এনএসইউর চার ট্রাস্টির জামিন নামঞ্জুর পুলিশে সোপর্দ

নিজস্ব প্রতিবেদক

অর্থ আত্মসাতের মামলায় আগাম জামিনের আবেদন খারিজ করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ট্রাস্টিকে পুলিশে সোপর্দ করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে হেফাজতে নেয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই চারজনকে সংশ্লিষ্ট আদালতে হাজির করতে শাহবাগ থানা পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এনএসইউর চারজন ট্রাস্টি হলেন রেহানা রহমান, এমএ কাশেম, মোহাম্মদ শাহজাহান বেনজীর আহমেদ। ওই মামলায় জামিন চেয়ে চারজনের করা পৃথক আবেদনের শুনানি শেষে গতকাল বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আদেশ দেন।

এর আগে শুনানিকালে আদালত বলেন, মানি লন্ডারিং দুর্নীতি হত্যার চেয়ে বিপজ্জনক অপরাধ। একটি হত্যা একজন ব্যক্তি বা পরিবার বা সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তবে মানি লন্ডারিং দুর্নীতি দেশ জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জমি কেনা বাবদ অতিরিক্ত ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয় দেখিয়ে তা আত্মসাতের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মে মামলাটি করে দুদক। ছয়জনের মধ্যে ওই চারজন আগাম জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন। এর ওপর গত বুধবার শুনানি হয়। ওইদিন আদালত পক্ষগুলোকে শুনানির সারসংক্ষেপ লিখিত আকারে জমা দিতে বলে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন। ধার্য তারিখে আবেদনকারীপক্ষ সারসংক্ষেপ লিখিত আকারে জমা দিতে সময়ের আরজি জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত গতকাল বেলা ২টা পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন। একই সঙ্গে আবেদনকারীদের নির্ধারিত সময়ে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন।

এর ধারাবাহিকতায় গতকাল বেলা সোয়া ২টার দিকে জামিন আবেদনের শুনানি হয়। সময় চার আবেদনকারী আদালতে হাজির ছিলেন। আদালতে আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফিদা এম কামাল মিজান সাঈদ। দুদকের পক্ষে আইনজীবী খুরশীদ আলম খান শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন, সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক।

পুলিশে সোপর্দ নিম্ন আদালতে হাজির বিষয়ে জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মওদুত হাওলাদার গতকাল সন্ধ্যায় বণিক বার্তাকে বলেন, আদালত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন ট্রাস্টির আগাম জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে তাদের গ্রেফতারের নির্দেশনা দেন। তাদের হেফাজতে নেয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট আদালতে হাজির করার নির্দেশনা রয়েছে। সে নির্দেশনার আলোকে চারজন ট্রাস্টিকে থানায় নিয়ে আসা হচ্ছে। তাদের রাতে থানা হেফাজতেই রাখা হবে। কাল সকালে পরবর্তী নির্দেশনার জন্য তাদের নিম্ন আদালতে হাজির করা হবে।

আদালতের বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে রাত সাড়ে ১১টার দিকে এনএসইউর চার ট্রাস্টিকে প্রিজন ভ্যানে করে শাহবাগ থানায় নিয়ে আসা হয়। প্রথমে একটি প্রিজন ভ্যানে করে তিনজন পুরুষ ট্রাস্টিকে নিয়ে আসা হয়। পরে পৃথক প্রিজন ভ্যানে করে আনা হয় নারী ট্রাস্টি রেহানা রহমানকে।

ট্রাস্টিদের নিয়ে আসার আগে বিকাল থেকেই তাদের কয়েকজন আত্মীয় শাহবাগ থানায় চলে আসেন। তাদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, চারজন ট্রাস্টির সবাই সত্তরোর্ধ্ব। আমরা তাদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে উদ্বিগ্ন।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ট্রাস্টিই দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী। গতকাল আদালতের নির্দেশে পুলিশে সোপর্দ হওয়া চারজনই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। এর মধ্যে এমএ কাশেম মিউচুয়াল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক পদে রয়েছেন। তিনি এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এবং কয়েক মেয়াদে নর্থ সাউথের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এনএসইউ ট্রাস্টের আরেকজন প্রতিষ্ঠাকালীন আজীবন সদস্য রেহানা রহমান বেঙ্গল ট্রেডওয়েজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে রয়েছেন। মোহাম্মদ শাহজাহান শাহ ফতেহউল্লাহ টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড জালাল আহমেদ স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আর বেনজীর আহমেদ রেমন্ড গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি।

এদিকে জমি কেনার নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের বাইরেও নানা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে নর্থ সাউথ ট্রাস্টিদের বিরুদ্ধে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দ্য নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টের মাধ্যমে। ট্রাস্টের ডিডে ট্রাস্টের প্রকৃতি বিষয়ে বলা হয়েছে, ট্রাস্ট মানবহিতৈষী, দানশীল, জনহিতকর, অরাজনৈতিক, অলাভজনক অবাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হবে। যদিও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হয়েছেন এর ট্রাস্টিরা। সিটিং অ্যালাউন্স, ভ্রমণ ভাতা, গাড়ির জ্বালানি চালকের বেতন-ভাতাসহ নামে-বেনামে নানা আর্থিক সুবিধা নিয়ে আসছেন ট্রাস্টিরা।

একটি হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১১ জন বিওটি সদস্য শুধু সিটিং অ্যালাউন্স বাবদই নিয়েছেন কোটি ২৭ লাখ টাকা। ওই বছর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) প্রতিটি সভায় সিটিং অ্যালাউন্স বাবদ একেকজন সদস্য নিয়েছেন লাখ টাকা করে। অন্য সব কমিটির সভায় নিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা ভাতা। গাড়িচালক জ্বালানি বাবদ প্রত্যেক মাসে ভাতা নেন প্রায় ৫০ হাজার টাকা করে। পরবর্তী সময়ে সমালোচনার মুখে সিটিং অ্যালাউন্স কমিয়ে অর্ধেক করে বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ।

সিটিং অ্যালাউন্স নিতে নানা অপ্রয়োজনীয় কমিটি গঠনের অভিযোগও রয়েছে এনএসইউ ট্রাস্টের বিরুদ্ধে। এসব কমিটির মধ্যে রয়েছে প্রোগ্রাম রিভিউ কমিটি, প্রশাসনিক পদোন্নতি কমিটি, শিক্ষক পদোন্নতি কমিটি, লাইব্রেরি কমিটি, শিক্ষক অনুসন্ধান কমিটি, ডিগ্রি পর্যালোচনা কমিটি, ছাত্র ভর্তি কমিটি, নিড অ্যাসেসমেন্ট কমিটি, টেকনিক্যাল কমিটি, ক্রয় কমিটি, শিক্ষক ছুটি কমিটি, একাডেমিক রিভিউ কমিটি, কনফারেন্স ট্রাভেল রিসার্চ গ্র্যান্ট কমিটি, আইন সাংবিধানিক কমিটি, ছাত্র বৃত্তি কমিটি, ক্যাম্পাস উন্নয়ন কমিটি, অডিট কমিটি, ইন্টারন্যাশনাল প্রমোশন অ্যান্ড অ্যাফিলিয়েশন কমিটি অন্যান্য কমিটি। এসব কমিটিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের সভায় যেকোনো ট্রাস্টি অংশ নিতে পারবেন বলে রেজল্যুশন অনুমোদন করেছে এনএসইউ ট্রাস্ট।

শুধু ভাতা নয়; বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থে নিজেদের জন্য বিলাসবহুল গাড়িও কিনেছেন ট্রাস্টিরা। বছর কয়েক আগে ল্যান্ড রোভারের রেঞ্জ রোভার ২০১৯ মডেলের নয়টি বিলাসবহুল গাড়ি কেনে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি সদস্যরা গাড়িগুলো ব্যবহার করছেন। গাড়ির রেজিস্ট্রেশনসহ একেকটি গাড়ি কিনতে ব্যয় হয়েছে প্রায় কোটি টাকা। এমনকি গাড়ির জ্বালানি চালকের বেতনের অর্থও পরিশোধ করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে। জ্বালানি বাবদ প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা নিচ্ছেন ট্রাস্টিরা। আর চালকের বেতনও ২০-২৫ হাজার টাকা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন