বন্যায় সিলেটের প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি

কুশিয়ারার পানি বাড়ছে নতুন এলাকা প্লাবিত

বণিক বার্তা ডেস্ক

পানি কমায় ঘরে ফেরা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু ঘরভর্তি বন্যার রেখে যাওয়া ভগ্নস্তূপ। পরিবারের অনিশ্চয়তার ছাপ শিশুটির মুখেও দৃশ্যমান ছবি: এপি

আসন্ন ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন সিলেটের গবাদিপশুর খামারিরা। কিন্তু চলমান বন্যা খামারিদের সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে গিয়েছে গবাদিপশু হাঁস-মুরগির ৭১০টি খামার। এসব খামারে হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল মিলিয়ে তিন হাজারের বেশি প্রাণীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। প্রাথমিকভাবে খাতে কোটি ৫৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বন্যার পানি নেমে গেলে বিষয়ে আরো বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত পানির তোড়ে ভেসে জেলায় হাজার ১৮৯টি গবাদিপশু হাঁস-মুরগি মারা গেছে। সিলেট জেলার ৭১০টি খামার ডুবে গেছে। পানিতে ভেসে গেছে হাজার ৯৯১ টন খড় হাজার ৯৫৯ টন ঘাস। সব মিলিয়ে পর্যন্ত জেলায় প্রাণিসম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ১১ কোটি ৬৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।

জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী সিলেটে ২২টি গরু মারা গেছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১১টি, জৈন্তাপুরে চারটি গোয়াইনঘাটে সাতটি। মহিষ মারা গেছে সাতটি। এর সবগুলোই গোয়াইনঘাটে। ছাগল মারা গেছে ২১টি। এর মধ্যে দুটি জৈন্তাপুরে ১৯টি গোয়াইনঘাটে। বন্যায় পর্যন্ত ভেড়া মারা গেছে ১৩টি। এর মধ্যে কানাইঘাটে তিনটি, গোয়াইনঘাটে আটটি জৈন্তাপুরে দুটি। বন্যায় সবচেয়ে বেশি মারা গেছে মুরগি। পর্যন্ত এর সংখ্যা হাজার ৭১৫। হাঁস মারা গেছে মোট ৩৯১টি।

গোচারণভূমি তলিয়ে যাওয়ায় গরু-ছাগল-মহিষের তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিগগিরই সংকট কাটবে না। কারণ গরুর খাদ্য খড় ভিজে গিয়েছে, ভেসে গিয়েছে। ফলে খাদ্য সংকট দীর্ঘায়িত হবে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো রুস্তুম আলী বলেন, আমরা আপাতত বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া গবাদিপশুগুলোকে চিকিৎসা দিচ্ছি। পানি নেমে গেলে যাতে সংক্রামক রোগ দেখা না দেয়, এজন্য টিকা কার্যক্রম শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্লাবিত এলাকায় গোখাদ্য সরবরাহেরও চেষ্টা করা হচ্ছে।

বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে বন্যা নিয়ে জরুরি সভায় গোখাদ্যের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে বলে জানান প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক . মো. জাকির হোসেন। বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে চাহিদা পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।

সিলেটের অনেক স্থানে বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও গতকাল পর্যন্ত কুশিয়ারা নদীর পানি বিপত্সীমার ফুট ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এটি গত ১০ বছরের মধ্যে পানিপ্রবাহের সর্বোচ্চ রেকর্ড বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ। গতকাল বিকালে অমলসীদ পয়েন্টে কুশিয়ারা নদী বিপত্সীমার ১৯১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন স্থানে পানি বাঁধের ওপর দিয়ে প্রবল বেগে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে উজানে বৃষ্টিপাত কমে গেছে। ফলে আজ থেকে পানিপ্রবাহ কিছুটা কমতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

কুশিয়ারার পানি বেড়ে যাওয়ায় সিলেটের জকিগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ দক্ষিণ সুরমায় পানি বাড়ছে। নতুন করে অনেক ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান জানান, পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। তবে এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে অনেক মানুষ। তাদের নিরাপত্তাসহ সার্বিক কার্যক্রমে কাজ করছে সেনাবাহিনী। দুর্গত মানুষের মাঝে প্রয়োজন অনুযায়ী ত্রাণ পৌঁছে দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।

পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল জানিয়েছে, সিলেটের কিছু অঞ্চল রংপুরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও মধ্যাঞ্চলের ছয় জেলায় বন্যার অবনতি হতে পারে। গতকাল সকাল পর্যন্ত দেশের ১১টি নদ-নদীর পানি ২১টি স্থানে বিপত্সীমার ওপর দিয়ে বইছিল। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি স্থিতিশীল থাকলেও যমুনা গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বাড়ছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কুশিয়ারা তিতাস ছাড়া সব প্রধান নদ-নদীর পানি কমছে। আবহাওয়া সংস্থাগুলোর গাণিতিক মডেলভিত্তিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের অভ্যন্তরে এবং উজানের বিভিন্ন অংশে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা কম। সে হিসেবে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীগুলোর (তিতাস ছাড়া) পানি কমতে পারে।

দেশের বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় ডায়রিয়া, সাপের কামড়, পানিতে ডুবে আঘাতজনিতসহ নানা কারণে এখন পর্যন্ত ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে সিলেট বিভাগে ২১ জন ময়মনসিংহ বিভাগে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলামের সই করা এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এর আগে গতকাল ৩৬ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছিল সংস্থাটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে বন্যাকবলিত চার বিভাগে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে হাজার ৪০৩ জন আক্রান্ত হয়েছে। ১৭ জুন থেকে গতকাল পর্যন্ত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে হাজার ৫১৬ জন, রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনে (আরটিআই) ১০৩, চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছে ১৬৩, চোখের প্রদাহে ৬১, আঘাতপ্রাপ্ত ৩৯ অন্যান্য সমস্যায় পতিত হয়েছে ৪৮১ জন। সময়ে বজ্রপাতে আক্রান্ত ১৩ জনের মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে, সাপের কামড়ে চারজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে এবং পানিতে ডুবে মারা গিয়েছে ২৩ জন।

সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ৩৩৭ জন, আরটিআইতে ১৬, চর্মরোগে ২৩, চোখের প্রদাহে ১৫ আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে ১৪ জন। এছাড়া অন্যান্য কারণে আক্রান্ত হয়েছে ৬০ জন। সময়ে পানিতে ডুবে মারা গেছে চারজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন