আড়াই হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ

প্রতিযোগীরা এগিয়ে গেলেও ডুবতে বসেছে আরএসআরএম

সুজিত সাহা, চট্টগ্রাম ব্যুরো

এক সময়ে রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডকে (আরএসআরএম) বিবেচনা করা হতো দেশের প্রথম সারির ইস্পাত ব্র্যান্ড হিসেবে। এখন একাধিক ব্যাংকের প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ডুবতে বসেছে কোম্পানিটি। বাজারের প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলেও ধুঁকছে আরএসআরএম।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়িক ভুল পরিকল্পনা, অসৎ উদ্দেশ্যে ঋণগ্রহণ ঋণ ব্যবহারের কারণে আরএসআরএম ইস্পাত খাতের ব্যবসা যেমন হারিয়েছে, তেমনি অর্থ তছরুপ ঋণের টাকা অপ্রদর্শিত খাতে বিনিয়োগের কারণে অন্তত ১০টি ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেও বিপদগ্রস্ত করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে, আরএসআরএমের কাছে শুধু জনতা ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ সব মিলিয়ে হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের পাওনা হাজার ২০৪ কোটি টাকা সোনালী ব্যাংকের পাওনা ৬৭৬ কোটি টাকা, যা আরএসআরএম গ্রুপের মোট খেলাপি ঋণের ৭৫ শতাংশের বেশি।

রতনপুর গ্রুপের কাছে সবচেয়ে বেশি পাওনা জনতা ব্যাংক লালদীঘি শাখার। গ্রুপটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেসার্স মডার্ন স্টিল মিলস লিমিটেডের কাছে ৪০৯ কোটি টাকা, মেসার্স রতনপুর শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজের ৩১৩ কোটি টাকা এসএম স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের কাছে ৪৮২ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। বিপুল ঋণের বিপরীতে জনতা ব্যাংকের কাছে মাত্র ৩১ দশমিক ১৬ একর জমি বন্ধক রয়েছে, যা পাওনার তুলনায় খুবই সামান্য বলে মনে করছেন খোদ ব্যাংক কর্তৃপক্ষও।

অন্যদিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাওনা রয়েছে সোনালী ব্যাংকের। মেসার্স মডার্ন স্টিল মিলস লিমিটেডের কাছে ব্যাংকটির পাওনা ৪৬১ দশমিক ৭০ কোটি টাকা এবং রতনপুর স্টিল লিমিটেডের কাছে পাওনা ২১৪ কোটি টাকা। এরইমধ্যে সোনালী ব্যাংক আরএসআরএম গ্রুপের বিরুদ্ধে সর্বমোট ১৫টি সিআর মামলা দায়ের করেছে। মডার্ন স্টিলসের বিরুদ্ধে ২০১৭ ২০১৮ সালে সর্বমোট ১১টি এবং রতনপুর স্টিলসের বিরুদ্ধে ২০২০ সালে চারটি সিআর মামলা দায়ের করে সোনালী ব্যাংক।

সোনালী ব্যাংকের চট্টগ্রাম অঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. আলী আশরাফ বণিক বার্তাকে বলেন, আরএসআরএম গ্রুপ একসময় সুনামের সঙ্গে ইস্পাত খাতে ব্যবসা করেছে। ব্যবসায়িক সুনামের কারণে গ্রুপটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগও করা হয়। তবে গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে অনিয়মিত পেমেন্ট উৎপাদন বন্ধ করার পর বকেয়া আদায় কঠিন হয়ে পড়েছে। বকেয়া পরিশোধে  বার বার নিশ্চয়তা দিয়েও খেলাপিই থাকছে প্রতিষ্ঠানটি। কারণে বকেয়া উদ্ধারে আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

ব্যাংকাররা বলছেন, আরএসআরএম গ্রুপের ঋণ আদায়ে সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে জামানতের বিপরীতে কয়েকগুণ বেশি ঋণ প্রদান। নাসিরাবাদ এলাকায় গ্রুপটির ১০০ শতকের একটি কারখানায় থেকে ১০টি ব্যাংকের হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ প্রদান করা হয়েছে। যার কারণে আদালতের নির্দেশে এসব সম্পত্তি নিলামে উঠলেও দরদাতা পাওয়া যাচ্ছে না। এতে আইনি প্রক্রিয়ায় ঋণের টাকা ফেরত পাওনা নিয়েও শঙ্কায় রয়েছে ব্যাংকগুলো।

ব্যাংকার সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যে জানা গিয়েছে, জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিনের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগে। তার হাত ধরেই জনতা ব্যাংক থেকে সহজে বড় অংকের ঋণ সুবিধা নেয় রতনপুর গ্রুপ। একইভাবে সোনালী ব্যাংক লালদীঘি শাখার দায়িত্বে ছিলেন নোয়াখালীর দিলীপ দত্ত। যাকে কাজে লাগিয়ে বড় অংকের ঋণ হাতিয়ে নিয়েছেন একই এলাকার মাকসুদুর রহমান। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকের কাছে বার বার ঋণের বকেয়া পরিশোধে প্রতিশ্রুতি দিয়ে মামলা কার্যক্রমকে স্থবির করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধাররা। সম্প্রতি সোনালী ব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আরএসআরএমের কার্যালয় পরিচালকদের বাসায় সরাসরি দেখা করতে গেলে তাদের গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই দেয়নি আলোচিত ঋণখেলাপিরা। এরই মধ্যে চলতি বছরের শুরুতে সোনালী ব্যাংক আদালতের নির্দেশে আরএসআরএমের কারখানা দুটি নিলামের উদ্যোগ নিলেও একই মর্টগেজে একাধিক ঋণ থাকায় কোনো বিডার পাওয়া যায়নি।

চট্টগ্রামের ইস্পাত খাতের অন্যতম শিল্পপ্রতিষ্ঠান আরএসআরএম রড, অ্যাঙ্গেলসহ বিভিন্ন ইস্পাত পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত গ্রুপটির উৎপাদন চালু হওয়ার সময় বার্ষিক টার্নওভার ছিল প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কাজ করত প্রায় ৮০০ কর্মী। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে কারখানা দুটির উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রায় ৪০ কোটি টাকা বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের কারণে সংযোগ বন্ধ থাকায় উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে দুই দফায় কিস্তিতে বকেয়া বিল পরিশোধের সুযোগ দেয়া হলেও ব্যর্থ হয় প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ আদালতের সুপারিশে চার কিস্তিতে বিদ্যুৎ বিলের ১০ কোটি টাকা পরিশোধ করে কারখানাটি গত ডিসেম্বরে সীমিত পরিসরে উৎপাদনে গেলেও এক মাসের মধ্যেই ফের বন্ধ হয়ে যায়।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৮৪ সাল থেকে চট্টগ্রামে শিপ ব্রেকিং ইস্পাত খাতে ব্যবসা শুরু করে নোয়াখালীর সেনবাগ এলাকার মাকসুদুর রহমান। শুরু থেকে ধীরগতিতে ব্যবসা করলেও ২০০৪-০৫ সালের দিকে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে বড় অংকের ব্যাংকঋণ নেন তিনি। দীর্ঘদিনের ব্যবসার অভিজ্ঞতা ব্যাংকের বড় কর্তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে সহজে বড় অংকের ঋণ সুবিধা নেয় আরএসআরএম। ঋণ নেয়ার প্রথম কয়েক বছর ব্যাংকের পাওনা যথাসময়ে পরিশোধ করলেও ২০১১-১২ সালের পর ঋণ পরিশোধে গড়িমসি শুরু করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধাররা। এর মধ্যে ঋণ গ্রহণের এক দশক পার হলেও ঋণের টাকা ফেরত পায়নি অনেক ব্যাংক।

জনতা সোনালী ছাড়াও রতনপুর শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে নেয়া টাকা ফেরত পায়নি গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কাছে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পাওনা ৫৬ কোটি টাকা। ২০০৭ সালে ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নেয় রতনপুর গ্রুপের প্রতিষ্ঠান মেসার্স মডার্ন স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড। এরপর ঋণটি খারাপ হলে সরকারের লার্জ লোন রিস্ট্রাকচার সুবিধার সময় ঋণটি রিস্ট্রাকচার করা হয়। ২০১৪ সালে সময় বাড়ানো হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ট্রাস্ট ব্যাংক সিডিএ শাখার পাওনা ৬০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির কাছে পাওনা রয়েছে লংকাবাংলা ফাইন্যান্সেরও।

প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে ২০১৩ সালে ঋণ সুবিধা নেয় রতনপুর গ্রুপের এসএম স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড। বর্তমানে এসএম স্টিলের কাছে প্রাইম ফাইন্যান্স চট্টগ্রাম শাখার পাওনা ২৪ কোটি টাকা। যার পুরোটাই শ্রেণীকৃত হয়ে রয়েছে। রতনপুর গ্রুপের রতনপুর শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কাছে ১৫০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের। দীর্ঘদিন ব্যাংকটির জুবিলী রোড শাখা থেকে পুরনো জাহাজ আমদানির জন্য ঋণ সুবিধা নিলেও গত কয়েক বছর ধরে ঋণ পরিশোধ অনিয়মিত হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এছাড়াও রতনপুর গ্রুপের কাছে রূপালী ব্যাংক, প্রিমিয়ার লিজিং বিডি ফাইন্যান্সের বড় অংকের পাওনা রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। এর মধ্যে বিডি ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে একটি এনআই অ্যাক্ট মামলা দায়ের করেছে।

বিষয়ে মন্তব্য জানতে আরএসআরএম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাকসুদুর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংযোগ বিচ্ছিন্ন পাওয়া যায়। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ একজন নির্বাহী কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা ইস্পাত খাতে ব্যবসা বেশ গুছিয়ে এনেছিলাম। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি সেটা এলোমেলো করে দেয়। করোনা-পরবর্তী যখন আবারো বড় পরিসরে কাজ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করতে গেলাম, ঠিক তখনই বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় সাবস্টেশন নষ্ট হয়ে উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এর আর্থিক ক্ষতি বহন করতে হচ্ছে আরএসআরএমকে। বৈদ্যুতিক সরবরাহ ব্যবস্থার সংকট এখন সমাধান হলেও ট্রায়ালে সমস্যা পাওয়ায় আবারো ট্রায়ালে যেতে হচ্ছে। আশা করছি ঠিকভাবে উৎপাদনে ফেরার পর ধাপে ধাপে অনেক কিছুরই সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে।

গত বুধবার দিবাগত রাতে রাজধানীর গুলশান থেকে আরএসআরএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাকসুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) বৃহস্পতিবার চেক প্রতারণার সাতটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে মাকসুদুর রহমানকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হলে শুনানি শেষে আদালত তাকে জামিন দেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন