মূল্যস্ফীতি ও ভর্তুকির চাপ

৬,৭৮,০৬৪ কোটি টাকার বাজেট চূড়ান্ত

মেসবাহুল হক

করোনা মহামারীর প্রভাব কাটিয়ে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার পর্যায়ে শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যার ধাক্কায় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি খাদ্যপণ্যের মূল্য এখন ঊর্ধ্বমুখী। পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নে দেশে প্রধান প্রধান ভোগ্যপণ্যের দাম আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অবস্থায় ভর্তুকি বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায় সরকার। তবে অর্থনীতির সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকার তার ব্যয় কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। বাস্তবতায় আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হচ্ছে, যা মোট জিডিপির প্রায় ১৫ দশমিক শতাংশ।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছর বাজেটের আকার নির্ধারিত রয়েছে লাখ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। বাজেটের আকার জিডিপির ১৭ দশমিক শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে জিডিপির অংশ হিসেবে বাজেটের আকার শতাংশেরও বেশি কমিয়ে আনছে সরকার। আগামী বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে নতুন বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। বাজেটের আকার কমলেও আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকায়। বাজেটের ঘাটতি জিডিপির দশমিক শতাংশ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগামী বজেটে সরকারের মোট ব্যয় যে জিডিপির তুলনায় কম ধরা হচ্ছে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তা ঠিক আছে। তবে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়বে, তাই ঘাটতি মেটাতে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরামর্শ দেন তারা।

আগামী বাজেট বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা . এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারের যে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে সেটা ঠিক আছে। তবে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্নে, এখান থেকে উত্তরণের কোনো দিকনির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে না। আগামী বাজটে ভর্তুকির মাত্রা বাড়বে, তাই যে পরিমাণ ঘাটতি রাখা হচ্ছে সেটা হয়তো পরবর্তী সময়ে বেড়ে যাবে। তবে আগামী অর্থবছরে ঘাটতি কিংবা সাড়ে শতাংশ হলেও সমস্যা নেই। তবে ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক সাহায্য ঋণের মাধ্যমে পূরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অভ্যন্তরীণ বিশেষ করে অত্যন্ত ব্যয়বহুল সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ কমানোরও পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদ।

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অর্থবছরের শুরুতে রাজস্ব আয় কম থাকলেও এখন বাড়ছে। অর্থনীতির সূচকগুলো ইতিবাচক থাকলে আগামী অর্থবছরেও রাজস্ব আয় বাড়ার প্রবণতা বজায় থাকবে। তবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি সারের দাম বাড়ার কারণে সরকারি ভর্তুকির বোঝা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকার আয় বাড়িয়ে বোঝা লাঘব করতে চায়। তাই আগামী অর্থবছর চলতি অর্থবছরের তুলনায় মোট রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রা ৪৪ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ধরা হয়েছে।

আগামী অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপির দশমিক শতাংশ। চলতি অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এটি মোট জিডিপির ১১ দশমিক শতাংশ। নতুন বাজেটে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। এনবিআর লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা পাচ্ছে। এটি জিডিপির দশমিক শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এনবিআরের আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা (জিডিপির দশমিক শতাংশ) সে হিসাবে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ৪০ হাজার কোটি টাকা বাড়ছে। শতকরা হিসাবে তা ১২ শতাংশ।

আগামী বাজেটে এনবিআর-বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা। কর-বহির্ভূত রাজস্ব (এনটিআর) আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪৫ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে দুই খাতে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা যথাক্রমে ১৬ হাজার কোটি ৪৩ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে নতুন বাজেটে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে যথাক্রমে ১৩ শতাংশ।

আয়-ব্যয়ের তারতম্যের কারণে নতুন বাজেটে ঘাটতি বাড়লেও তা জিডিপির -এর ঘরেই থাকছে। নতুন বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এটি জিডিপির দশমিক শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ঘাটতি জিডিপির দশমিক শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। সে হিসেবে ঘাটতি কমানোর প্রস্তাব থাকছে বাজেটে। কিন্তু জিডিপির তুলনায় ঘাটতি কমলেও টাকার অংকে ঘাটতি বাড়ছে ৩০ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।

বাজেটে ঘাটতি পূরণে আগামী অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেয়া হবে লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর যার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়া হবে লাখ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। চলতি বছরে যার লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়া হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া অন্যান্য খাত থেকে নেয়া হবে হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরেও খাতে একই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। এছাড়া বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ অনুদান (নিট) গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। চলতি বছর এক্ষেত্রে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে রড, সিমেন্টসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে। একইভাবে পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন, বৈদ্যুতিক সামগ্রী, ইলেকট্রো মেকানিক্যাল পণ্যের দাম বেড়েছে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু উন্নয়ন ব্যয় খুব বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব নেই বাজেটে। আসছে বাজেটে এডিপির আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে লাখ ৫৯ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এডিপির আকার লাখ ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা।

আগামী অর্থবছরের জিডিপির আকার বাড়ানো হচ্ছে। প্রাক্কলিত আকার ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। সে অনুযায়ী প্রাক্কলিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দশমিক শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে দশমিক শতাংশ। আগামী অর্থবছরের প্রাক্কলিত মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দশমিক শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা দশমিক শতাংশ।

এদিকে অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন খাতের মোট ভর্তুকি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির দশমিক শতাংশ। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ভর্তুকি প্রণোদনা খাতে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬৬ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির দশমিক শতাংশ।

প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্মের আহ্বায়ক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো . দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বণিক বার্তাকে বলেন, আসন্ন বাজেটের আর্থিক কাঠানো প্রস্তুত করা অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় কষ্টকর। কারণ ব্যয়ের বড় দুটি অংশ যাবে ভর্তুকি প্রণোদনা এবং সুদ পরিশোধে। দুই খাতে প্রায় ৫৭ শতাংশ ব্যয় হবে। এর সঙ্গে বেতন-ভাতাসহ সরকারের অন্যান্য পরিচালন ব্যয় যোগ করলে সেটা আরো বেড়ে যাবে। তাই উন্নয়নমূলক কাজকর্ম করার জন্য অর্থ খুব কমই থাকবে। এটিই এবারের বাজেটের সবচেয়ে বড় সমস্যা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন