আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট করের ক্ষেত্রে শর্ত সাপেক্ষে ছাড় দেয়া হয়েছে। করছাড়ের ক্ষেত্রে শর্তারোপকে বাস্তবসম্মত নয় উল্লেখ করে এর প্রত্যাহার চাইছে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ (বিএপিএলসি)। এছাড়া শ্রমিক তহবিল, আমানতের সুদের ওপর কর, রফতানি পণ্যে উৎসেকর ও লভ্যাংশের ওপর দ্বৈত কর ইস্যুতে বিএপিএলসির পক্ষ থেকে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
বিএপিএলসির প্রেসিডেন্ট এম আনিস উদ দৌলা স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, অর্থ বিল ২০২২-এ সব ধরনের প্রাপ্তি ও আয় অবশ্যই ব্যাংক স্থানান্তরের মাধ্যমে গৃহীত হতে হবে এবং ১২ লাখ টাকার অতিরিক্ত ব্যয় ও বিনিয়োগ অবশ্যই ব্যাংক স্থানান্তরের মাধ্যমে সম্পাদন করার শর্তে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট করে আড়াই শতাংশ ছাড় দেয়া হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের প্রকৃতি, লেনদেনের ধরন, নগদ অর্থনীতির আকার, ব্যাংকের প্রাপ্যতা, ডিজিটাল অর্থের ব্যবহার এবং সার্বিক আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ ধরনের শর্তারোপকে বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করছে বিএপিএলসি। যেসব কোম্পানি সরাসরি খুচরা পর্যায়ের গ্রাহকদের কাছে পণ্য বিক্রি করে কিংবা যাদের রিটেইল চেইন ব্যবসা রয়েছে কিংবা কৃষিসম্পর্কিত ব্যবসায় যাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে তাদের পক্ষে ব্যাংকের মাধ্যমে সব ধরনের লেনদেন সম্পন্ন করার শর্ত পরিপালন করা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে, পরিবহন, ক্ষুদ্র কেনাকাটা, অস্থায়ী শ্রমিকের বেতন, যাতায়াত ভাড়া, কৃষিভিত্তিক কাঁচামাল সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহের ক্ষেত্রেও ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করা সম্ভব নয়। এসব বিষয় বিবেচনায় করপোরেট করছাড় পাওয়ার ক্ষেত্রে আরোপিত শর্ত প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছে বিএপিএলসি।
শ্রমিকদের বৃহত্তর স্বার্থে নিয়ন্ত্রক সংস্থার শর্তানুসারে শ্রম আইনের ধারা পরিপালনে শ্রমিকদের মুনাফা বণ্টন তহবিল (ডব্লিউপিপিএফ) গঠন করা হয়েছে। আইনি বাধ্যবাধকতা অনুসারে কোম্পানির কর-পূর্ব মুনাফার ৫ শতাংশ ডব্লিউপিপিএফে অনুদান দেয়া হয়ে থাকে। এতদিন ডব্লিউপিপিএফে দেয়া অনুদানকে কোম্পানি করযোগ্য আয় হিসাবের ক্ষেত্রে স্বীকৃত ব্যয় হিসেবে গণ্য করা হতো। কিন্তু ২০২২ সালের অর্থবিলে এ তহবিলে জমা দেয়া অর্থকে করযোগ্য আয় হিসাবের ক্ষেত্রে স্বীকৃত ব্যয় হিসেবে গণ্য করা হয়নি। ফলে ডব্লিউপিপিএফে অর্থ জমা দেয়ার কারণে কোম্পানিকে বাড়তি কর গুনতে হবে। যদিও নিয়ন্ত্রক সংস্থার বাধ্যবাধকতার কারণেই কোম্পানি এ অর্থ জমা দিচ্ছে। পাশাপাশি শ্রম আইনে ডব্লিউপিপিএফে দেয়া অর্থকে করযোগ্য আয় হিসাবের ক্ষেত্রে স্বীকৃত ব্যয় হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হয়েছে। যদি এ ধারা বহাল থাকে তাহলে একবার কোম্পানির পক্ষে আরেকবার শ্রমিকদের পক্ষে একই আয়ের ওপর দুবার কর প্রযোজ্য হবে। এ কারণে অর্থবিল থেকে এ ধারা প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছে বিএপিএলসি।
বর্তমানে সঞ্চয়ী আমানত ও স্থায়ী আমানতের সুদের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর ধার্য করা আছে। ২০২২ সালের অর্থবিলে এ করের পরিমাণ বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা তাদের উদ্বৃত্ত তহবিল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রাখতে নিরুৎসাহিত হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যাপ্ত আমানত আকর্ষণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এবং তাদের ঋণ প্রদানের সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। এতে বেসরকারি খাতের ঋণ ও বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হবে বলে মনে করছে বিএপিএলসি।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে রফতানি পণ্যের ওপর উৎসেকরের পরিমাণ বিদ্যমান দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে। তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রফতানিমুখী খাত মাত্রই কভিডের অভিঘাত অতিক্রম করছে। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবিত করহার রফতানিকারকদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে। এ কারণে বিএপিএলসি উৎসেকরের পরিমাণ দশমিক ৫ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখার অনুরোধ জানিয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক, ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) ও মার্চেন্ট ব্যাংকের করপোরেট করের হার আগের মতোই সাড়ে ৩৭ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। বর্তমানে অনেক ব্যাংক ও এনবিএফআই মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে এবং বিধিবদ্ধ সঞ্চিতি সংরক্ষণে সমস্যার মধ্যে রয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনার পাশাপাশি বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাংক, এনবিএফআই ও মার্চেন্ট ব্যাংকের করপোরেট করের হার কমিয়ে ৩৫ শতাংশ নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে বিএপিএলসি।
সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হলেও এখনো লভ্যাংশ আয়ের ওপর দ্বৈত কর বহাল রয়েছে উল্লেখ করে বিএপিএলসি বলছে, সাবসিডিয়ারি কোম্পানির পরিশোধ করা লভ্যাংশ মূল কোম্পানির হাতে এলে সেটি কর অব্যাহতি দেয়া উচিত। লভ্যাংশ আয়ের ওপর বহুবিধ কর প্রত্যাহার করা হলে কার্যকর ব্যবসায় কাঠামো অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর হওয়ার পাশাপাশি বৈশ্বিক উত্তম চর্চার সঙ্গে দেশের কর পদ্ধতির পরিপূর্ণতাকে আরো উন্নত করবে, যা পুঁজিবাজারের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করবে বলে মনে করছে বিএপিএলসি।
