প্রান্তিক পর্যালোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক

কাঁচামাল আমদানির উচ্চমূল্যে পোশাকের নিট রফতানি কমেছে

বদরুল আলম

কভিডের অভিঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে পোশাক রফতানি কমে যায় ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ। এর পরের অর্থবছরেই অতিমারীর প্রভাব কাটিয়ে রফতানি বাড়তে শুরু করে। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে পোশাক রফতানি বাড়ে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরও প্রবৃদ্ধিতে বড় উল্লম্ফন দেখা গিয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনা বলছে, রফতানি মূল্য থেকে কাঁচামাল আমদানির পরিমাণ বাদ দিলে যে নিট বা প্রকৃত রফতানি, তা পোশাকের ক্ষেত্রে কমেছে।

পোশাক রফতানির গতি-প্রকৃতি নিয়ে নিয়মিতভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের এক্সটারনাল ইকোনমিকস শাখা থেকে প্রান্তিক পর্যালোচনা শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে জানুয়ারি থেকে মার্চের রফতানি পরিসংখ্যান নিয়ে পর্যালোচনার সর্বশেষ সংস্করণ। এতে দেখা গিয়েছে, প্রান্তিকে এর আগের প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) তুলনায় পোশাকের নিট রফতানি কমেছে। এক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়াকে কারণ হিসেবে দেখিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, জানুয়ারি থেকে মার্চে মোট পোশাক রফতানির ৪৭ দশমিক শতাংশই ছিল কাঁচা তুলা, কৃত্রিম সুতা, তুলাজাত সুতা এবং বস্ত্র অ্যাকসেসরিজের মতো কাঁচামাল আমদানি মূল্য, যা মোট রফতানি থেকে বাদ দিয়ে পোশাকের নিট রফতানি হয়েছে ৬০২ কোটি ২৫ লাখ ৩০ হাজার ডলারের। গত ২০২০-২১ অর্থবছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকের তুলনায় যা ৩১ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। তবে অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকের তুলনায় দশমিক ৮৯ শতাংশ কম। কাঁচামাল আমদানি বাবদ অনেক বেশি ব্যয় হওয়ায় প্রান্তিকে নিট রফতানি কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনার সঙ্গে একমত পোশাক প্রস্তুত রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমদানি ব্যয় বেড়েছে। বিশেষ করে আমদানি পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। এর ফলে মূল্য সংযোজনের হারও কমেছে। কমেছে নিট রফতানি। পোশাকের ভ্যালু অ্যাডিশন আরো বাড়লে রফতানি মূল্যও বেশি পাওয়া সম্ভব।

সারা বিশ্বেই ফ্যাব্রিকের গঠন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে জানিয়ে শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, যেখানে ৭০ শতাংশই কটন ব্যবহার করা হতো, বর্তমানে সেখানে ৭০ শতাংশ কৃত্রিম তন্তু ব্যবহূত হচ্ছে। কটন আর কৃত্রিম তন্তু ব্যবহার করে একটি টি-শার্ট বানাতে একই সময় লাগে। কিন্তু কৃত্রিম তন্তুর ক্ষেত্রে দাম বেশি পাওয়া যায়। এতে রফতানি মূল্য বেড়ে যায় ২০-৩০ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে বাংলাদেশের বহিঃখাত মূলত পোশাক রফতানির ওপর নির্ভরশীল। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকের মোট রফতানির ৮৫ দশমিক ৩৫ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক শিল্পের ওভেন নিটওয়্যার পণ্য। খাতের প্রবৃদ্ধির গতি বজায় রাখতে বিভিন্ন ধরনের সহায়ক পদক্ষেপের সুপারিশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব পদক্ষেপের মধ্যে আছে কম দামে কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করা, উৎপাদনের লিড টাইম হ্রাস, বিভিন্ন স্বল্পমূল্যের পুনঃঅর্থায়ন স্কিম নিশ্চিত, ব্যবসা সহজীকরণ এবং মৌলিক কম মূল্যের পরিবর্তে বৈচিত্র্যময় পণ্য রফতানি করা।

গত মার্চে প্রকাশিত অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকের পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল, ক্রেতারা ক্রমেই বাংলাদেশে পোশাকের ক্রয়াদেশ স্থানান্তর করছে। ২০২১ সালের জুনে রফতানি বাড়লেও গতি ছিল মন্থর। সেই গতি বাড়তে শুরু করে সেপ্টেম্বরে। চলমান কভিড অতিমারীতেও ২০২১ সালের ডিসেম্বরে রফতানি ছিল অনেক বেশি উৎসাহব্যঞ্জক। বৈশ্বিক লকডাউন শিথিল হওয়ার পর ক্রেতারা ক্রমেই ক্রয়াদেশ স্থানান্তর করছেন বাংলাদেশে। বর্তমানে পোশাক রফতানি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে তুলা সুতার মতো কাঁচামালের দাম, অস্বাভাবিক পরিবহন খরচ, ক্রয়াদেশ বাতিলের মতো সমস্যাগুলো তাত্ক্ষণিকভাবে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন বলেও জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

পোশাক শিল্প মালিকরা বলছেন, ক্রয়াদেশ স্থানান্তর কম-বেশি এখনো অব্যাহত আছে। তবে ক্রেতারা ক্রয়াদেশ দেয়ার গতি কমিয়েছেন।

যুদ্ধের প্রভাবে ক্রেতারা আসন্ন মৌসুমগুলোর ক্রয়াদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে অনেক সচেতন অবস্থান রক্ষা করে চলছেন। ফলে আগামী দিনে রফতানি রফতানি প্রবৃদ্ধির গতি টেকসই হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। 

ক্রেতাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সম্প্রতি ইউরোপ পরিস্থিতির অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন ঘটেছে। যুদ্ধ দুই দেশের মধ্যে হলেও প্রভাব দেখা যাচ্ছে বৈশ্বিক। প্রধান মুদ্রা, কাঁচামাল, জীবাশ্ম জ্বালানির দাম বাড়ছে। ব্যবসার প্রেক্ষাপটগুলোয়ও প্রভাব পড়ছে। রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ তাদের গুরুত্বপূর্ণ বাজার। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশগুলোর বিক্রয়কেন্দ্র পরিবেশকদের জন্য ক্রয়াদেশ কমিয়ে আনতে হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতি অবশ্যই ক্ষতির মুখে ফেলবে, কারণ এরই মধ্যে কাপড় অ্যাকসেসরিজের ক্রয়াদেশ দিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অবশ্যই ব্যবসার ওপর সার্বিক সংকটের প্রভাব কমাতে হবে। যার জন্য ঝুঁকি ভাগ করে নিতে হবে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছে। পরিবহন ব্যয় বেড়ে হয়েছে সবসময়ের চেয়ে বেশি। অবস্থায় আগামী মৌসুমের ক্রয়াদেশগুলো পুনরায় পর্যালোচনার বিষয়ে সহায়তার প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ইউরোপভিত্তিক বড় এক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা কাজ করছি সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখছি। পোশাক কারখানা মালিকরা জানিয়েছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ক্রেতারা সবাই শঙ্কিত। পোশাকের সঙ্গে অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের একধরনের সংযোগ রয়েছে। কারণ দেশগুলোর উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের ওপর গোটা ইউরোপের নির্ভরশীলতা কম নয়। বর্তমানে সরবরাহ চেইনটা বিঘ্নিত হয়েছে। খাদ্যপণ্যের ঘাটতি দেখা দিতে শুরু করেছে। মৌলিক চাহিদার মধ্যে প্রথমেই আসে খাদ্য, বস্ত্র আশ্রয়। খাদ্যের ওপর যখন চাপ পড়তে শুরু করেছে, এর রেশটা বস্ত্রের ওপর পড়াটা খুবই স্বাভাবিক।

পোশাক পণ্যের অন্যতম বড় রফতানিকারক গ্রুপ মাইক্রো ফাইবার। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (অর্থ) . কামরুজ্জামান কায়সার বণিক বার্তাকে বলেন, অর্থবছরের সময়টায় তৃতীয় বা চতুর্থ মৌসুমের ক্রয়াদেশ আসে। কভিড পরিস্থিতি ছাড়া প্রতি বছর সময়ে যে ক্রয়াদেশ আসে, সেই প্রবাহ এখন নিম্নমুখী। যুদ্ধের বিষয়টি সব জায়গায়ই নাড়া দিয়েছে, বিভিন্নভাবে যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলোয় প্রভাবও পড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই শঙ্কা দেখা দিয়েছে। জার্মানিসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে ইনফ্লেশন শুরু হয়ে গিয়েছে। কভিড সামগ্রিকভাবে আমাদের অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে আমরা ঘুরে দাঁড়াতেও শুরু করেছিলাম। এখন আবার নতুন দুর্যোগের কারণে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায় অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, শঙ্কা আসছে। অনেকের ক্রয়াদেশ কমে গিয়েছে বা কমছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন