ব্যাংক খাতের বড় চ্যালেঞ্জ ছয়-নয় ধরে রাখা

হাছান আদনান

যুদ্ধ মহামারীর অভিঘাতে চরম অনিশ্চয়তায় বৈশ্বিক অর্থনীতি। অনিশ্চয়তার বাইরে নেই বাংলাদেশও। এর মধ্যেই আবার চলতি অর্থবছরের বিদায় মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে। চলছে পরবর্তী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি। নানা চ্যালেঞ্জকে সঙ্গে নিয়ে নতুন অর্থবছর শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছর এর বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জগুলোকে নিয়ে ধারাবাহিক পর্ব- 

মূল্যস্ফীতির কঠিন চাপে দেশের অর্থনীতি। সরকারি হিসাবেই চলতি বছরের এপ্রিলে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল দশমিক ২৯ শতাংশ। দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বাড়ায় মূল্যস্ফীতির চাপ দিন দিন আরো ভারী হচ্ছে। এর মধ্যেই তীব্র সংকট চলছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে। ডলারের বিপরীতে প্রতিনিয়ত অবমূল্যায়ন হচ্ছে টাকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবেই গত এক বছরে টাকার বিনিময় হার কমেছে দশমিক শতাংশ।

মূল্যস্ফীতির হার বাড়ায় ব্যাংকগুলো মেয়াদি আমানতের সুদহার বাড়াতে শুরু করেছে। আবার দেশের বেসরকারি অনেক ব্যাংকেই আমানতের প্রবৃদ্ধি থেমে গেছে। নতুন দুর্বল ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহে - শতাংশ সুদও প্রস্তাব করছে গ্রাহকদের। তহবিল ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সর্বোচ্চ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে গিয়ে বিপদে পড়েছে অনেক ব্যাংক। কিছু ব্যাংক গ্রাহকদের ঋণ না দিয়ে উচ্চসুদের সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির হার যে পর্যায়ে উঠেছে তাতে সর্বোচ্চ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে ঋণ আমানতের সুদহার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বেঁধে দেয়া সুদহার মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না। এরই মধ্যে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে শতাংশের বেশি হারে সুদ আদায় করতে শুরু করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারণ করে দেয়া সুদহার মেনে ব্যাংক পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানালেন বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তা পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমি কখনই সুদহার বেঁধে দেয়ার পক্ষে ছিলাম না। শতাংশ সুদে কেউ এখন আর ঋণ দিচ্ছে না। আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির ওপরে হতে হয়। এখন মূল্যস্ফীতির যে পরিস্থিতি তাতে শতাংশ সুদে আমানত পাওয়া কঠিন।

নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই এখন আর সুদহার বেঁধে দেয়া হয় না। আমরা যখন সুদহার বেঁধে দিয়েছিলাম, তখন ব্যাংকগুলো নিজেদের খেয়ালখুশিমতো সুদ আদায় করছিল। কোনো কোনো গ্রাহকের কাছ থেকে ১৪-১৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আদায় করা হচ্ছিল। এজন্য সুদহার বেঁধে দেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে সুদহার বেঁধে দেয়ার সুযোগ নেই।

সরকারের নির্দেশনায় ২০২০ সালে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই বছরের এপ্রিল থেকে ঋণের সর্বোচ্চ সুদ শতাংশ কার্যকর হয়। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণসৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগের সময় দেশের ব্যাংকগুলোয় জমা হয় অলস তারল্যের স্তূপ। বিশেষ ওই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংক মেয়াদি আমানতের সুদহার - শতাংশে নামিয়ে আনে। অবস্থায় আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে হস্তক্ষেপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২১ সালের আগস্ট আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার বেঁধে দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, তিন মাস এর বেশি মেয়াদি আমানতের সুদ কোনোভাবেই তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির কম হতে পারবে না।

এরপর চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত ঋণের সুদহারও বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ সুদ বেঁধে দেয়া হয়। আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার ধরা হয় শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে লাখ ৮৬ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলোর হাতে বিনিয়োগ করার মতো তারল্য আছে মাত্র ১৫-২০ হাজার কোটি টাকা। আমদানি দায় পরিশোধের জন্য ডলার কিনতে গিয়ে তারল্য শেষ হয়ে আসছে অনেক ব্যাংকের। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করেছে। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকার তারল্য চলে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। অন্যদিকে বাজারে তারল্য সরবরাহ কমাতে রেপোর সুদহারও দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, বিশ্বের সব দেশেই মূল্যস্ফীতি হলে অর্থের প্রবাহ কমিয়ে আনা হয়। বাংলাদেশও মুহূর্তে মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঋণের সুদহার বাড়ানোই অধিক যুক্তিসংগত।

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সংগতি রেখে নির্ধারণ করে দিয়েছে। এখন মূল্যস্ফীতি বাড়ায় আমানতের সুদহারও বাড়বে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেপোর সুদহারও বাড়িয়েছে। অনেক ব্যাংক - শতাংশ সুদেও আমানত সংগ্রহ করছে। এখন ওই ব্যাংক কীভাবে শতাংশ সুদে ঋণ দেবে। সরকারও ট্রেজারি-বিল বন্ডের সুদহার বাড়াচ্ছে। পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলো ঝুঁকি নিয়ে গ্রাহকদের ঋণ দিতে চাইবে না। সবাই চাইবে বিল-বন্ড কেনার মাধ্যমে সরকারকে ঋণ দিয়ে নিরাপদে থাকতে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে এসেছে। ২০২১ সালের মার্চে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল দশমিক ৯৮ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চে প্রবৃদ্ধি দশমিক ৮৭ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছিল লাখ ১৭ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৬৪ শতাংশ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ মেয়াদে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে মাত্র ৬৫ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৪ শতাংশ কম। যদিও চলতি বছরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। একই সঙ্গে বাড়ছে ব্যাংক থেকে নেয়া সরকারের ঋণের পরিমাণও। আমানত ঋণ প্রবৃদ্ধির বিপরীত চিত্র আগামীতে দেশের ব্যাংক খাতে বড় ধরনের তারল্য সংকট তৈরি করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ব্যাংকারসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো চাইলে ঋণ আমানতের সুদহার পর্যালোচনার সুযোগ আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, একটি বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ আমানতের সুদহার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার শতাংশ নির্দিষ্ট করা হলেও আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এখন মূল্যস্ফীতির হার যদি বেড়ে যায়, তাহলে আমানতের সুদহারও স্বাভাবিকভাবে বাড়বে। আর আমানতের সুদহার বেড়ে গেলে ঋণের সুদহার শতাংশে ধরে রাখা কঠিন। স্প্রেড যদি অনেক কমে যায় তাহলে ব্যাংকের পক্ষে মুনাফায় থাকা সম্ভব হবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকার সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো যদি ঋণ আমানতের সুদহার পর্যালোচনা করার জন্য আবেদন করে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি পর্যালোচনা করে দেখবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন