পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প

নির্মাণের আগেই সম্ভাবনা বড় প্রশ্নের মুখে

শামীম রাহমান

পদ্মা সেতুর রেল সংযোগের নির্মাণকাজ ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭০ কিলোমিটার নতুন রেলপথ তৈরি করছে সরকার। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় নয়টি জেলায় রেল সংযোগ স্থাপনের পাশাপাশি ভবিষ্যতে দুটি সমুদ্রবন্দর, ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের একটি সাবরুটে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্য থেকে হাতে নেয়া হয়েছে প্রকল্পটি।

বলা হচ্ছে, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে প্রায় শতাংশ অবদান রাখবে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ। যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রকল্পটির জন্য নেয়া চীনের প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা ঋণ বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে উঠতে পারে। প্রতি বছর ঋণের কিস্তি যা আসবে, তা রেলপথের আয় দিয়ে শোধ হবে না।

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত সরকারের খরচ হচ্ছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ২৬৭ কোটি ডলার বা ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে এক্সিম ব্যাংক অব চায়না। প্রেফারেনশিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটের (পিবিসি) মাধ্যমে নেয়া ঋণের সুদহার শতাংশ। গ্রেস পিরিয়ড ছয় বছর। রিপেমেন্ট পিরিয়ড ২০ বছর। ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে ২০২৫ সালে। সুদসহ প্রতি বছর গড়ে সাড়ে ১৩ কোটি ডলার বা প্রায় হাজার ২০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে।

২০২৪ সালের জুনে ঢাকা-পদ্মা সেতু-যশোর রেলপথটিতে ট্রেন চলাচল শুরুর পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আফজাল হোসেন বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, ঢাকা-খুলনা রুটের আন্তঃনগর চিত্রা সুন্দরবন এক্সপ্রেস এবং ঢাকা-বেনাপোল রুটের আন্তঃনগর বেনাপোল এক্সপ্রেস রেলপথটি ব্যবহার করবে। এতে প্রতিটি ট্রেনের যাত্রার সময় কমবে - ঘণ্টা। এর বাইরে ভবিষ্যতে ঢাকা-গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া, ঢাকা-ফরিদপুর-রাজবাড়ী এবং ঢাকা-মাগুরার মধ্যে রেল চলাচলের সুযোগ তৈরি হবে। ঢাকা-কলকাতার মধ্যেও ট্রেন পরিচালনার সুযোগ থাকছে। পাশাপাশি মোংলা বন্দর, বরিশাল পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকেও ভবিষ্যতে নতুন রেলপথ দিয়ে পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনার সুযোগ তৈরি হবে।

রেলপথটিতে ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে সরকারের বার্ষিক আয় প্রকল্পের ঋণের কিস্তির তুলনায় কম হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিষয়ে অর্থনীতিবিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক . মইনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের পর পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে তৈরি করা রেলপথ আন্ডার ইউটিলাইজড থাকার একটা সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ রেলপথটি খুব বেশি ব্যবহার হবে না। তাই বলা যায়, খরচের বিবেচনায় রেলপথটির খুব বেশি লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

তিনি আরো বলেন, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হবে ২০২৫ সালে। প্রতি বছর ঋণের কিস্তি যা আসবে, তা রেলপথের আয় দিয়ে মেটানো যাবে না। সেজন্য ঋণ শোধের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য বোঝা হিসেবে চেপে থাকবে। বিশেষ করে প্রথম কয়েক বছর ধরে প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। পরে অবশ্য যদি পায়রা বন্দর চালু হয়ে যায়, মোংলা বন্দরের সংযোগ তৈরি হয়, দেশের রেলপথগুলোয় বৈদ্যুতিক ট্রেন চালুর একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়, তখন রেলপথটি ভালোভাবেই ব্যবহূত হবে।

দেশের অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে ওঠার শঙ্কার কথা বললেও সারা দেশে সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব রেল নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ নির্মাণ প্রকল্পকে সরকারের দূরদর্শী পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছেন তিনি।

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে ধরা হয়েছিল পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে এর সংযোগ। কিন্তু সরকার বর্তমানে পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা থেকেই সরে এসেছে। এতে পদ্মা রেলে কনটেইনার পরিবহনের যে পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল, তাতে অনেকটাই ব্যাঘাত ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের একটি সাবরুটে যুক্ত হওয়া প্রকল্পটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। ভারতের পেট্রাপোল হয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দোহাজারি দিয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত রুটটি নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রকল্পের সমীক্ষায় প্রক্ষেপিত আয়ের তুলনায় এর প্রকৃত আয় অনেকটাই কম হবে।

সামগ্রিকভাবে পদ্মা রেল করিডোরটি বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য একটি লোকসানি করিডোর হতে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক . সামছুল হক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, করিডোরটির সবচেয়ে বড় সমস্যা এটি সিঙ্গেল লাইন। স্বভাবতই করিডোরটির পরিচালন সক্ষমতা হবে কম। প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় বলা হয়েছিল এটি হবে দ্রুতগতির করিডোর। কিন্তু অ্যাট গ্রেড (মাটির সমান্তরাল) অংশে লেভেল ক্রসিংসহ নানা কারণে এটি হয়তো দ্রুতগতির করিডোর হবে না। কনটেইনার নিয়ে পায়রাভিত্তিক যে স্বপ্নটা ছিল, সেটিও এখন আর নেই। কারণ গভীর সমুদ্রবন্দরটি আর হচ্ছে না। সব দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় যেসব কথা বলা হয়েছিল, এখনই তার ধারেকাছে কোনো নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে না। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পদ্মা সেতুর টোল। ট্রেনে পারাপারের জন্য রেলকে বছরে মোটা অংকের টোল দিতে হবে। ফলে রেলপথের পরিচালন ব্যয়ও হবে অনেক বেশি।

রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন সম্প্রতি পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ সরেজমিন পরিদর্শন করেন। সময় তিনি বলেন, আগামী বছরের মার্চে রেলপথটির ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা অংশে ট্রেন চালানোর লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি। পুরো রেলপথটি চালু হবে ২০২৪ সালের জুনে। রেলপথটি চালু হলে তা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন