এগিয়ে আসছে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মুহূর্ত। স্থলপথে রাজধানীর সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে যুক্ত হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল। বেশকিছু মানুষ পর্দার আড়ালে থেকে প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছেন। তাদের নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের শেষ পর্বে আজ পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সহকারী প্রকৌশলী (মেকানিক্যাল) কৃষ্ণ কান্ত সরকার
পদ্মা সেতুর মতো বড় অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের মানুষ সম্পৃক্ত। বিশেষ করে প্রকৌশল বিদ্যার একেকটি শাখার একেক রকমের গুরুত্ব রয়েছে। সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন প্রকৌশলী কৃষ্ণ কান্ত সরকার। ওয়েল্ডিং, বিভিন্ন যন্ত্র সংযোজন, ট্রাস ও ফ্রেমের বিভিন্ন খুঁটিনাটি কাজ, পাওয়ার জেনারেশন, ওয়ার্কশপের নানা ধরনের কাজসহ পদ্মা সেতুর মেকানিক্যাল কাজগুলো দেখভাল করেছেন তিনি। প্রকৌশলী হিসেবে এ নির্মাণযজ্ঞে সরাসরিই শামিল হয়েছিলেন তিনি। পদ্মা সেতু চালুর পর পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের বেশির ভাগ কাজ যেহেতু মেকানিক্যাল, তাই সুযোগ পেলে সেসব কাজেও সম্পৃক্ত হতে চান এ প্রকৌশলী।
২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতু প্রকল্পে যোগ দেন প্রকৌশলী কৃষ্ণ কান্ত সরকার, যা মূল সেতুর পাইলিং কাজ শুরুর প্রায় ১৫ মাস আগের কথা। এরপর নির্মাণকাজ শুরুর আগে উন্নয়ন সহযোগীদের সরে যাওয়া, মূল সেতুর পাইলের নকশার জটিলতা, দুর্যোগ, মহামারীসহ একের পর এক প্রতিকূলতা এসেছে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে। এসব প্রতিকূলতায় সেতুর বাস্তবায়ন নিয়ে অনেকের শঙ্কা-সংশয় ছিল। কিন্তু প্রকৌশলী কৃষ্ণ কান্ত সরকার বলেন, তার মনে একদিনের জন্যও এমন শঙ্কা তৈরি হয়নি। সেতুর সফল বাস্তবায়নকে কখনই অসম্ভব মনে হয়নি তার। সব সময় চেষ্টা করেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে নিজের কাজটা করে যেতে।
নদী তলদেশের মাটি থেকে কম-বেশি ৪০০ ফুট গভীরতায় বসানো হয়েছে স্টিলের পাইল। এসব পাইল স্থাপনের আগে সেতুর মাওয়া কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে ওয়েল্ডিং করে জোড়া লাগানো হতো। কৃষ্ণ কান্ত সরকার প্রকল্পে যোগ দেয়ার কিছুদিন পরই শুরু হয় এসব কাজ। সে সময় তিনি একদিকে মাঠ পর্যায়ে থেকে সরাসরি সেসব কাজ শিখতে পেরেছেন, তেমনি একই সঙ্গে নিয়েছেন নানা প্রশিক্ষণও। সেতুতে যে স্প্যানগুলো বসেছে, সেগুলোর ট্রাসের কাজও হতো একই কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে।
কৃষ্ণ কান্ত সরকারের জন্ম ঢাকার ধামরাইয়ে, ১৯৮৪ সালের ১৪ জানুয়ারি। তবে বাবা নিবারণ চন্দ্র সরকার জিপিওর অধীনে বাংলাদেশ পোস্টাল প্রিন্টিং প্রেসে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে তারা থাকতেন টঙ্গীর বোর্ডবাজারে। শৈশবে বেশ দুরন্ত ছিলেন। খেলাধুলার প্রতি ছিল প্রচণ্ড রকমের ঝোঁক। ক্রিকেট, ফুটবলসহ সব ধরনের খেলাতেই থাকত তার সরব উপস্থিতি। তবে এ দুরন্তপনা কখনো পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। ১৯৯৯ সালে টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয় থেকে দুই বিষয়ে লেটারসহ স্টার মার্কস পেয়ে মাধ্যমিক পাস করেন। এর পুরো কৃতিত্ব বাবাকে দিয়ে কৃষ্ণ কান্ত সরকার বলেন, আমার পড়াশোনাটা বাবা নিজে দেখতেন। তাকে ভয়ও পেতাম অনেক। এ কারণে পড়াশোনা বেশি করা লাগত। আমিসহ আমাদের তিন ভাই-বোনকে মানুষ করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তিনি। মা প্রভাতী রানী সরকার আমাদের তিন ভাই-বোনকে আগলে রাখতেন।
মাধ্যমিকের পর তিনি ভর্তি হন ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। মেধা তালিকায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হয়ে পাস করেন ২০০৩ সালে। এরপর ভর্তি হন ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় হয়েছিলেন সপ্তম। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি একাধিক উচ্চতর প্রশিক্ষণও নিয়েছেন তিনি।
তবে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তির পর খেলাধুলায় কিছুটা ছেদ পড়ে কৃষ্ণ কান্ত সরকারের। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেখানে খেলার জন্য কোনো মাঠ ছিল না। তাই খেলাধুলার সুযোগ হয়নি। কিন্তু যখন ডুয়েটে ভর্তি হই, তখনকার জীবনটা আমি অনেক বেশি উপভোগ করেছি। খেলাধুলা ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হই। চতুর্থ বর্ষে আমি ডুয়েটের এফআর খান হল মেকানিক্যাল বিভাগের ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলাম। সে সময় আমার গোলেই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগকে হারাতে সক্ষম হই। চ্যাম্পিয়ন ছিলাম আন্তঃহল ক্যারম প্রতিযোগিতাতেও। অ্যাথলেটিক্সেও বেশ ভালো ছিলেন তিনি। খেলেছেন গাজীপুর জেলা পর্যায়ে।
পড়াশোনা, খেলাধুলা আর টিউশনি—কর্মজীবনে প্রবেশের আগে এ তিনটি কাজই ছিল কৃষ্ণ কান্ত সরকারের নিত্যসঙ্গী। তিনি বলেন, বাবা ছিলেন সীমিত আয়ের মানুষ। আমরা তিন ভাই-বোন। দুই ভাই ও এক বোন। আমি মেজো। তিন ভাই-বোনকেই টিউশনি করেই লেখাপড়ার অনেকটা খরচ জোগাতে হয়েছে। আমরা তিন ভাই-বোনই এখন সরকারি চাকরি করি। বড় বোন রীতা রানী সরকার মুন্সীগঞ্জের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ছোট ভাই প্রদীপ কুমার সোনালী ব্যাংকে কর্মরত।
তবে তার চাকরি জীবন শুরু হয়েছিল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। সেই প্রতিষ্ঠানে বেশ কষ্টের সময় কেটেছে তার। প্রতিদিন কাজ করতে হতো ১২-১৪ ঘণ্টা। শুরুর দিকে আবার টিউশনিও করতেন। কাজের চাপে যদিও আর টিউশনি করে কুলিয়ে উঠতে পারেননি। এসবের মধ্যেই চলত সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা। সে সময়ের ঘটনা উল্লেখ করে কৃষ্ণ কান্ত সরকার বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমার সরকারি চাকরি করার একটা অদম্য ইচ্ছা ছিল। এজন্য ২০১২ সালের দিকে আমি যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম, তা ছেড়ে দিই। তখন বন্ধু-বান্ধব অনেকেই চাকরি ছাড়তে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু একটা বিশ্বাস আমার মধ্যে ছিল, তা হলো বেসরকারি চাকরি আমি পরেও পাব। কিন্তু বয়স ৩০ পেরিয়ে গেলে সরকারি চাকরির সুযোগ আর মিলবে না। আমার সেই বয়স ফুরিয়ে আসছিল। তাই আমি আমার নিজের সাহসে, আমার পরিবারের সাহসে সেই ঝুঁকিটা নিই।
অপেক্ষার পালা শেষ। আগামীকাল উদ্বোধন হতে যাচ্ছে বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু। সেতুর সফল বাস্তবায়নে পর্দার আড়ালে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তাদের একজন কৃষ্ণ কান্ত সরকার। উদ্বোধনের প্রাক্কালে নিজের অনুভূতি জানিয়ে তিনি বলেন, আমি খুব গর্বিত। আমি অপেক্ষায় আছি। উদ্বোধন হলে সবাইকে আরো বুক ফুলিয়ে বলতে পারব—এ সেতুর প্রকৌশলী ছিলাম। এটা আমার জন্য, আমার পরিবারের জন্য একটা গর্বের বিষয়। সারা দেশে যখন সেতু নিয়ে আলোচনা হয়, তখন ভালো লাগে। ভেতর থেকে একটা তৃপ্তি কাজ করে। অন্য কোথাও কাজ করলে আর্থিকভাবে আমি হয়তো আরো ভালো থাকতে পারতাম, কিন্তু এই যে সম্মান, গর্ব—সেটি থেকে বঞ্চিত হতাম।