কভিড-১৯-এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে আবারো সংক্রমণ বাড়ছে। দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সৃষ্ট বন্যায় এরই মধ্যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বহির্বিশ্বে সাম্প্রতিক যুদ্ধাবস্থার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালসহ বিভিন্ন উপকরণের মূল্য ও পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। এসব কারণে ঋণগ্রহীতাদের নেয়া ঋণের বিপরীতে কিস্তির পুরো অর্থ পরিশোধে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে এসেছে। এসব দিক বিবেচনায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা বজায় রাখা ও বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের গতিধারা স্বাভাবিক রাখতে উদ্যোক্তাদের ঋণ পরিশোধে ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং নীতি ও প্রবিধি বিভাগ থেকে ঋণ শ্রেণীকরণ-সংক্রান্ত একটি পরিপত্র জারি করে তা দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কাছে পাঠানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিপত্রে বলা হয়েছে, বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে দেয়া যেসব মেয়াদি ঋণ এ বছরের ১ এপ্রিল পর্যন্ত অশ্রেণীকৃত অবস্থায় রয়েছে, সেগুলোর বিপরীতে এ বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়ের কিস্তির ৫০ শতাংশ, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে প্রদেয় কিস্তির ৬০ শতাংশ এবং অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে প্রদেয় কিস্তির ৭৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করা হলে এসব ঋণকে খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকরণ করা হবে না। এক্ষেত্রে প্রতি প্রান্তিকের ঋণের কিস্তি প্রান্তিকের শেষ কার্যদিবসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। ২০১৬ সালের জাতীয় শিল্পনীতির সংজ্ঞা অনুসারে বৃহৎ শিল্প নির্ধারণ করা হবে।
একইভাবে সিএমএসএমই ও কৃষি খাতে বিতরণ করা যেসব মেয়াদি ঋণ এ বছরের ১ এপ্রিল পর্যন্ত অশ্রেণীকৃত রয়েছে, সেগুলোর বিপরীতে এ বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়ের কিস্তির ২৫ শতাংশ, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে প্রদেয় কিস্তির ৩০ শতাংশ এবং অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে প্রদেয় কিস্তির ৪০ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করা হলে এসব ঋণকে খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকরণ করা হবে না। এক্ষেত্রে প্রতি প্রান্তিকের ঋণের কিস্তি প্রান্তিকের শেষ কার্যদিবসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এ বছরের ১ এপ্রিল সময়ে অশ্রেণীকৃত তলবি ঋণের ক্ষেত্রে জুন-ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে তিনটি সমান ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করা হলে এসব ঋণ এ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকরণ করা হবে না।
দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যাকবলিত জেলা-সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের চিহ্নিত বন্যাকবলিত জেলাগুলোর ক্ষেত্রে কৃষি খাতে বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে এ বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে প্রদেয় কিস্তি পরিশোধ করা না হলেও এসব ঋণকে খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকরণ করা যাবে বলে পরিপত্রে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একইভাবে এসব জেলার সিএমএসএমই খাতে বিতরণ করা মেয়াদি ঋণ যদি এ বছরের ১ এপ্রিল পর্যন্ত অশ্রেণীকৃত অবস্থায় থাকে, তাহলে এর বিপরীতে এ বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রদেয় কিস্তির ন্যূনতম ২৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করা হলেই সেটি আর খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকরণ করা হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিপত্রে আরো বলা হয়েছে, সিএমএসএমই খাতে বিতরণকৃত চলমান প্রকৃতির ঋণের ক্ষেত্রে যেসব ঋণের মেয়াদ এরই মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে ও প্রচলিত নীতিমালার আওতায় ব্যাংক কর্তৃক নবায়ন করা হয়নি এবং এ বছরের ১ এপ্রিল পর্যন্ত অশ্রেণীকৃত অবস্থায় রয়েছে, সেসব ঋণের সীমাতিরিক্ত অংশ এ বছরের ডিসেম্বরের শেষ কর্মদিবসের মধ্যে পরিশোধ করার শর্তে নবায়ন করতে হবে।
এসব নির্দেশনা অনুসারে এ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রদেয় কিস্তির অবশিষ্ট অংশ বিদ্যমান ঋণের পূর্বনির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী এক বছরের মধ্যে মাসিক বা ত্রৈমাসিক সমান কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। তবে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে অবশিষ্ট মেয়াদকালের সঙ্গে বর্ধিত এক বছর সময়কে বিবেচনায় নিয়ে কিস্তি পুনর্নির্ধারণ করে নতুন সূচি অনুসারে ঋণের কিস্তি আদায় করা যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এসব নির্দেশনা অনুসারে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী এসব ঋণ শ্রেণীকরণ করা হবে। এ পরিপত্রের মাধ্যমে ঋণের কিস্তি পরিশোধের ক্ষেত্রে সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণের ওপর এ বছরের ১ এপ্রিল থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত সময়ের জন্য কোনো ধরনের দণ্ড সুদ বা অতিরিক্ত ফি আরোপ করা যাবে না। ব্যাংকিং নীতি ও প্রবিধি বিভাগের ২০১৯ সালের ৫ নং পরিপত্রের আওতায় পুনঃতফসিলকৃত ঋণসহ অন্যান্য পুনঃতফসিলের মাধ্যমে অশ্রেণীকৃত হিসেবে প্রদর্শিত ঋণের জন্যও এ পরিপত্রের মাধ্যমে প্রদত্ত সুবিধা প্রযোজ্য হবে। ইসলামী শরিয়াহ-ভিত্তিক ব্যাংকগুলোও তাদের প্রদত্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এসব নীতিমালা অনুসরণ করে একই সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। এ পরিপত্রের আওতায় সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণ বা বিনিয়োগের ওপর আরোপিত সুদ বা মুনাফা আয় খাতে স্থানান্তর করা এবং এ ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের বিষয়ে পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হবে। অবিলম্বে এসব নির্দেশনা কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
