এগিয়ে আসছে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মুহূর্ত। স্থলপথে রাজধানীর সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে যুক্ত হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল। বেশকিছু মানুষ পর্দার আড়ালে থেকে প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছেন। তাদের নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের নবম পর্বে আজ পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ সহকারী প্রকৌশলী (সেতু) আহম্মদ আহসান উল্লাহ মজুমদার
জন্ম নোয়াখালীতে হলেও বাবার চাকরির সুবাদে প্রকৌশলী আহম্মদ আহসান উল্লাহ মজুমদার বেড়ে উঠেছেন খুলনায়। বেশির ভাগ আত্মীয়-স্বজন থাকতেন ঢাকা ও নোয়াখালী। এ কারণে মাঝেমধ্যেই যেতে হতো ঢাকায়। ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে তিনি যখন খুলনা থেকে ঢাকা যেতেন, ছয়টি নদীতে ফেরি পারাপার হতে হতো। সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনায় পড়তেন পদ্মা পার হতে গিয়ে। দুর্ভোগে পড়ে ভাবতেন, পদ্মায় একটা সেতু হলে কতই না ভালো হতো! তার সেই ভাবনা আজ বাস্তব। ভাবনাকে আরো সার্থক করেছে সেই সেতুতে কাজের সুযোগ। পদ্মা সেতু প্রকল্পে তিনি কাজ করছেন সহকারী প্রকৌশলী (সেতু) হিসেবে।
পদ্মা সেতু পারাপার হওয়া নিয়ে দুটি দুঃখজনক ঘটনার সম্মুখীন হয় তাদের পরিবার। প্রথমটি ২০০৮ সালের ঘটনা। ২৭ ফেব্রুয়ারি তার দাদি মারা যান। বাবা তখন খুলনায়। রাস্তায় পদ্মা পারাপারে দেরি হওয়ায় দাদির জানাজায় অংশ নিতে পারেননি তার বাবা। আরেকটি ঘটনা ২০১৭ সালের। ৮ জানুয়ারি ঢাকায় মারা যান বাবা মো. শাহজাহান মজুমদার। তিনি তখন জাজিরায়। আহম্মদ আহসান উল্লাহ মজুমদার বলেন, ‘বাবার মৃত্যু হয় রাত সাড়ে ১০টায়। খবর পেয়ে পদ্মা নদী পার হয়ে যখন ঢাকায় পৌঁছান, তখন মধ্যরাত। শুধু আমার ব্যক্তিগত জীবনে নয়, পদ্মা নদীতে পার হতে গিয়ে এমন দুঃখজনক ঘটনা অহরহ ঘটেছে।’ পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে এমন ঘটনার অবসান হতে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আহম্মদ আহসান উল্লাহ মজুমদার পদ্মা সেতু প্রকল্পে যোগ দেন ২০১৬ সালের ২ আগস্ট। এর কয়েক মাস আগে খালাতো ভাইদের নিয়ে একবার মাওয়ায় গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখেন, ঘাটের খুব কাছেই পদ্মা সেতুর কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড। প্রকল্প এলাকায় নির্মাণকাজের তোড়জোড়। তখনো প্রকল্পের নিয়োগ পরীক্ষার ফল বেরোয়নি। কাছ থেকে নির্মাণকাজ দেখে আরো জোরালো হয় পদ্মা সেতু প্রকল্পে যোগ দেয়ার ইচ্ছা।
প্রকৌশলী হিসেবে কাজে যোগ দেয়ার আগেই শুরু হয়েছিল মূল সেতুর পাইল ড্রাইভিং। তিনি বলেন, ‘প্রথম ধাপে পাইল ড্রাইভিং, পাইল ক্যাপ, পিয়ার তৈরি, পিয়ারের পর স্প্যান বসানো, স্প্যানের ভেতরে রেলওয়ে স্ল্যাব ও ওপরে রোডওয়ে স্ল্যাব—মূল সেতুর প্রকৌশলী হওয়ায় এ কাজগুলো খুব কাছ থেকে আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে।’
নির্মাণকাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পাইল ড্রাইভ কাজের জন্য এক হাজার টন লোড ধারণ ক্ষমতার দুটি ভাসমান ক্রেন ব্যবহার করা হয়। একটির নাম ছিল ‘রুই হাং’, অন্যটির ‘দ্য কিহাও হাই হু’। এ ক্রেন দুটি হাইড্রোলিক হ্যামার ও স্টিল পাইলের লিফটিং ও পজিশনিং কাজে ব্যবহার হতো। জার্মানির তৈরি চারটি হাইড্রোলিক হ্যামার মূল সেতুর পাইল ড্রাইভিংয়ে ব্যবহার করা হয়। মূল সেতুর স্প্যানগুলো বহন করার জন্য যে ভাসমান ক্রেন ব্যবহার করা হয়, তার নাম ছিল ‘তিয়ান হি’। এটার ভার বহন ক্ষমতা ছিল সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৬০০ টন। উচ্চতা ছিল প্রায় ২৭৫ ফুট, যা প্রায় ২৭ তলা উঁচু ভবনের সমান। এ ক্রেন দিয়েই পদ্মা সেতুতে একের পর এক স্প্যান বসানো হয়েছিল। আর স্প্যানের নিচে যে বিয়ারিং বসানো হয়েছিল, তা পৃথিবীর বৃহত্তম। এত বড় বিয়ারিং প্যাড এর আগে বাংলাদেশে ব্যবহার করা হয়নি। ২০০২ সালে সানফ্রান্সিসকোর বেনিসিয়া মার্টিনেজ সেতুতে এ ধরনের বিয়ারিং প্যাড প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল।’ ভারী ও অত্যাধুনিক নানা নির্মাণ যন্ত্র দিয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণ মহাযজ্ঞে শামিল হতে পারায় নিজেকে ধন্য মনে করেন এ প্রকৌশলী।
আহম্মদ আহসান উল্লাহ মজুমদারের বাবা চাকরি করতেন মোংলা বন্দরে। থাকতেন খালিশপুরে অবস্থিত মোংলা আবাসিক এলাকায়। খুলনা জিলা স্কুল থেকে ২০০৪ সালে মাধ্যমিক পাস করে তিনি চেয়েছিলেন ঢাকায় পড়তে। কিন্তু বাবা-মা এতে রাজি ছিলেন না। সেই সময়ের একটি মজার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার ঢাকায় পড়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বাবা-মা রাজি ছিলেন না। সেই অভিমানে এক রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। পরিকল্পনা ছিল, প্রথমে কুয়েটে (খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) থাকা ফুফাতো ভাইয়ের কাছে যাব। এরপর চলে যাব ঢাকায়। খালিশপুরে আমাদের কোয়ার্টার থেকে কুয়েটের দূরত্ব ১০ কিলোমিটারের মতো। বাড়ি বের হয়ে হাঁটা ধরলাম। সন্ধ্যার পর। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটি কুকুর এসে পায়ে কামড়ে দেয়। ওই অবস্থায় ফুফাতো ভাইয়ের মেসে চলে যাই। এদিকে বাসা থেকে আমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। পরদিন ফুফাতো ভাই বাসায় জানান, আমি তার কাছে আছি। এরপর বাড়ি ফিরে যাই। বাবা-মা বুঝিয়ে-শুনিয়ে খুলনাতেই পড়তে রাজি করান।’
তার ঢাকায় পড়ার সেই আক্ষেপ ঘুচেছে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তির পর। তবে এখানকার জীবন আর পাঁচটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ছিল না। কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে থাকতে হতো তাদের। তিনি বলেন, মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে পড়াশোনার সুবাদে ‘ডিসিপ্লিনড’ একটা লাইফ ছিল। এ নিয়ম-শৃঙ্খলা পরবর্তী সময়ে আমার ব্যক্তিগত জীবনে, কর্মজীবনে অনেক ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এখনো এর সুফল আমি পেয়ে যাচ্ছি।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে যোগ দেয়ার আগে বিভিন্ন সময় চারটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আহম্মদ আহসান উল্লাহ মজুমদার। ২০১১ সালে প্রথম চাকরিটি ছিল টোটাল স্টিল বিল্ডিং প্রডাক্টস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত চাকরি করেছেন ম্যাজিক ওয়ার্ক লিমিটেড নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানে। ২০১৫ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজ করেছেন ভেরিতাস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনসালট্যান্ট লিমিটেডে। ২০১৬ সালের প্রথম দিকে ইএমএক্স লিমিটেডে কিছুদিন কাজ করেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে দুই কন্যা সন্তানের জনক আহম্মদ আহসান উল্লাহ মজুমদার। বড় মেয়ে তাজকিয়া তাজমীন ইনায়া, ছোট মেয়ে তাসমিয়া তাকাসুর ইলমা। স্ত্রী তাসনীম খায়ের গৃহিণী।