বিএনপির মুক্ত সাংবাদিকতাবিষয়ক মতবিনিময়

গণমাধ্যমের সঙ্গে বৈরিতা পরিহার করতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতীয় প্রেস ক্লাবে গতকাল ‘গণতন্ত্র হত্যায় গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইন: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে বিএনপি ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকলে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ গণমাধ্যমবান্ধব থাকে। কিন্তু সরকারে গেলেই শুরু হয় বৈরিতা। তখন আর বন্ধুত্ব থাকে না। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিএনপি আয়োজিত গণতন্ত্র হত্যায় গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইন : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এসব কথা উঠে আসে। বক্তারা বলেন, বিরোধী দলে থেকে যেমন গণমাধ্যম মুক্ত সাংবাদিকতাবিষয়ক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে, ক্ষমতায় গেলেও বিএনপি যেন তা অব্যাহত রাখে। গণতন্ত্রের স্বার্থে গণমাধ্যমের সঙ্গে বৈরিতা পরিহার করা উচিত বলেও মনে করেন তারা।

মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সময় উপস্থিত ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ প্রমুখ। সাংবাদিকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সোহরাব হাসান, রুহুল আমিন গাজী, কামাল উদ্দিন সবুজ, আব্দুল হাই শিকদার, এম আব্দুল্লাহ, সৈয়দ আবদাল আহমেদ, সরদার ফরিদ, ইলিয়াস খান, কাদের গনি চৌধুরী, বাকের হোসেন, ইলিয়াস হোসেন, রফিকুল ইসলাম আজাদ, মুরসালিন নোমানী, শফিক আহমেদ প্রমুখ।

গণমাধ্যম মুক্ত সাংবাদিকতা নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করায় বিএনপিকে সাধুবাদ জানান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান। তিনি বলেন, বিএনপির আজকের আয়োজনকে সাধুবাদ জানাই। তবে তাদের অতীত ইতিহাস আশ্বস্ত হওয়ার মতো নয়। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যদি এমন আয়োজন করা হতো, তাহলে গণতন্ত্র গণমাধ্যম উপকৃত হতো। সবসময়ই দেখা গিয়েছে, বিরোধী দল গণমাধ্যমবান্ধব হয়। কিন্তু তারাই যখন সরকারে যায় তখন আর বন্ধুত্ব থাকে না, বরং বৈরিতা তৈরি হয়।

প্রবীণ সাংবাদিক বলেন, কাউকে ক্ষমতায় ধরে রাখা কিংবা কাউকে ক্ষমতায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব সাংবাদিকদের নয়। সরকার যদি অন্যায়ভাবে কণ্ঠরোধের চেষ্টা করে, তাহলে আমরা নিশ্চয়ই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতিবাদ করব। তবে আমরা প্রত্যাশা করি, এখন যারা বিরোধী দলে থাকার সময় গণমাধ্যম সাংবাদিকদের সঙ্গে সখ্য রেখে কথা বলছেন, ক্ষমতায় গিয়ে তা বজায় রাখবেন। বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি আপনারা ক্ষমতায় গেলেও বর্তমানের ভাষায় কথা বলা অব্যাহত রাখবেন।

সময় বর্তমান সরকারের আমলে সংঘটিত বিভিন্ন সাংবাদিক নির্যাতনের তথ্য তুলে ধরেন বিএফইউজের একাংশের সভাপতি এম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে সংঘটিত সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যা, দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকদের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা দায়েরসহ সারা দেশে সাংবাদিকদের নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। তবে বিএনপির আমলে সাংবাদিক নির্যাতন হয়নি, তা জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ওই সময় সাংবাদিক হত্যা নির্যাতনের অধিকাংশ ঘটনাই ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। যা চোরাকারবারিদের সঙ্গে জড়িত দুর্বৃত্তরা ঘটিয়েছিল। এখন ঘটছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বর্তমান চিত্র তুলে ধরে যুগান্তরের জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক মাহবুব কামাল বলেন, বাংলাদেশের প্রেসের অবস্থা খুবই মারাত্মক। এর কারণ হলো আইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশে অসংখ্য আইন আছে, যা স্বাধীন মুক্ত গণমাধ্যমের পরিপন্থী। প্রত্যেকটি আইন সংবাদপত্র গণমাধ্যমের জন্য পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে হুমকিস্বরূপ। প্রতিকূল একটা পরিবেশের মধ্যে আমরা এখন আছি। প্রতিকূল পরিবেশ থেকে উত্তরণের জন্য সবচেয়ে যেটা বেশি দরকার সেটা হচ্ছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ প্রত্যেকটি আইনকে সংশোধন অথবা বাতিল করা। এদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় যারা ক্ষমতায় থাকবেন, তারা যদি গণতান্ত্রিক না হন তাহলে আইন থাকুক বা না থাকুক সেদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কখনো প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ বলেন, পুরো দেশটিই এখন একটা সিন্ডিকেটের মধ্যে পড়েছে। দেশপ্রেমিক সরকার না থাকলে গণমাধ্যমকে আমরা কখনই মুক্ত করতে পারব না। বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব এমএ আজিজ বলেন, যত দিন যাচ্ছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে। কারণ, সরকারে যেই আসে, তারা কোনো না কোনোভাবে গণমাধ্যমকে আঘাত করে। কিন্তু এখনকার মাত্রাটা অসহনীয়, সীমাছাড়া।

নিজের বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বর্তমান সরকার ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ যে চারটি আইন করেছে, তা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কফিনে পেরেক ঠুকে দেয়ার মতো। সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। এটা করতে গিয়ে তারা ধরে নিয়েছে যে সবার আগে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

গণমাধ্যমগুলোয় গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির তীব্র সমালোচনা করেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, প্রায় প্রতিটি গণমাধ্যমকে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের নজরদারি এমন পর্যায়ে গিয়েছে, কোন সাংবাদিক কখন কার সঙ্গে কথা বলছেন, দেখা করছেন, সেটাও নজরদারি করা হচ্ছে। সুবিধামতো সেসব কথোপকথন প্রকাশ করা হচ্ছে।

এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতে মূল প্রবন্ধে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার প্রকাশিত গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশের ১০ ধাপ অবনমনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

সভায় মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের ক্রমাবনতির প্রেক্ষিত বিএনপির ভাবনা শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন। এতে গণমাধ্যমের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরার পাশাপাশি বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কী কী পদক্ষেপ নেবে তা তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের কার্যকারিতা এখন আর তেমন একটা লক্ষ্য করা যায় না। বিএনপি সরকার গঠন করলে প্রেস কাউন্সিল পুনর্গঠন করে এর ক্ষমতা বাড়ানো হবে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত যেকোনো বিষয়ে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা সংস্থা প্রেস কাউন্সিলে ফয়সালা করে কোনোভাবেই যেন আদালতে মামলা দায়ের করতে না পারেন, সেটি নিশ্চিত করা হবে। গণমাধ্যমকে স্বাবলম্বী করতে বিএনপি বিজ্ঞাপনের সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করবে। পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট সংখ্যক প্রকাশ কিংবা টিআরপির ভিত্তিতে গণমাধ্যমগুলোকে আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার চিন্তাও বিএনপির রয়েছে।

দেশের ব্যবসা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেন বিজ্ঞাপন দেয়ার ক্ষেত্রে দেশীয় গণমাধ্যমগুলোকে অগ্রাধিকার দেয় সেটি নিশ্চিত করার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। এছাড়া সঠিকভাবে ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হবে।

উন্নত দেশের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, সুইডেনসহ উন্নত দেশগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যম গণমাধ্যমকর্মীদের সুরক্ষা আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ধরনের আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণমাধ্যম গণমাধ্যমকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন