বন্যায় সিলেটে ফসল ও গ্রামীণ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি

নূর আহমদ, সিলেট

বানের পানি কিছুটা কমে এলেও এখনো নেমে যায়নি। এখনো ঘরে ফেরা হয়নি বানভাসিদের। গত কয়েকদিনের বন্যায় লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে সিলেটের গ্রামীণ অবকাঠামো। কৃষকের পাকা ধান গ্রামীণ রাস্তাঘাট ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বানের পানিতে ভেসে গিয়েছে হাজার হাজার পুকুরের মাছ। এমনকি ভয়াবহ বন্যায় পানি উঠেছে ব্যবসায়ীদের গুদামেও। এতে তলিয়ে যায় গুদামের ধানও। পানিবন্দিদের ব্যাপক দুর্ভোগের পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব পড়েছে এলাকার সব শ্রেণী-পেশার মানুষের ওপর। 

সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর প্রাথমিক হিসাবমতে, ২১ মে পর্যন্ত হাজার ৬৬০ হেক্টর আউশ ধানের বীজতলা, বোরো ধান হাজার ৭০৪ হেক্টর হাজার ৫৩৮ হেক্টর জমির গ্রীষ্মকালীন সবজি বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নগরীসহ সিলেট সড়ক জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রায় ৫৩৬ কিলোমিটার সড়ক। জেলার ১১ উপজেলার হাজার ২৫১টি পুকুর ডুবে গিয়েছে। সব মিলিয়ে বন্যায় হাজার ৩৩৭ টন মাছ ১২১ টন পোনা বেরিয়ে গিয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে কোটি ৭৪ লাখ টাকা। 

বন্যায় যোগাযোগ খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, নগরীসহ সিলেট সওজ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রায় ৫৩৬ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের ২৩০ সওজের আওতাধীন আটটি সড়কে ৫৫ কিলোমিটার পথ রয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব সড়কে বন্যার ক্ষত ফুটে উঠছে। 

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতাধীন সিলেট জেলার ১০টি উপজেলার ৬৬ সড়কে ২৩০ কিলোমিটার তলিয়ে গিয়েছিল। এসব সড়ক থেকে পানি নেমে যেতে শুরু করেছে। দপ্তরের প্রাথমিক হিসাব মতে, ১৭২ কোটি ২৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। নতুন করে প্লাবিত এলাকাগুলোর পানি নেমে গেলে ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। 

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী এনামুল কবীর জানান, জেলার গোয়াইনঘাটে ২৭টি সড়কে ৮২ দশমিক ১৩ কিলোমিটার, কানাইঘাটে ১৫টি সড়কে ৩০ দশমিক , জৈন্তাপুর উপজেলার ১১টি সড়কে ৩২ দশমিক , সিলেট সদরের ১২টি সড়কে ২১ দশমিক ৩৮, গোলাপগঞ্জে ১০টি সড়কে ২২ দশমিক , কোম্পানীগঞ্জে চারটি সড়কে ৩৪ দশমিক ৬৩, দক্ষিণ সুরমার চারটি সড়কে সাড়ে তিন, ফেঞ্চুগঞ্জে একটি সড়কে দেড়, ওসমানীনগর উপজেলায় একটি সড়কের প্রায় দেড় বালাগঞ্জে একটি সড়কে দেড় কিলোমিটার সড়ক ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে।

সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মুস্তাফিজুর রহমান জানান, সারি-গোয়াইনঘাট সড়কের ১২ দশমিক ৪০ কিলোমিটার, সিলেট-তামাবিল-জাফলং সড়কের দশমিক ২০কানাইঘাটের দরবস্ত-কানাইঘাট-শাহবাগ সড়কের ১৪ দশমিক ৮০ এবং সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের দশমিক ৫০ কিলোমিটার পানির নিচে ছিল।  

সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার রশিদপুর-লামাকাজি সড়ক ১৫-১৭তম কিলোমিটার পর্যন্ত, কোম্পানীগঞ্জ-ছাতক সড়ক -১২তম কিলোমিটার পর্যন্তশেওলা-সুতারকান্দি সড়কে এক থেকে চতুর্থ কিলোমিটার পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে এক-পাঁচ ফুট পর্যন্ত পানির নিচে ছিল। বিমানবন্দর-বাদাঘাট-কুমারগাঁও (টুকেরবাজার) সড়কের বিভিন্ন জায়গা এক থেকে সাড়ে তিন ফুট পর্যন্ত পানির নিচে ছিল। উঁচু এলাকার সড়কগুলো ভেসে উঠলেও এখনো অনেক সড়কের পানি পুরো নেমে যায়নি। সড়কগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।  

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান জানান, সিসিক এলাকার ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৪টির প্রায় ২৫০ কিলোমিটার সড়কে বন্যার পানি ওঠে, যা মোট সড়কের অর্ধেক। অনেক সড়ক  থেকে এখনো পানি নেমে যায়নি।

অন্যদিকে সিলেট নগরীর সুরমার তীরঘেঁষা কাজিরবাজার এলাকায় রয়েছে অর্ধশতাধিক অটো রাইস মিল। বন্যার পানিতে এসব রাইস মিলের গুদামে পানি উঠে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গুদামে রাখা সারি সারি ধান-চালের বস্তা বন্যার পানিতে ভিজে নষ্ট হয়েছে। এসব ধান-চালের বস্তা সরিয়ে নেয়ার সুযোগও পাননি ব্যবসায়ীরা। কাজিরবাজারের মোস্তাক অ্যান্ড ব্রাদার্স, এমএস অটো রাইস মিল, মতিন ব্রাদার্স, হাসান ব্রাদার্স, ফাইয়ান পদ্মা রাইস মিল, দয়া জামান মিল, রঙ্গেশ অটো রাইস মিলের গুদামে হাজার হাজার বস্তা ধান-চাল রাখা ছিল। এসব গুদামের ধান-চাল নষ্ট হয়ে গিয়েছে। 

পাঁচটি গুদামের হাজার ২০০ বস্তা চাল নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন মোস্তাক অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপক আবুল কালাম। তিনি জানান, চাল একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। শুকিয়েও কোনো লাভ হবে না। 

সিলেট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ জানান, সিলেটের ১৩টি উপজেলার মধ্যে ১১টিতে হাজার ৩২২টি পুকুরে খামারিরা মাছ চাষ করেছেন। এর মধ্যে হাজার ২৫১টি পুকুর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব পুকুর ভেসে যাওয়ায় মোট কোটি ৭৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। জকিগঞ্জ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি পুকুরের মাছ ভেসে গিয়েছে। উপজেলায় হাজার ১০০টি পুকুরের মাছ ভেসে গিয়েছে। গোয়াইনঘাট উপজেলায় ভেসে গিয়েছে দুই হাজার পুকুরের মাছ।

কৃষি অধিদপ্তর সিলেটের উপপরিচালক কাজী মুজিবুর রহমান জানান, বন্যায় সিলেটে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। হাজার ৬৬০ হেক্টর আউশ ধানের বীজতলা, বোরো ধান হাজার ৭০৪ হেক্টর হাজার ৫৩৮ হেক্টর জমির গ্রীষ্মকালীন সবজি বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়েছে। তিনি জানান, বন্যার পানি এখনো পুরো নেমে যায়নি। জকিগঞ্জসহ কিছু উপজেলায় পানি বাড়ছে। এলাকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়লে সামগ্রিক ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে। 

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান জানান, বন্যায় সামগ্রিকভাবে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এখন এর কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। এতে বেরিয়ে আসছে ক্ষতির পরিমাণ। সবকটি দপ্তর ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণে কাজ করছে। বিশেষ করে কৃষকরা যাতে দ্রুততম সময়ে চাষাবাদ শুরু করতে পারেন সে ব্যাপারে সহায়তার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন