ট্রাউজারে ভর করে পোশাক খাত উড়ন্ত

বদরুল আলম

চীনের ট্রাউজারের উৎপাদন কার্যক্রম বাংলাদেশে সরে আসছে কয়েক বছর ধরে। মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর স্থানান্তর প্রক্রিয়া আরো জোরালো হয়ে ওঠে। ওই সময় ভিয়েতনাম থেকেও ট্রাউজারের ক্রয়াদেশগুলো বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হয়েছে। মোট পোশাক রফতানিতে ট্রাউজার শর্টসের অংশও এখন বেড়ে চলেছে। দেশের পোশাকপণ্য রফতানির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে রফতানীকৃত পোশাকপণ্যের এক-তৃতীয়াংশই ট্রাউজার শর্টস।

দেশের পোশাক প্রস্তুত রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সংকলিত পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে পোশাক রফতানি হয়েছিল হাজার ৭৯৪ কোটি ৯১ লাখ ৯০ হাজার ডলারের, যার মধ্যে ট্রাউজার রফতানি হয়েছে ৯৩৬ কোটি ২৬ লাখ ৪০ হাজার ডলারের। হিসেবে মোট পোশাক রফতানির ৩৩ শতাংশের বেশিই ছিল ট্রাউজার। বর্তমানে মহামারীর প্রাদুর্ভাবজনিত অভিঘাত কাটিয়ে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে বিশ্ব। এর সঙ্গে বেড়েছে ট্রাউজার শর্টসের মতো পণ্যগুলোর চাহিদাও। চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে দেশে এখন ট্রাউজারের উৎপাদন বাড়াচ্ছেন পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা।

২০২০-২১ অর্থবছরে ট্রাউজার রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়, যার হার ছিল ১৪ শতাংশ। ওই অর্থবছরে পোশাক রফতানির মোট অর্থমূল্য ছিল হাজার ১৪৫ কোটি ৬৭ লাখ ৩০ হাজার ডলারের। আর ট্রাউজার রফতানি হয় হাজার ৬৮ কোটি ১৫ লাখ ২০ হাজার ডলারের। হিসেবে মোট পোশাক রফতানির ৩৪ শতাংশই ছিল ট্রাউজার। ধারা অব্যাহত রয়েছে চলতি বছরেও। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের এপ্রিল থেকে মার্চের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয়েছে হাজার ৯৭২ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পোশাক। যার মধ্যে হাজার ৩৪০ কোটি ডলারের রফতানি হওয়া পণ্যটি ছিল ট্রাউজার। হিসেবে মোট পোশাক রফতানির ৩৩ দশমিক ৭৪ শতাংশই ছিল ট্রাউজার শর্টস।

বাংলাদেশ থেকে পোশাকের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গিয়েছে, ট্রাউজার আগে বড় পরিসরে উৎপাদন হতো মূলত চীন, ভিয়েতনাম কম্বোডিয়ায়। দেশগুলোয় ওভারহেড কস্ট (পরিচালন ব্যয়) বেড়ে গিয়েছে। ফলে বৃহদায়তনের উৎপাদনগুলো বাংলাদেশে সরে এসেছে। আবার ট্রাউজার উৎপাদন কার্যক্রমের একটি জরুরি অনুষঙ্গ হলো ওয়াশিং। চীনে এখন পরিবেশসম্মতভাবে ওয়াশিং প্রক্রিয়া অনুসরণের বাধ্যবাধকতা অনেক বেশি। ইস্যুতে দেশটির অনেক ওয়াশিং কারখানা বন্ধও হয়ে পড়েছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে ওয়াশিং কার্যক্রম চালানো বেশ সহজ। এখানে কারখানাগুলোকে পরিবেশ সম্মততা নিয়ে খুব একটা ঝামেলায় পড়তে হয় না। বিষয়টিও বাংলাদেশে ট্রাউজারের উৎপাদন সরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কাজ করেছে।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ইউরোপভিত্তিক বৃহৎ পোশাক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, চীনে পরিবেশগত বিষয়গুলো মেনে চলা হচ্ছে। এছাড়া বাস্তবতা হলো মৌলিক পোশাকপণ্য সেলাই করে আয় বেশি করা কঠিন। ট্রাউজার উৎপাদনের প্রক্রিয়া তুলনামূলক দীর্ঘায়িত জটিল। প্রতিটি ধাপেই এতে মূল্য সংযোজনের সুযোগ থাকে। এতে করে সরবরাহকারীদের আয়ও বাড়ে। এক্ষেত্রে কাপড় ক্রয়, ওয়াশিং বা অ্যাকসেসরিজ (আনুষঙ্গিক পণ্য) পর্যন্ত সব পর্যায়েই মার্জিন যোগ করা যায়। সব মিলিয়ে একটি কারখানা মৌলিক পণ্য দিয়ে শুরু করে যখন পুরনো হয়, তখন উৎপাদিত পণ্যের বৈচিত্র্য আনতে গিয়ে ট্রাউজারের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে।

মহামারীর প্রাদুর্ভাব-পরবর্তী সময়ের অতিরিক্ত চাহিদাই মোট রফতানিতে ট্রাউজারের অংশকে বাড়িয়ে তুলছে বলে মনে করছেন পোশাক প্রস্তুত রফতানিকারক সংগঠনের প্রতিনিধিরা। বিজিএমইএ ভাইস প্রেসিডেন্ট রকিবুল আলম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, গত দুই বছর মানুষজন ঘরের মধ্যে আবদ্ধ বেশি ছিল। আবহাওয়ার কারণে পর্যটনও কম হয়েছে। এখন মানুষ ঘরে বসে নেই। বাইরে বের হচ্ছে। সব মিলিয়ে ট্রাউজারের চাহিদাও বেড়েছে।

বাংলাদেশের মোট রফতানির ৮৪ শতাংশই পোশাক খাতের পণ্য। গত চার দশকে শিল্পটি ধীরে ধীরে অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। চালিকাশক্তির ভিত মূলত পাঁচ-ছয়টি পণ্য। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) পোশাক শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে মূলত দুই ক্যাটাগরিতে পোশাক রফতানি হয়। একটি হলো নিট, অন্যটি ওভেন। দুই ক্যাটাগরিতে মূলত পাঁচ ধরনের পণ্য রফতানি করেন পোশাক প্রস্তুত রফতানিকারকরা। এগুলো হলো ট্রাউজার, টি-শার্ট নিটেড শার্ট, সোয়েটার, শর্টস ব্লাউজ এবং আন্ডারওয়্যার। তৈরি পোশাক খাতে মোট রফতানির ৮২ শতাংশই দখল করে রেখেছে পাঁচ পণ্য।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের রফতানি খাতে বহুমুখিতার ঘাটতি অনেক দিন ধরেই। পরিস্থিতি থেকে ধীরে হলেও বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন রফতানিকারকরা। তবে পোশাকের বৈশ্বিক বাজার বিবেচনা করলে মৌলিক পণ্যের চাহিদা সবসময়ই আছে থাকবে। অর্থনৈতিক মন্দায়ও ধরনের পণ্যের চাহিদা হ্রাস পায় না। ফলে মৌলিক পণ্যের সক্ষমতা ধরে রেখেই উৎপাদন বৈচিত্র্য বাড়াচ্ছেন রফতানিকারকরা।

বাংলাদেশ এখন শুধু মৌলিক ট্রাউজার পণ্যে আটকে নেই বলে মনে করছেন পোশাক খাতের উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্যমতে, কারখানার মান উন্নয়নে এখন বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে। বিনিয়োগ করতে গিয়ে অনেক উদ্যোক্তাই এখন উচ্চমূল্য সংযোজিত পণ্য তৈরির মতো প্রযুক্তি স্থাপন করছেন। ট্রাউজারে আরো ভালো মূল্য সংযোজন কীভাবে করা যায়, সেদিকেও মনোযোগী হয়েছেন উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ট্রাউজার রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বণিক বার্তাকে বলেন, একক পণ্য হিসেবে ট্রাউজারের রফতানি বেড়েছে। সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে এখন নিট পণ্যের আধিপত্য বেশি। ট্রাউজার রফতানি বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ হলো সাম্প্রতিক সময়ে জিন্স প্যান্ট রফতানির সামর্থ্য বাংলাদেশের অনেক বেড়েছে। ফলে পণ্যটির রফতানি প্রবৃদ্ধি অনেক ভালো হয়েছে। আর আমার মনে হয় প্রবৃদ্ধির একটা বড় কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বাজার। কভিডের প্রভাবে চীন ভিয়েতনামে অনেকদিন উৎপাদন বন্ধ ছিল। সেই সুযোগে বাংলাদেশে অনেক ক্রয়াদেশ সরে এসেছে। ডেনিম কাপড়ের স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রভাবও ট্রাউজার রফতানিতে দেখা যাচ্ছে। আবার নন-ডেনিম কাপড় উৎপাদনের সক্ষমতাও আগের চেয়ে ভালো বাংলাদেশের। সামগ্রিকভাবে কাপড় উৎপাদনের স্থানীয় সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার কারণেও ট্রাউজার রফতানিতে ক্রমেই শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। পণ্যের মানও আগের চেয়ে ভালো। নকশা মূল্য সংযোজন বিবেচনায় মধ্যম উচ্চ পর্যায়ের পণ্য উৎপাদনেও বাংলাদেশের কারখানাগুলো অনেক ভালো করছে। সব মিলিয়ে ট্রাউজারের অবস্থান অনেক ভালো।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, হাই ভ্যালু পণ্যের মান নিয়ে ক্রেতারা অনেক বেশি সচেতন, আবার একই সঙ্গে মূল্য নিয়েও কিছুটা নমনীয়। সাধারণ একটি পোশাক থেকে পণ্যভেদে থেকে ২৫ শতাংশ বেশি মূল্য পাওয়া যায়। কিন্তু ক্রেতারা সব ধরনের প্রস্তুতকারকদের ধরনের পণ্য সরবরাহের রফতানি আদেশ দেন না। কারণ প্রস্তুতকারকরা বিভিন্ন সমস্যার কারণে ধরনের পণ্য তৈরিতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

জানা যায়, একটি মূল্য সংযোজিত পোশাক তৈরিতে প্রক্রিয়া থাকে বেশি। এর বড় একটি উদাহরণ হলো ডেনিম প্যান্ট। বেশি দামি একটি ডেনিম পণ্যের পিসপ্রতি ফ্রেইট অন বোর্ড (এফওবি) মূল্য পাওয়া যায় ১৫-২০ ডলার। দাম বেশি বলেই এটি তৈরির প্রক্রিয়াও দীর্ঘ। যেমন ওয়াশ, এমব্রয়ডারি, প্রিন্ট, ডায়িং, স্পেশাল মেটাল বাটন। তৈরি পোশাকে দেশের বেশির ভাগ কারখানায় সব সুবিধা একসঙ্গে পাওয়া যায় না। এসব ক্ষেত্রে একটি কারখানায় কাটিং সুইং থাকে। এরপর ওয়াশ, এমব্রয়ডারি, প্রিন্ট, ডায়িং, স্পেশাল মেটাল বাটন লাগানোর মতো প্রক্রিয়াগুলোর জন্য ভিন্ন কারখানায় যেতে হয়। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। ফলে ক্রেতার দেয়া বেশি এফওবির সুবিধা কাজে লাগাতে পারেন না প্রস্তুতকারকরা।

বিকেএমইএর সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বণিক বার্তাকে বলেন, শুল্ক কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী যে পণ্যটিকে ট্রাউজার হিসেবে গণ্য করা হয়, তা মূলত করে ওভেন পোশাক পণ্যের রফতানিকারকরা। এখানে ট্রাউজার দিয়ে সাধারণ প্যান্টকেই বোঝানো হচ্ছে। একসময় আমরা টি-শার্ট অনেক বেশি রফতানি করতাম। এখন পণ্যে বৈচিত্র্য আনার ধারাবাহিকতায় টি-শার্টের বাজার অংশীদারত্ব নিয়ে নিয়েছে হুডি, নিট জ্যাকেটসহ আরো বেশকিছু পণ্য। ট্রাউজার উৎপাদন রফতানি বেড়ে যাওয়ার একটা কারণ হলো কভিড-পরবর্তী সময়ে মানুষ ঘরের বাইরে অনেক সময় অতিবাহিত করতে শুরু করেছে। দুই বছর বাসার বাইরে পরার মতো ট্রাউজার বা প্যান্ট কেনেনি। এখন ঘরের বাইরে যাওয়ার চিত্র স্বাভাবিক হওয়ায় প্যান্টের ব্যবহার বেড়েছে। বিষয়টি ইতিবাচক। কারণ ট্রাউজার রফতানি বৃদ্ধিতে বোঝা যাচ্ছে মৌলিক পণ্য থেকে বেরিয়ে অন্যান্য পণ্য উৎপাদনে ঝুঁকতে শুরু করেছেন বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারকরা। এভাবে পর্যায়ক্রমে পণ্যে বৈচিত্র্য বাড়ছে। একক পণ্যে নির্ভরতা প্রতিযোগিতা কমবে। ফলে মূল্যও ভালো পাওয়া সম্ভব হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন