৩৬ বড় গ্রাহকে কেন্দ্রীভূত প্রায় ৪০ শতাংশ ঋণ

বেসরকারি বড় ঋণগ্রহীতাদের হাতে অগ্রণী ব্যাংকের ভবিষ্যৎ

হাছান আদনান

দেশের বড় কিছু করপোরেটের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ। ব্যাংকটির বিতরণকৃত মোট ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশই গিয়েছে ৩৬ গ্রাহকের কাছে, যার সিংহভাগই বেসরকারি খাতের। কোম্পানিগুলোর মধ্যে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে সাত ২৯টি। এসব বড় গ্রাহকের মধ্যে মূলত বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলোর ভালোমন্দ বা সদিচ্ছার ওপরই এখন নির্ভর করছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ।

গত বছরের শেষে ব্যাংকটির মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৯ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৬ কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে ২৩ হাজার ৭৩ কোটি টাকারও বেশি। এসব কোম্পানির একেকটি ২৮৪ কোটি থেকে শুরু করে হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নিয়েছে।

অগ্রণী ব্যাংকের ঋণের সবচেয়ে বড় গ্রাহক ওরিয়ন গ্রুপ। ২০২১ সাল শেষে ওরিয়নের কাছে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ ছিল হাজার ৯৯ কোটি টাকা। ব্যাংকটি থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ গিয়েছে ইউনিক গ্রুপের কাছে। গত বছর শেষে গ্রুপের কাছে অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ ছিল হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। তৃতীয় স্থানে রয়েছে নিট স্পিন লিমিটেড। কোম্পানিটি অগ্রণী ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে হাজার ২৬১ কোটি টাকা।

ঋণের অন্য বড় গ্রাহকদের মধ্যে হাজার ৯৭ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে জাকিয়া গ্রুপের কাছে। এছাড়া জজ ভূঞা গ্রুপের কাছে ৯২৯ কোটি, বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেডের কাছে ৯০০ কোটি, থার্মেক্স গ্রুপের কাছে ৭৬৯ কোটি, তানাকা গ্রুপের কাছে ৭৩৭ কোটি, ম্যাগপাই গ্রুপের কাছে ৭৩০ কোটি নাইস স্পান মিলস লিমিটেডের কাছে ৬৮৩ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে অগ্রণী ব্যাংকের। এসব গ্রাহক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির শীর্ষ ১০ ঋণগ্রহীতা হিসেবে স্বীকৃত।

বড়দের কাছে ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করছেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান . জায়েদ বখত। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বড় ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু রীতিনীতি আছে। সেসব রীতিনীতি মেনেই আমরা বড় গ্রহকদের ঋণ দিয়েছি। তবে অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ বড়দের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমি স্বীকার করছি। যেকোনো ব্যাংকের ক্ষেত্রেই ধরনের ঋণ কিছুটা ঝুঁকি তৈরি করে। আশার কথা হলো অগ্রণী ব্যাংকের বড় গ্রহকদের ঋণ নিয়মিত আছে। যেসব ঋণ এরই মধ্যে বিতরণ হয়ে গিয়েছে, সেগুলো আদায়ে জোর দেয়া হচ্ছে।

জায়েদ বখত বলেন, সম্প্রতি বড়দের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু বিধিনিষেধ দিয়েছে। আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিধিনিষেধ মেনে বড়দের ঋণ নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হয়েছি। ঋণের ঝুঁকি কমাতে আমরা সিন্ডিকেশনের পদ্ধতিতে বড় ঋণ বিতরণ করছি। পাশাপাশি এসএমই খাতে ঋণ বিতরণে জোর দেয়া হচ্ছে।

অগ্রণী ব্যাংকের সরকারি-বেসরকারি বড় ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে আরো রয়েছে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (৬৬২ কোটি টাকা), প্যাসিফিক গ্রুপ (৬৫৮ কোটি), যমুনা গ্রুপ (৬৩০ কোটি), প্রাইম গ্রুপ (৬০৮ কোটি), ঢাকা হাইড অ্যান্ড স্কিন্স লিমিটেড (৫৬৬ কোটি), নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন (৫৫৩ কোটি), প্যারামাউন্ট বিট্র্যাক এনার্জি লিমিটেড (৫৩১ কোটি), নোমান গ্রুপ (৫২৭ কোটি), মুন গ্রুপ (৫২১ কোটি), বসুন্ধরা গ্রুপ (৫১৪ কোটি), বিএসআরএম স্টিল (৫১১ কোটি), নোমান উইভিং মিলস লিমিটেড (৫১১ কোটি), বেক্সিমকো গ্রুপ (৫০৯ কোটি), সোনালী গ্রুপ (৫০৩ কোটি), বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড অর্গানাইজেশন (৪৯০ কোটি), আরপিসিএল (৪৬৭ কোটি), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (৪৪০ কোটি), সিকদার গ্রুপ (৪৪০ কোটি), অগ্রণী ইকুইটি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (৪০১ কোটি), অ্যারিস্টোক্র্যাট গ্রুপ (৩৯৪ কোটি), নিটল মটরস লিমিটেড (৩৪৩ কোটি), আবদুল মোনেম লিমিটেড (৩০৯ কোটি), লাবিব গ্রুপ (৩০১ কোটি), প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ (২৯২ কোটি), সাদ মুসা ফ্যাব্রিকস লিমিটেড (২৮৫ কোটি) সিটি গ্রুপ (২৮৪ কোটি টাকা) অগ্রণী ব্যাংকের শীর্ষ ৩৬ গ্রাহকের মধ্যে সাতটি কোম্পানি সরকারি খাতের। এসব কোম্পানির কাছে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা।

অগ্রণী ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সাল শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৯ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। ঋণের ৩২ দশমিক ২৮ শতাংশই বিতরণ করা হয়েছে একটিমাত্র শাখা থেকে। অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নিচে অবস্থিত প্রিন্সিপাল শাখা থেকে বিতরণ করা হয়েছে ১৯ হাজার ২৯৮ কোটি টাকার ঋণ। অভিযোগ রয়েছে, শাখাটিকে ঘিরে অনিয়ম-দুর্নীতির একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ব্যাংকটির প্রায় সব বড় গ্রাহকই প্রিন্সিপাল শাখা থেকে ঋণ নিয়েছেন।

২০২১ সাল শেষে অগ্রণী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশ গিয়েছে মাত্র ৩৬ গ্রাহকের কাছে। তবে আগের বছর বড় এসব গ্রাহকের কাছে ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ার হার ছিল আরো বেশি। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর অগ্রণী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৫১ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। ঋণের অর্ধেকের বেশি তথা ২৬ হাজার ৬১৯ কোটি টাকাই পেয়েছিল মাত্র ৩৬ গ্রাহক। বড় কয়েকটি করপোরেটের ঋণ কিছুটা কমে আসায় গত বছর কেন্দ্রীভূত ঋণের পরিমাণ কমেছে।

২০১৬ সাল থেকে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি পদে দায়িত্ব পালন করছেন শামস-উল ইসলাম। প্রথম মেয়াদে তিন বছরের দায়িত্ব পালন শেষ হলে ২০১৯ সালে তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে এমডি নিয়োগ দেয়া হয়। আগামী আগস্টে এমডি পদে তার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংক কোম্পানিতে নির্ধারিত এমডি পদের বয়সসীমা ৬৫ পূর্ণ হবে শামস-উল ইসলামের। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই শামস-উল ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)

শামস-উল ইসলাম অগ্রণী ব্যাংকের এমডি পদে দায়িত্ব নেয়ার সময় ২০১৬ সালে অগ্রণী ব্যাংকে ২০০ কোটি টাকার বেশি এমন ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ছিল ১৩। এসব গ্রাহকের কাছে ব্যাংকটির মোট ঋণের পরিমাণ সীমাবদ্ধ ছিল হাজার ১১২ কোটি টাকায়। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৯২৯ কোটি টাকা ঋণ ছিল ওরিয়ন গ্রুপের। কিন্তু গত পাঁচ বছরে অগ্রণী ব্যাংকের মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি ঋণ নেয়া বড় গ্রাহকের সংখ্যা তিন গুণ বেড়েছে। একই সঙ্গে বড় গ্রাহকদের কাছে ব্যাংকের কেন্দ্রীভূত ঋণের পরিমাণ বেড়েছে চার গুণ।

গত পাঁচ বছরে অগ্রণী ব্যাংকের আমানত, বিতরণকৃত ঋণসহ ব্যবসায়িক পরিধিও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু সময়ে ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্য সুদৃঢ় না হয়ে আরো ভঙ্গুর হয়েছে। ২০২১ সালে সুদ খাতে ব্যাংকটি লোকসান দিয়েছে ৭৪৪ কোটি টাকা। গত বছর অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা বেড়েছে। ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে হাজার ৯৯২ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৭১ শতাংশ। খেলাপি ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত সঞ্চিতিও রাখতে পারেনি অগ্রণী ব্যাংক। ২০২১ সাল শেষে হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা সঞ্চিতি ঘাটতি ছিল ব্যাংকটির।

সামগ্রিক বিষয়ে বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও শামস-উল ইসলামকে পাওয়া যায়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন