ে দেশের মধ্যকার এতদিনকার অভ্যন্তরীণ দূরত্ব লাঘব হবে। ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, উন্নয়ন, কর্মসংস্থান তথা সব খাতে প্রভূত গতিসঞ্চার হবে। পঞ্চমত, দেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদীর ওপর নিজস্ব অর্থায়নে বিশালাকৃতির সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে এটি আজ বাংলাদেশের জাতীয় আকাঙ্ক্ষা, প্রতীক চেতনায় পরিণত হয়েছে।

দক্ষিণাঞ্চলের কৃষক, মত্স্যজীবী, তাঁতি, ছোট মাঝারি ব্যবসায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভোক্তার সমাবেশ যে রাজধানী ঢাকা, তার সঙ্গে অনায়াসে সংযুক্ত হতে পারবেন। অন্যদিকে তারা রাজধানী থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে পারবেন তাদের গ্রামের আশপাশের এসএমই উদ্যোগগুলোর জন্য। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু হবে শুনেই ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত হতে শুরু করেছে। পদ্মা সেতুর দুই পাড়েই এক্সপ্রেসওয়ের পাশের জমির দাম তিন-চার গুণ বেড়ে গেছে। নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, আবাসন প্রকল্প, রিসোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক, মানবসম্পদ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রেস্টুরেন্ট নানা ধরনের এসএমই উদ্যোগ স্থাপনের হিড়িক পড়ে গেছে। খুলনা বরিশালে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের প্রসার ঘটতে শুরু করেছে। কুয়াকাটায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটছে দ্রুতগতিতে। আগামী দিনে বিকাশের ধারা আরো বেগবান হবে। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে রেলের পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ ইন্টারনেট অবকাঠামোও স্থাপিত হবে। ফলে কলকাতার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগের সময় কমে আসবে। এর প্রভাবে বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান নেপালের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। পায়রা মোংলা সমুদ্রবন্দরের পণ্যসেবার পরিমাণ বাড়বে। নতুন নতুন জাহাজ ভিড়বে। আর গ্যাস বিদ্যুৎ সহজলভ্য হলে অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশও ঘটবে। কৃষিসহ দক্ষিণাঞ্চলের সামগ্রিক উৎপাদন, সেবা, পর্যটন, শিল্প-বাণিজ্যেও বিনিয়োগ বাড়বে। বাড়বে কর্মসংস্থান। আর সেটা হলে এখন যে জলবায়ু চ্যালেঞ্জের শিকার অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসে ঝুঁকিপূর্ণ অনানুষ্ঠানিক কাজকর্ম করতে বাধ্য হচ্ছে, তাদের সংখ্যা কমে আসবে। দক্ষিণ বাংলায় নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। নতুন নতুন শহরও গড়ে উঠবে।

ঢাকার কাছে বলে পদ্মার ওপারে ছোট-বড় নানা শিল্প বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। দক্ষিণ বাংলা হবে পর্যটনের এক উত্কৃষ্ট হাব। ছুটি পেলেই ঢাকা অন্যান্য নগরের বাসিন্দারা ছুটবে দক্ষিণ বাংলার প্রাকৃতিক ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের সন্ধানে। তারা যাবে কুয়াকাটা, সুন্দরবন, ষাটগম্বুজ মসজিদ এবং টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি পরিদর্শনে, যাবে পায়রা বন্দরে। পদ্মার চরগুলোয় গড়ে উঠবে নতুন নতুন রিসোর্ট পরিকল্পিত ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র। সরকারও এরই মধ্যে নানা পরিকল্পনা নিচ্ছে পদ্মাপারের পুরো এলাকাকে উন্নত করার লক্ষ্যে। শোনা যাচ্ছে, পদ্মার চরাঞ্চলে অলিম্পিক ভিলেজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, হাইটেক পার্ক, আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, বিমানবন্দরসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কথা ভাবছে সরকার। পদ্মা সেতুর কাছেই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী গড়ে উঠছে। এখানে থাকবে আধুনিক আবাসন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব সুযোগ-সুবিধা। পদ্মা সেতুর আশপাশে গার্মেন্ট অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রসার ঘটবে। খুলনা, বরিশাল পটুয়াখালীতে শিপ-বিল্ডিং শিল্পের বিকাশ ঘটবে। মোংলা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, মোংলা ইপিজেড, পায়রাবন্দর, রূপপুর প্রকল্পের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা গেলে এসব প্রকল্পে বিপুল কর্মসংস্থান ঘটবে। একটি গবেষণায় বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বছরে প্রায় বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির দশমিক শূন্য শতাংশের কর্মসংস্থান হবে। দক্ষিণ বাংলায় বাংলাদেশের ২৭ শতাংশ মানুষের বসবাস। বিচ্ছিন্ন থাকা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অঞ্চলের দারিদ্র্যের হার সারা দেশের গড় হার থেকে শতাংশ বেশি। সেতুর কারণে যোগাযোগ বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত হলে অঞ্চলের দারিদ্র্যের হার দশমিক শূন্য শতাংশ হারে কমবে। এর প্রভাবে সারা দেশের শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ দারিদ্র্য হার কমে আসবে। সেতুটি চালু হওয়ার পর দক্ষিণ বাংলায় শিল্প-কারখানা স্থাপনে আরো বেশি করে উৎসাহী হবেন দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তারা। তাদের যেন বিদ্যুৎ, নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনশক্তি পেতে কোনো অসুবিধা না হয়, এটি এখন থেকেই সংশ্লিষ্টদের দেখতে হবে। উদ্যোক্তাদের পদ্মার ওপারে যেতে উৎসাহিত করতে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। একই সঙ্গে ঢাকার ওপর চাপ কমাতে বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন