লামার পাহাড়ে অগ্নিসংযোগ

ফুরিয়ে আসছে ম্রো-ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর জুম আবাদের সময়

সুজিত সাহা ও টিংশৈপ্রু মংটিং

পাহাড়ে গড়ে ১৮-২০ প্রজাতির ফসল চাষ করা হয় ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

বান্দরবানের লামা উপজেলায় ম্রো-ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর জুমের পাহাড় ইজারা নেয়া হয়েছে দাবি তুলে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ উঠেছে লামা রাবার কোম্পানির বিরুদ্ধে। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টির এখনো সুরাহা না হওয়ায় সেখানে জুম চাষ করতে পারছে না ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ। এদিকে আবার ফুরিয়ে আসছে জুম চাষের সময়। চলতি মাসের মধ্যে জুম চাষ করতে না পারলে আগামী এক বছর চরম খাদ্য সংকটের মধ্যে পড়বে তিন আদিবাসী পাড়ার ২২৫ বাসিন্দা।

গত ২৬ এপ্রিল লামা উপজেলার ডলুছড়ি মৌজার সরই ইউনিয়নের তিনটি আদিবাসী পাড়ার প্রায় ৪০০ একর জমিতে একটি সংঘবদ্ধ দল আগুন লাগিয়ে দেয়। অগ্নিকাণ্ডে জুম চাষের ওই পাহাড়ে পাড়াবাসীর লাগানো বিভিন্ন ফলদ গাছ, বাগান বাঁশঝাড় পুড়ে যায়। জমিগুলোয় বছরও জুম চাষের কথা ছিল তিন পাড়ার বাসিন্দাদের। কিন্তু ভয়ে এখনো জুমের বীজ বপন শুরু করতে পারেনি কেউই। পাড়াপ্রধানসহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে জেলা প্রশাসন জুম চাষ চালিয়ে যেতে মৌখিক নির্দেশনা দিলেও তাদের ভয় কাটছে না। তাছাড়া লামা রাবার কোম্পানির অব্যাহত হুমকি মহড়ার কারণে পরিবার অনুযায়ী নির্দিষ্ট পাহাড়ে জুম চাষ করতে পারছে না কেউই। মে মাসের মধ্যে প্রশাসনিকভাবে পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে জুম চাষে লিখিত নির্দেশনা না দিলে আগামীতে বছরব্যাপী খাদ্য সংকটে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে স্থানীয়রা।

কৃষি বিভাগ স্থানীয় পাড়াবাসীর তথ্যে জানা গিয়েছে, সাধারণত প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যে পাহাড়ের আগাছা কেটে ফেলা গাছপালা পুড়িয়ে দিতে পাহাড়ের ঢালু জমিতে আগুন লাগানো হয়। এরপর এপ্রিল-মের মধ্যে জুমের বীজ বপন করে আদিবাসীরা। জুন থেকে পুরোদমে বর্ষা মৌসুম চলে এলে জুমের বীজ বপন করা যায় না। ফেব্রুয়ারি থেকেই লাংকম ম্রো পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া রেংয়েন পাড়ার বাসিন্দারা জুমের জন্য এসব পাহাড়ি জমি প্রস্তুত করেছিল। কেউ কেউ পরিবারভিত্তিক পাহাড়ের আগাছা কেটে ফেলা গাছপালা পুড়িয়ে জুম চাষ শুরু করেছিল। কিন্তু লামা রাবার কোম্পানির দেয়া আগুনে অনেকের বপন করা বীজও নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গেলে আদিবাসী পাড়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা হয়। তাদের দাবি, চলতি মাসের মধ্যে বীজ মাটিতে বপন করা না গেলে আর জুম চাষ হবে না। কারণে প্রশাসনের কাছে দফায় দফায় যোগাযোগ করা হলে মৌখিকভাবে জুম চাষের সম্মতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু রাবার কোম্পানির লোকজন প্রতিনিয়ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়ায় পাড়াবাসী জুম চাষ করতে সাহস পাচ্ছে না।

স্থানীয় পাড়ার কারবারি লাংকম ম্রো লামা বলেন, এপ্রিলের শুরু থেকেই এলাকায় রাবার বাগান সম্প্রসারণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রাবার কোম্পানি। পাহাড় পুড়িয়ে দেয়ায় বছর জুম চাষ এখনো শুরু করতে পারেনি পাড়াবাসী। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জুম চাষের জন্য বলা হলেও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ছাড়া তারা জুম চাষ করতে ভয় পাচ্ছে। জুম চাষ করতে না পারলে আগামী এক বছর খাদ্য সংকটের মধ্যে থাকতে হবে বলে আক্ষেপ করেন তিনি।

বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বণিক বার্তাকে বলেন, জুম পাহাড়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত পরিদর্শন, মামলা দায়ের, ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীদের খাদ্যসহায়তা দেয়া হয়েছে। প্রশাসনের ভূমি শাখায় ইজারা দেয়া পাহাড়ি জমির নথিপত্র পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ঘটনা তদন্তে একটি বিশেষায়িত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কমিটি আজ ঘটনাস্থলে গিয়ে উভয়পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে প্রতিবেদন জমা দেবে।

জুম চাষের সময় ফুরিয়ে আসার বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিনিধিরা জুম চাষের বিষয়ে প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছে। আমরাও তিন পাড়ার বাসিন্দাদের মূল জুম চাষের জমিতে নতুন মৌসুমের চাষ শুরু করতে নির্দেশনা দিয়েছি। ফলে নতুন মৌসুমে জুম চাষ বিঘ্নিত হওয়ার সুযোগ নেই।

গড়ে ১৮-২০ প্রজাতির ফসল চাষ করা হয় জুম পাহাড়ে। জুলাই থেকে ফলন ওঠা শুরু করে, চলে ডিসেম্বর পর্যন্ত। উত্তোলন করা ফসলের অধিকাংশই আদিবাসীরা নিজেদের সারা বছরের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য মজুদ করে। তবে কলা, আম, মৌসুমি সবজিজাতীয় উদ্বৃত্ত ফসল পার্শ্ববর্তী হাটবাজারে বিক্রি করে টাকার প্রয়োজন মেটান পাহাড়ের কৃষক। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এবারের জুম চাষ ব্যাহত হলে আগামী এক বছর ৩৬টি পরিবারের সার্বিক খাদ্যনিরাপত্তা চরম হুমকিতে পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

অভিযোগের বিষয়ে লামা রাবার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের প্রকল্পপ্রধান মো. কামাল উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত প্রতিজন ২৫ একর করে ৬৪ জন ব্যক্তিমালিকানায় জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে পাহাড় ইজারা নিয়েছে। পরে ৬৪ জন ক্রমান্বয়ে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি গঠন করে রাবার বাগান সৃজন করা শুরু করে। আদিবাসী পাড়ার বাসিন্দারা আগে অন্য এলাকায় থাকলেও ২০১৬ সালের দিকে বর্তমান পাহাড়গুলোয় এসে বসতি গড়েছে। ইজারা নেয়া জমিতে বসতি স্থাপন জুম চাষ করলেও ২৬ এপ্রিলের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি কে বা কারা করেছে সে বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন।

তিন পাড়ার কারবারি হেডম্যানের দেয়া তথ্যে জানা গিয়েছে, সরই ইউনিয়নের লাংকম ম্রো পাড়ায় ১২টি পরিবারের জনসংখ্যা ৭০, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়ার ১৬টি পরিবারের জনসংখ্যা ৮৭ এবং রেংয়েন পাড়ার ১১টি পরিবারের মোট জনসংখ্যা ৬৮। অর্থাৎ তিন পাড়া মিলিয়ে সর্বমোট ২২৫ জন ম্রো ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বসবাস। পাহাড়ে জুম চাষ ছাড়াও এসব পরিবার পাহাড়ের নিচে সমতলে ধান চাষ করে। অগ্নিকাণ্ডের ফলে লাংকম ছড়ার পানিও শুকিয়ে গেছে। ফলে পাড়াবাসীকে সুপেয় পানির জন্য অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে যেতে হয়।

স্থানীয় কৃষি অফিস সূত্রে জানা গিয়েছে, আদিবাসীরা প্রতি বছর সব পাহাড়ে জুম চাষ করে না। একবার জুম চাষের পর এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত ওই পাহাড় পতিত রেখে দেয়। ওই সময়ে পাহাড়টিতে ফলদ বাগান, বাঁশ কিংবা প্রাকৃতিক বাগান তৈরি হয়। প্রাকৃতিক বাগানের মাধ্যমেও বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক চাহিদা মেটে। লামার তিন পাড়ার জুম চাষের জমিতে অগ্নিকাণ্ডের ফলে পতিত পাহাড়ও পুড়ে গিয়েছে। এতে জুম চাষ করলেও আগামী কয়েক বছর সংকটের মধ্যেই থাকতে হবে স্থানীয় বাসিন্দাদের।

লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রতন চন্দ্র বর্মণ বণিক বার্তাকে বলেন, ঘটনার পর কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে কয়েক দফায় এলাকাটি সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়েছে। এর আগে বীজ সার দেয়া হয়েছিল কৃষকদের। বর্তমান পরিস্থিতিতে কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে জুমচাষীদের সহায়তা দেয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। তবে মে কিংবা জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে জুম চাষের বীজ বপন করা না হলে ফসল প্রাপ্তির পরিমাণ অনেক কম হবে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।

তবে লামা রাবার কোম্পানির ৬৪ জন শেয়ারহোল্ডার রয়েছে বলে দাবি করলেও ৫২ জনের লিজের কাগজ জমা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান পরিষদের সদস্য মোজাম্মেল হক বাহাদুর। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, লিজের শর্তানুযায়ী লিজ পাওয়ার ১০ বছরের মধ্যে বাগান সৃজনে ব্যর্থ হলে কিংবা লিজ চুক্তির অন্য যে কোনো শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লিজ চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে। সে হিসেবে তিন পাড়ার জুম "মিকে লিজ "মির অংশ বলে লামা রাবার কোম্পানির দাবি অযৌক্তিক।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন