বরিশালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ভাড়া দিয়ে বাণিজ্য

এম. মিরাজ হোসাইন, বরিশাল

বরিশালের গিলাতলী আশ্রয়ণ প্রকল্পের তালাবদ্ধ ঘর ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

ভূমিহীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে দেয়া আশ্রয়ণের ঘর মাসিক ভিত্তিতে ভাড়া দিয়ে চলছে রমরমা বাণিজ্য। দুর্নীতি প্রভাব খাটিয়ে ঘর বরাদ্দপ্রাপ্ত অনেকেই সচ্ছল। তাদের অনেকেই এসব ঘরে বসবাস না করে ভাড়া দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে অসহায় মানুষ সরকারি এসব ঘরপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

বেশ কয়েকটি আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে, যাদের ঘর দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা ভূমিহীন নন, এদের বড় একটি অংশ আশ্রয়ণের ঘরে থাকেন না। বরিশাল জেলা আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন মনিটরিং কমিটির দাবি তদন্ত করে যাদের ভূমি গৃহ আছে, তাদের ঘর বাতিল করা হবে। ঘর ভাড়া দিলেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।

প্রশাসনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়েছে সুবিধাবঞ্চিত অসহায় ২১০৫ পরিবার। মানুষগুলোর এক সময় ছিল না নিজস্ব কোনো স্থায়ী ঠিকানা। খাসজমি কিংবা অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়ে ভাঙা ঘরে থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে দিনাতিপাত করতেন তারা। কিন্তু বর্তমানে সরকারের বিশেষ উদ্যোগে বাসস্থানসহ নানা সুবিধায় বদলে যাচ্ছে তাদের জীবনমান।

একইভাবে ঘর বন্দোবস্ত নিয়েও হয়েছে নানা দুর্নীতি। কোথাও অর্থের বিনিময়ে, কোথাও প্রভাব খাটিয়ে আবার কোথাও লবিং-তদ্বির করে ভূমি ঘর থাকার পরও ঘর বাগিয়ে নিয়েছেন অনেকে। এমনই চিত্র ফুটে উঠেছে বরিশালের চরমোনাই ইউনিয়নের গিলাতলী আশ্রয়ণ প্রকল্প হিজলা উপজেলার গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়ন কোনচর আশ্রয়ণ প্রকল্পে।

জানা গেছে, হিজলা উপজেলায় ৩২৫ জন ভূমিহীন গৃহহীন ব্যক্তির নামের তালিকা চূড়ান্ত করে মোট ১৮৭ জনকে ঘর করে চাবি হস্তান্তর করে উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু প্রায় এক বছর পর সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের এসব ঘরে থাকছে না অনেকেই। উপজেলার কোলচর গ্রামে সরকারের দেয়া আটটি ঘরই রয়েছে তালাবদ্ধ।

জানতে চাইলে স্থানীয় অনেকে জানান, তারা এখানে থাকেন না, থাকেন নিজস্ব বাড়িতে। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, গৃহহীন ভূমিহীনদের তালিকা সঠিকভাবে প্রস্তুত না করার কারণে সমস্যা হয়েছে। যারা তালিকা প্রস্তুত করেছেন তারা প্রকৃত ভূমিহীনদের নাম না দিয়ে তাদের পছন্দের লোকদের নাম দিয়েছেন।

গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়ন কোনচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের তালিকায় নম্বর সিরিয়ালে রয়েছে কোনচর গ্রামের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম সরদারের ঘর। যার ওই গ্রামেই দোতলা টিনশেড ঘর রয়েছে। তবু দলীয় প্রভাব খাটিয়ে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপহারের ঘর। নিজের ঘর থাকায় এখন সেখানে থাকেন না সাইফুল। তিনি জানান, আমার নিজের ঘর আছে, আবার আশ্রয়ণের ঘরও আছে। মূলত, আমার নামের তালিকা নেয়া হয়েছে আরো ছয় বছর আগে। সে সময় আমার ঘর ছিল না। এখন আমি ঘর করেছি। এখানে আমার কোনো দায় নেই।

হিজলার গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেরারম্যান উপাধ্যক্ষ শাহজাহান তালুকদার জানান, ইউপি সদস্যদের মাধ্যমে তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। সেখানে অনিয়ম থাকলে খতিয়ে দেখব।

হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বকুল চন্দ্র কবিরাজ জানান, ঘরের তালিকায় অনিয়মের বিষয়টি অনেকে আমাকে জানিয়েছেন। বিষয়ে আমরা তদন্ত করে দেখব।

একইভাবে বরিশাল সদর উপজেলার গিলাতলী আশ্রয়ণ প্রকল্পে দেখা গেছে ভূমি ঘর থাকা ব্যক্তিরা পেয়েছেন ঘর। যার কারণে তারা সেখানে থাকছেন না। আর যারা সেখানে রয়েছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন ভাড়াটিয়া হিসেবে। প্রকল্পের ৪৮ নম্বর ঘরে রয়েছেন শাজাহান নামে এক ব্যক্তি। তিনি এখানে একদিনও থাকেননি। কিন্তু তার ঘরে লোক রয়েছে। স্থানীদের দাবি, আত্মীয় পরিচয়ে ঘরটি ভাড়া দেয়া হয়েছে। শাজাহানের ওই ঘরে থাকছেন ভাগ্নে পরিচয়ে রেজাউল ইসলাম। শুধু ঘরই নয়, এমন আরো প্রায় ১০-১২টি ঘর ভাড়া দেয়া রয়েছে।

গিলাতলী আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পাওয়া সেই ঘরের বাসিন্দা নূপুর ঝুমুর বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য যা করেছেন, তা ছেলের জন্য বাবাও করে না। কিন্তু আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আছে, যারা নামে-বেনামে এসব ঘর নিয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

চরমোনাই ইউনিয়নের গিলাতলী আশ্রয়ণ প্রকল্পের সভাপতি আলম মৃধা বলেন, প্রকল্পে গত বছর কোরবানির পাঁচদিন আগে আমাদের ১৮৪টি ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু এখানে নিয়মিত ১০০ জনের বেশি থাকেন না। হয়তো তাদের অন্য কোথাও ঘর আছে, সেখানেই থাকেন। আবার কেউ কেউ মাঝে মাঝে এসে ঘুরে যান। আর প্রশাসনের কেউ এলে বা ত্রাণ দিলে তখন সবাই আসেন। ঘরভাড়ার বিষয়ে আলম মৃধা বলেন, পাঁচ-ছয়টি ঘরে অন্যরা থাকেন। তবে তারা আত্মীয় পরিচয় দেন। বিষয়গুলো আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি।

বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, আমি গিলাতলীতে গিয়ে কিছু ঘরে তালা দেখেছি। এর আগেও কয়েকজনের বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু পরে অফিসে গিয়ে এরা ডাকচিত্কার করে। তারা বলে কাজে গিয়েছিল। তাদের দাবি, আমরা ঘর দিয়েছি, কিন্তু কাজের ব্যবস্থা করে দিইনি। তার পরও যারা ঘরে থাকেন না, অন্য কোথাও তাদের ঘরের ব্যবস্থা থাকলে তাদের ঘর বাতিল করে নতুনদের সুযোগ দেয়া হবে। একইভাবে চরকাউয়া ইউনিয়নের হিরণনগর প্রকল্পে কয়েকজনের নামে ঘর বাতিল করা হয়েছে। আর ভাড়াটিয়ার বিষয়ে আমরা খোঁজ নিয়ে দেখছি। এমনটা হলে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নেব।

বরিশাল জেলা আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক শহিদুল ইসলাম বলেন, সরকারের দেয়া ঘর নিয়ে না থেকে নিজের ঘরে থাকাটা অবৈধ বেআইনি। এমনটা হলে তা বাতিল করা হবে।

ব্যাপারে বরিশাল জেলা আশ্রয়ণ প্রকল্প  বাস্তবায়ন মনিটরিং কমিটির আহ্বায়ক এবং বরিশাল জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, ভূমিহীনের ভূমি ঘর থাকলে উপকারভোগী পরিবর্তন করা হবে। এছাড়া ঘর ভাড়া দেয়ার বিষয়ে অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন