হাওরের জলাভূমি কমায় বন্যার ভয়াবহতা বাড়ছে : আইপিডি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : নিজস্ব আলোকচিত্রী

দেশে বন্যার ভয়াবহতা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে হাওর এলাকার জলাভূমির আশংকাজনকহারে কমে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)। “হাওর এলাকার ভূমি ব্যবহারের কয়েক দশকের পরিবর্তন ও এবারের বন্যার ব্যাপকতাঃ গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন ও সংশ্লিষ্ট আলোচনা” শীর্ষক আইপিডি বাংলাদেশ সংলাপে এ তথ্য জানানো হয়। আজ শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয় সংলাপটি।

সংলাপে বক্তারা জানান, গত ৩২ বছরে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত জেলার হাওর অঞ্চলের শুষ্ক মৌসুমের জলাভূমির পরিমাণ কমেছে শতকরা প্রায় ৮০ ভাগেরও বেশি। ফলে হাওর এলাকায় মৌসুমী বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট পানি ধারণের প্রাকৃতিক ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে গিয়েছে। তাই বন্যা দূর্যোগ এই এলাকায় নিয়মিতভাবে বন্যার ভয়াবহতা দেখা যাচ্ছে। 

বক্তারা আরো জানান, সিলেট-সুনামগঞ্জসহ উত্তরপূর্বাঞ্চলের অতি সাম্প্রতিক বন্যায় ভয়াবহতা ও ব্যাপকতার পেছনে অতিবৃষ্টির পাশাপাশি হাওর এলাকার জলাভূমি বিনষ্ট হয়ে যাবার দায় রয়েছে অনেক। হাওর এলাকার বর্তমান জলাভূমিগুলোকে বাঁচানোর যথাযথ উদ্যোগ ও এ অঞ্চলের হাওর-বাওড়, খাল-বিল, নদী-নালাগুলো প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ ও পানিধারণ ক্ষমতাকে বাড়ানো না গেলে আগামী দিনগুলোতেও বন্যার ভয়াবহতা থেকে জীবন-জীবিকা ও প্রাণ-প্রকৃতিকে রক্ষা করা যাবে না।

আইপিডির সহযোগিতায় অনুষ্ঠানটির তত্ত্বাবধান করেছেন বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. শাকিল আকতার। হাওর এলাকার ১৯৮৮-২০২০ সালের শুষ্ক মৌসুমের জলাভূমি এলাকার ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন সম্পর্কিত এ গবেষণাটি করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও পরিকল্পনাবিদ ইনজামামউল হক রিফাত। ২০২১ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত এ গবেষণাটি করা হয়। গবেষণায় ১৯৮৮, ১৯৯৪, ২০০৬, ২০১৩ ও ২০২০ সালের স্যাটেলাইট ইমেজ ক্লাসিফিকেশনের মাধ্যমে তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়।

আইপিডি বাংলাদেশ সংলাপে গবেষণাটির সারাংশ উপস্থাপন করেন আইপিডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ১৯৮৮ সালকে ভিত্তি ধরে হাওর এলাকার জলাভূমি ১৯৮৮ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে ৪০ ভাগ কমে যায় এবং ২০০৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে আরও ৩৭ ভাগ কমে গিয়ে এখন প্রায় ১৩ ভাগ এলাকা অবশিষ্ট আছে। এর বিপরীতে হাওর এলাকায় নির্মিত এলাকা (বিল্ট আপ এরিয়া) ২০০৬ সালে ২ দশমিক ২ শতাংশ ও ২০২০ সালে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি হাওর এলাকায় পতিত জমি, কৃষি জমি ও বনজ এলাকাও কমেছে আশংকাজনকভাবে। হাওর অঞ্চলের বিভিন্ন জেলার মধ্যে ১৯৮৮ সালের তুলনায় ২০২০ সালে শুষ্ক মৌসুমের জলাভূমির পরিমাণ সিলেটে ৭৫ ভাগ, সুনামগঞ্জে প্রায় ৮০ ভাগ, নেত্রকোনায় প্রায় ৯০ ভাগ, কিশোরগঞ্জে প্রায় ৮৫ ভাগ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রায় ৭০ ভাগ, হবিগঞ্জে প্রায় ৯০ ভাগ এবং মৌলভীবাজারে প্রায় ৭০ ভাগ কমে গিয়েছে।

অধ্যাপক আদিল বলেন, ১৯৮৮ সাল থেকে হাওরের শুষ্ক মৌসুমের জলাভূমির পরিমাণ প্রায় ৫ ভাগের ১ ভাগে কমে যায় এবং বাকি ৪ ভাগ জমিতে বসত-বাড়ি, সড়ক সহ বিভিন্ন ধরনের নির্মিত এলাকা তৈরি হওয়ার কারণে (বিল্ট আপ এরিয়া) ধূসর অবকাঠামোর পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়ে যায়। হাওর এলাকার উল্লেখযোগ্যভাবে জলাভূমি ধ্বংস হয় ২০০০ থেকে ২০১৩ সালে মধ্যে। আইপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, জলাভূমির পরিবর্তন জীববৈচিত্র্যে তাৎপর্যমূলক প্রভাব ফেলছে যা উপেক্ষা করে জলবায়ু পরিবর্তন ও বন্যার প্রভাব মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। আগের বছরগুলো থেকে বর্তমানে বন্যার ভয়াবহতা আরো বেশি হওয়ার কারণ অতিবৃষ্টি নদী-নালার নাব্যতা সংকটের পাশাপাশি জলাভূমির ভরাট করে বাড়িঘর ও বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ। ২০১২ সালে হাওর এলাকার মহাপরিকল্পনা তৈরি হওয়ার পর এ ধ্বংসের পরিমাণ কিছুটা কমতে থাকে।  

তিনি আরো বলেন, হাওর এলাকা রক্ষা ও প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করা, মানুষের সচেতনতা বাড়ানো ও স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর যথাযথ তদারকির মাধ্যমে কিছুটা হলেও রক্ষা করা সম্ভব। দেশের হাওর এলাকার ভূমি রক্ষা করা ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে বন্যা ব্যবস্থাপনা ও প্রতিবেশ রক্ষা করা সম্ভব নয়।

পরিকল্পনাবিদ ইনজামামউল হক রিফাত বলেন, স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণে নানাবিধ চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করেই এই গবেষণা সম্পন্ন করা হয়েছে। হাওর এলাকার জলাভূমির আশংকাজনক পরিবর্তন এখনই রোধ না করা গেলে এ এলাকার পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি বন্যার আশংকা আরো ব্যাপকতর হবে।

সংলাপে আইপিডির পরিচালক পরিকল্পনাবিদ আরিফুল ইসলাম বলেন, এবারের বন্যার জন্য দায়ী আন্তঃদেশীয় নদীর অতিরিক্ত পানির প্রবল চাপ, পলি জমাটের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা সংকট ও নদী-জলাশয়ের পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়া। উৎকণ্ঠার জায়গা হলো, হাওর এলাকার উন্নয়ন কার্যক্রম টেকসই হচ্ছে কিনা। হাওর এলাকার উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশ-প্রতিবেশকে গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানান এ পরিকল্পনাবিদ।  

সংলাপে বক্তারা আরো বলেন, হাওর এলাকার জলাভূমি পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি ভূমি শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী পরিবেশ-প্রতিবেশগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে যে কোনো ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প ও উদ্যোগ নেয়ার আগে পরিবেশগত সমীক্ষা ও পরিকল্পনাগত প্রভাব বিশ্লেষণ প্রতিবেদন তৈরি করা প্রয়োজন।

সংলাপে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, চৌধুরী মো. যাবের সাদেক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও পরিকল্পনাবিদ ফরহাদুর রেজা প্রমুখ।

 


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন