দৃঢ় প্রত্যয়ে চলছে দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা। উন্নয়ন জোরদারে বিপুলসংখ্যক উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ উন্নয়ন প্রকল্প মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় হচ্ছে না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)। শনিবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এমনটা জানানো হয়। তথ্য বলছে, দেশের ভৌগোলিক এলাকায় মাত্র শতকরা ১০ ভাগ অংশের মাস্টারপ্ল্যান প্রণীত হয়েছে। আগামী বছর নাগাদ এর পরিমাণ হবে বড়জোর ১২ শতাংশ। সুতরাং বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রকল্প প্রণয়নের সঙ্গে স্থানীয় মাস্টারপ্ল্যানের বড় বিযুক্তি বিদ্যমান। এমনকি ঢাকা মহানগরসহ যেসব এলাকায় মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে সেখানেও অনেক প্রকল্প নেয়া হয় বা হচ্ছে, যার সঙ্গে মাস্টারপ্ল্যানের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। ফলে অনেকটা অপরিকল্পিত উন্নয়ন হচ্ছে এবং মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সুফল। এ অবস্থায় এডিপিভুক্ত সব উন্নয়ন প্রকল্প মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় করার তাগিদ দিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। পরিকল্পিত উন্নয়নের স্বার্থে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন।
গত দেড় দশকে দেশে লক্ষণীয় মাত্রায় ভৌত উন্নয়ন হয়েছে। সরকারি অর্থায়নে রাস্তাঘাট, ভবন-ইমারতসহ নির্মাণ হয়েছে অনেক অবকাঠামো। চলমান উন্নয়নযজ্ঞে নগর, মফস্বল ও গ্রামের পার্থক্য অনেকটা হ্রাস পাচ্ছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন প্রকল্প। কিন্তু প্রক্রিয়াগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কিছু দুর্বলতা রয়ে যাচ্ছে সেখানে। কোনো কোনো প্রকল্প তৈরিতে মানা হচ্ছে না নিয়মনীতি। যথাযথভাবে করা হচ্ছে না সম্ভাব্যতা যাচাই। অনেক ক্ষেত্রে বাস্তব প্রয়োজনের চেয়ে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে প্রভাবশালীদের চাওয়াকে। প্রক্রিয়াগত আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো, উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে স্থানীয় এলাকার মাস্টারপ্ল্যানের যোগসূত্রের অভাব। প্রকল্পগুলো অনেকটা উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়। স্থানীয় ভৌগোলিক বিন্যাসের সঙ্গে এর সংশ্লিষ্টতা নেই। নেই কোনো কমিউনিটি সম্পৃক্ততাও। বাস্তবায়ন পর্যায়েও আছে নানা দুর্বলতা। ভূমি অধিগ্রহণে ও স্থান নির্বাচনে সৃষ্ট জটিলতা প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা। দক্ষ ও পর্যাপ্তসংখ্যক প্রকল্প পরিচালক না পাওয়াও আরেক সমস্যা। সংশ্লিষ্ট বিধিতে ৫০০ মিলিয়ন টাকার উপরের প্রকল্পগুলোয় একজন স্থায়ী প্রকল্প পরিচালক থাকার বাধ্যবাধকতা আছে। এটি যথাযথভাবে পরিপালিত হয় না। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন জেলায় বাস্তবায়িত অর্ধ ডজন বা আরো বেশি প্রকল্প তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেয়া হয় একজন প্রকল্প পরিচালককে। আবার কোনো কোনো প্রকল্পে আছে বিস্তর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। অনেক সময় অর্থ লোপাটে প্রকল্প মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাওয়ার দশা। সর্বোপরি প্রকল্প তদারকিতে রয়েছে দক্ষ জনবলের ঘাটতি। সব মিলিয়ে অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে চলছে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ, যা হতাশাজনক।
দেশেও পরিকল্পিত উন্নয়ন সম্ভব, তার উদাহরণ রাজশাহী। নগর কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) বিভাগীয় শহরটির জন্য ২০ সাল মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করেছে এবং ১০ সাল মেয়াদি এরিয়া প্ল্যানও তৈরি করা হয়েছে। এর আওতায় সড়ক নির্মাণ, ফ্লাইওভার, উড়াল সেতু, পরিকল্পিতভাবে ভবন-ইমারত নির্মাণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, জলাবদ্ধতা দূরীকরণের কাজ চলছে। এছাড়া উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, পার্ক ইত্যাদি সংরক্ষণ ও যথোপযুক্ত ব্যবহার উপযোগী করে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে পরিবেশ উন্নয়নে খ্যাতি অর্জন করেছে রাজশাহী শহর। নগর উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের কারণেই পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর, দৃষ্টিনন্দন, সবুজ, উন্নত ও বাসযোগ্য পরিবেশবান্ধব শহর পেয়েছে মহানগরবাসী। নগরীর প্রধান সড়ক বিভাজক, সড়ক দ্বীপে এবং ফুটপাথে লাগানো হয়েছে সৌন্দর্যবর্ধক বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। সবুজ হয়েছে প্রায় ৩০ কিলোমিটার সড়ক বিভাজন ও চত্বর। এটা সম্ভব হয়েছে মাস্টারপ্ল্যান অনুসরণ, নগর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতা, সিটি করপোরেশনের সক্রিয়তা ও নাগরিক বিশেষ করে পরিকল্পনাবিদদের সম্পৃক্তির কারণে। রাজশাহীর অভিজ্ঞতা দেশের সবখানে অনুসরণীয়।
প্রধানমন্ত্রী বারবার মাস্টারপ্ল্যানের ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণের নির্দেশনা দিয়ে আসছেন। শুধু শহর-মফস্বল নয়, এমনকি গ্রামেও তিনি মাস্টারপ্ল্যানের ওপর জোর দিচ্ছেন। অথচ আমরা দেখছি অনেক উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে মাস্টারপ্ল্যান ছাড়াই। এটা প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বর্তমানে দেশের বড় সিটি করেপারেশনের মতো পৌরসভাগুলোয় অপরিকল্পিত উন্নয়ন হচ্ছে। পৌরসভার আইন অনুযায়ী পৌর এলাকায় সর্বোচ্চ সাততলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ হওয়ার কথা। অথচ সেখানে ১০-১২ তলা ভবন হচ্ছে। পৌর এলাকায় মাঠ-পার্ক, খালি জায়গা কিছুই রাখা হচ্ছে না। খাল-জলাশয় ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। গাছপালা ও সবুজের আধার নির্বিচারে বিলীন করা হচ্ছে। মূলত এটা হচ্ছে মাস্টারপ্ল্যান অনুসরণ না করার কারণে। কোনো কোনো পৌরসভায় মাস্টারপ্ল্যান করা হলেও তা অনুমোদন করা হয়নি। আবার কোনো কোনো পৌরসভায় সেটি প্রণয়নই করা হয়নি। যেসব পৌর এলাকায় মাস্টারপ্ল্যান করা হয়নি, সেটা জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাড়াতে হবে জনসম্পৃক্ততা।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পরিকল্পিত উন্নয়ন নিশ্চিতে বিআইপি বেশকিছু সুপারিশ করেছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, সারা দেশের ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা ও ভৌত পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এ-সংক্রান্ত শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন; মাস্টারপ্ল্যান ও উন্নয়ন প্রকল্পের যোগসূত্র স্থাপন, পরিকল্পনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো পুনর্গঠন এবং বিশেষজ্ঞ নিয়োগদান; বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগকে ঢেলে সাজানো; আইএমইডির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত টেকনিক্যাল জনবল, লজিস্টিক সাপোর্ট নিশ্চিতকরণ ও জেলা পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারণ এবং জেলা পর্যায়ে আইএমইডির কার্যক্রমে নগর পরিকল্পনাবিদদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। এসব সুপারিশ আমলে নেয়া যেতে পারে।
অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প নিয়ে করা অবকাঠামোসহ যেকোনো উন্নয়নকাজ টেকসই হয় না। উন্নয়নের সুফলও মানুষের কাছে তেমন পৌঁছে না। এখন অনেক ক্ষেত্রে যেমনটা হচ্ছে। তাই সব উন্নয়ন প্রকল্প নেয়ার আগে তার ফিজিবিলিটি স্টাডি করতে হবে। এনভায়রনমেন্টাল, জিওলজিক্যাল, হাইড্রোলজিক্যাল, সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট, ডেমোগ্রাফিক সাইজ ও ইকোনমিক আউটপুট বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্প নিতে হবে। সর্বোপরি বিবেচনায় আনতে হবে স্থানীয় এলাকার মাস্টারপ্ল্যান। নইলে উন্নয়ন হবে অগোছালো ও বিক্ষিপ্ত। এ প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে বিআইপি যে মাস্টারপ্ল্যান অনুসরণের তাগিদ দিয়েছে, তা সময়োপযোগী। সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা ও সচেষ্টায় দেশে পরিকল্পিত উন্নয়ন নিশ্চিত হবে—এমনটাই প্রত্যাশা।
